১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) আবারো নবীন শিক্ষার্থীকে রাতভর নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতনের সময় বিবস্ত্র করে অঙ্গভঙ্গি করানোসহ বিভিন্ন শারীরিক নির্যাতন করা হয়। গত বুধবার রাতে বিশ^বিদ্যালয়ের লালন শাহ গণরুমে (১৩৬ নম্বর কক্ষ) এ ঘটনা ঘটে। এদিকে, বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে ঘটনা তদন্তে মঙ্গলবার পৃথক কমিটি করেছে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও লালন শাহ হল প্রশাসন।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মুদাচ্ছির খান কাফি ও ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের একই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সাগরসহ কয়েকজন ভুক্তভোগীকে নির্যাতন করেন। অভিযুক্তরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ও সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয়ের অনুসারী। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-ফিকহ এন্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
ভুক্তভোগী ও তার সহপাঠীদের সূত্রে জানা যায়, গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার দিকে অভিযুক্তরা পরিচয়পর্বের নামে ভুক্তভোগীকে ওই কক্ষে ডেকে নেয়। একপর্যায়ে বাবা মা তুলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এসময় তারা ভুক্তভোগীকে অশালীন অঙ্গভঙ্গি করতে বাধ্য করে। এসব করতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে রড দিয়ে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে অভিযুক্তরা ভুক্তভোগীকে জোরপূর্বক উলঙ্গ করে টেবিলের উপর দাঁড় করিয়ে রাখে। উলঙ্গ অবস্থায় সিনিয়ররা তাকে পর্নোগ্রাফি দেখতে বাধ্য করে বলে জানা গেছে।
এছাড়াও এসময় তাকে নাকে খত দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন করে অভিযুক্তরা। রাত ১২টা থেকে প্রায় ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত দফায় দফায় চলে এ নির্যাতন। এসময় তাকে ভয় দেখিয়ে তার বিছানাপত্র বাইরে ফেলে দেওয়া হয়। অভিযুক্তরা নির্যাতনের বিষয়ে কাউকে জানালে আরো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হবে হুমকি দেন।
এদিকে, র্যাগিংয়ের ঘটনাটি প্রকাশ্যে এলে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে মঙ্গলবার পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও লালন শাহ হল প্রশাসন। হল প্রশাসন গঠিত চার সদস্যের তদন্ত কমিটিতে হলের আবাসিক শিক্ষক আলতাফ হোসেনকে আহ্বায়ক ও হলের সহকারী রেজিস্ট্রার জিল্লুর রহমানকে সদস্য সচিব করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আবাসিক শিক্ষক আব্দুল হালিম ও হেলাল উদ্দিন। ঘটনায় তথ্য উদঘাটন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তদন্ত কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিতে শেখ রাসেল হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. দেবাশীষ শর্মাকে আহ্বায়ক ও সহকারী প্রক্টর মিঠুন বৈরাগীকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্য হলেন আইন প্রশাসক ড. আনিচুর রহমান।
এদিকে ঘটনার পর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ভুক্তভোগী ও অভিযুক্তদের ডেকে কথা বলেন। এছাড়া গণরুমে সবাইকে ডেকে বিশেষ নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে অভিযুক্ত মোহাম্মদ সাগর বলেন, ‘এ রকম কোন ঘটনা ঘটেনি। এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’ আরেক অভিযুক্ত কাফিকে মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জয় বলেন, ‘হলে যারা থাকে সবাই ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে যায়। কিন্তু কারো ব্যক্তিগত কাজের দায় সংগঠন নেবে না। ঘটনা শোনার পর আমি ইতোমধ্যেই ভুক্তভোগীর জন্য হলে একটি সিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আমরা সবসময় ভুক্তভোগীর পাশে আছি।’
শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়সাল সিদ্দিকী আরাফাত বলেন, ‘র্যাগিং কোনভাবেই কাম্য নয়। ছাত্রলীগ পূর্বেও র্যাগিংয়ের অভিযোগে কর্মীদের শাস্তি দিয়েছে। কেউ অপরাধ করলে ছাড় পাবে না। বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের তদন্তে সঠিক বিষয় উঠে আসুক। এক্ষেত্রে আমরা আমাদের জায়গা থেকে সবোচ্চ সহযোগিতা করবো।’
এ বিষয়ে লালন শাহ হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আকতার হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর আমরা একটি তদন্ত কমিটি করেছি। অভিযোগের প্রমাণ হলে প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ বলেন, ‘বিষয়টি শোনার পর আমরা একটি জরুরি মিটিং করেছি। লিখিত অভিযোগ না পেলেও বিষয়টি জানার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশের পর আমরা র্যাগিং নিয়ে শক্ত অবস্থানে আছি।’
প্রসঙ্গত, এর আগেও গত বছরের জুনে শাখা ছাত্রলীগের দুই কর্মীর বিরুদ্ধে লালন শাহ হলের নবীন এক ছাত্রকে ‘বিবস্ত্র করে’ র্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার বিচার চেয়ে ভুক্তভোগী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা ও প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। পরে শাখা ছাত্রলীগ সম্পাদকসহ ছাত্রলীগ নেতারা ডেকে কথা বলার পর ভুক্তভোগী অভিযোগ তুলে নেয়। বিষয়টি নিয়ে র্যাগিং প্রতিরোধ সেল থেকেও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এছাড়া গত বছরের ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি ফুলপরী খাতুন নামের এক নবীন ছাত্রীকে র্যাগিংয়ের ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় হয়। এঘটনায় শাখা ছাত্রলীগের এ সহসভাপতি ও পাঁচ কর্মীকে বিশ^বিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়।