২০ এপ্রিল, ২০২২
ইতেকাফ একটি আরবি শব্দ। ইতেকাফের আভিধানিক অর্থ- কোনো স্থানে আটকে যাওয়া বা থেমে যাওয়া, অবস্থান করা, আবদ্ধ হয়ে থাকা।
শরিয়তের পরিভাষায় ইতেকাফ অর্থ- আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে মসজিদে থাকা ও অবস্থান করা।
কুরআন মাজিদে দু’টি আয়াতে ইতেকাফ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যে, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকুকারী-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো। (সূরা বাকারাহ, আয়াত-১২৫) অর্থাৎ শব্দগুলো থেকে কিছু বিধিবিধান প্রমাণিত হয়। প্রথমত, কাবা গৃহ নির্মাণের উদ্দেশ্য তাওয়াফ, ইতেকাফ ও সালাত। দ্বিতীয়ত, তাওয়াফ আগে আর সালাত পরে। তৃতীয়ত, ফরজ হোক কিংবা নফল কাবা গৃহের অভ্যন্তরে যেকোনো সালাত আদায় করা বৈধ।
ইতেকাফের প্রকার : ইতেকাফ তিন প্রকার যথা- ওয়াজিব, সুন্নতে মুয়াক্কাদা ও মুস্তাহাব। ১. ওয়াজিব ইতেকাফ : মান্নতের ইতেকাফ। যে ব্যক্তি ইতেকাফ করার মান্নত করবে, তার ওপর ইতেকাফ আদায় করা ওয়াজিব। মান্নতের ইতেকাফের জন্য সাওম পালন করা শর্ত। যদি নির্ধারিত কোনো সময় বা স্থানের মান্নত করে, তাহলে ওই সময় ও স্থানেই ইতেকাফ করতে হবে।
২. সুন্নতে মুয়াক্কাদা : মাহে রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। প্রতি মহল্লায় কমপক্ষে একজন করে ইতেকাফ করলে, সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে। যদি কেউই ইতেকাফ না করে, তাহলে গোটা মহল্লাবাসী গুনাহগার হবে। ৩. মুস্তাহাব : রমজান মাস ছাড়া অন্য যেকোনো সময় মসজিদে ইতেকাফের নিয়ত করে অবস্থান করা মুস্তাহাব। মুস্তাহাব ইতেকাফে সাওম পালন করা শর্ত নয়। মুস্তাহাব ইতেকাফের নির্ধারিত কোনো মেয়াদও নেই।
ইতেকাফের শর্তাবলি : মুসলমান হওয়া। বালেগ ও আকেল হওয়া। পবিত্র থাকা। ইতেকাফের নিয়ত করা। পূর্ণাঙ্গ সময় (আবশ্যকীয় প্রয়োজন ব্যতীত) মসজিদে অবস্থান করা ইত্যাদি।
ইতেকাফে করণীয় : বিশেষ কতগুলো শর্তসাপেক্ষে একটা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নির্দিষ্ট মসজিদে অবস্থান করে আল্লাহর জিকির, তাসবিহ, ইস্তিগফার, দরুদ, কুরআন তিলাওয়াত ও জ্ঞানচর্চা ইত্যাদি আমলগুলো করা। মোট কথা, মসজিদে থেকে করা সম্ভব এমন সব ইবাদতই ইতেকাফ অবস্থায় করা যায়। বিশেষ করে তা এমন কোনো মসজিদে হওয়া, যে মসজিদে জামাত হয়। ইতেকাফ অবস্থায় খানা-পিনার হুকুম সাধারণত সাওম পালনকারীদের প্রতি প্রযোজ্য নির্দেশেরই অনুরূপ। তবে স্ত্রী সহবাসের ব্যাপারে এ অবস্থায় পৃথক নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, ইতেকাফ অবস্থায় এটা রাতের বেলায়ও জায়েজ নয়। হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘ইতেকাফকারী মূলত গুনাহ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। তাকে ইতেকাফের বিনিময়ে এত অধিক পরিমাণ সওয়াব দেয়া হবে, যেন সে সমস্ত সওয়াব অর্জনকারী।’ (ইবনে মাজাহ)
ইতেকাফে বর্জনীয় : ইতেকাফ বাতিল হয়ে যায় এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকা। যেমন- মসজিদ বা ইতেকাফের স্থান থেকে নিষ্প্রয়োজনে বের হওয়া। ইসলাম পরিত্যাগ করা। অজ্ঞান, পাগল বা মাতাল হওয়া। মহিলাদের মাসিক হওয়া। সন্তান ভূমিষ্ট বা গর্ভপাত হওয়া। সহবাস করা। বীর্যপাত ঘটানো। ইতেকাফকারীকে কেউ জোরপূর্বক মসজিদ থেকে বের করে দেয়া। তাহলেও ইতেকাফ বাতিল হয়ে যাবে।
ইতেকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত : ইতেকাফের গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতেকাফ করবে, সে ব্যক্তি দু’টি পবিত্র হজ ও দু’টি পবিত্র উমরার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে।’ রাসূল সা: আরো বলেছেন, ‘ইতেকাফকারী গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে এবং আমল না করেও তারা আমলকারীদের নেকির পরিমাণ নেকির মালিক হবে।’ (তিরমিজি)
বস্তুত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে দুনিয়ার সব কার্যক্রম থেকে নিজেকে মুক্ত রেখে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদতে নিজেকে নিয়োজিত রাখাই ইতেকাফের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ : হাদিস শরিফে এসেছে, আবদল্লাহ ইবনে উমার রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। (বুখারি-২০২৫) নবীর সহধর্মিণী হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: রমজানের শেষ দশক ইতেকাফ করতেন। তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত এ নিয়মই ছিল। এরপর তার সহধর্মিণীরাও (সে দিনগুলোতে) ইতেকাফ করতেন। (মুসলিম-১১৭২)
নবী সা:-এর সহধর্মিণী আয়েশা রা: বলেছেন, রাসূল সা: ইতেকাফে থাকা অবস্থায় তাঁর শির আমার দিকে ঝুঁকিয়ে দিতেন, আমি তাঁর চুল চিরুনি দিয়ে আঁচড়িয়ে দিতাম। আর তিনি হাজতে-ইনসানি (পায়খানা-প্রস্র্রাবের আবশ্যকতা) ব্যতীত গৃহে প্রবেশ করতেন না। (বুখারি-২০২৯, মুসলিম-২৯৭)
রমজানের শেষ দশকে ইবাদত : হজরত আয়েশা রা: বলেন, যখন রমজানের শেষ দশক আসত তখন নবী করিম সা: তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। (বুখারি-২০২৪)
অতএব, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে সঠিকভাবে কুরআন ও হাদিস বোঝার এবং রমজানের শেষ দশকে সুন্নত মোতাবেক পরিপূর্ণ হক আদায়ের সাথে ইতেকাফ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
হুসাইন আহমদ
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী আইন ও গবেষণা বিভাগ (ইফতা-দ্বিতীয় বর্ষ), দারুস-সুন্নাহ মাদরাসা, টাঙ্গাইল।