কিশোর অপরাধ দমনে ইসলামের নির্দেশনা

২৪ মে, ২০২৪

ইদানীং গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলো দেখলে বোঝা যায়, দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে কিশোর অপরাধ। কিশোরদের অপরাধপ্রবণতায় ভেঙে পড়ছে সামাজিক শৃঙ্খল। শহর থেকে গ্রামে সর্বত্রই চলছে কিশোর গ্যাংদের নানা মাত্রিক অপতৎপরতা। গণমাধ্যমে এখন প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে কিশোরদের ভয়ংকর সব অপকর্মের জরিপ ও তথ্য।

ধর্মীয় অনুশাসন, পারিবারিক সচেতনতা, সামাজিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপে এসব  নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে দেশের আগামী ভবিষ্যৎ ধ্বংসের মুখে পড়বে। কিশোরদের অপরাধ দমনে করণীয় ও ভূমিকা বিষয়ে কয়েকটি দিক তুলে ধরছি এই লেখায়।

মা-বাবা ও পরিবারের করণীয়

কিশোর অপরাধ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন মা-বাবা। তাঁদের নৈতিক আচার-আচরণ সন্তানের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

তাই দায়িত্বসচেতন মা-বাবার কর্তব্য হলো শৈশব থেকেই সন্তানকে ধর্মীয় অনুশাসনে গড়ে তোলা। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার পাশাপাশি তাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা। কারণ সন্তানের যেকোনো অপরাধের দায়ভার পরোক্ষভাবে তাঁদের ওপরেই বর্তায়। সমাজ ও প্রতিবেশীর কাছে লজ্জিত ও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, আর আল্লাহর কাছে পরকালীন জবাবদিহি তো আছেই।

সন্তানের ঈমান-আকিদা, আমল-আখলাক ও জীবনযাপনের প্রতিটি বিচ্যুতি ও অপকর্মের বিষয়ে প্রত্যেক মা-বাবাকে পরকালে জবাবদিহি করা হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তিই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার অধীনদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৭১৩৮)

পরকালীন জবাবদিহির এই অনুভূতি নিয়ে মা-বাবাকে সন্তানদের ভালো ও সৎ উপদেশ প্রদানের মাধ্যমে সংশোধন করতে হবে। পবিত্র কোরআনে সন্তানকে দেওয়া লুকমান হাকিমের উপদেশগুলো প্রত্যেক মা-বাবার জন্য উত্তম দৃষ্টান্ত। একত্ববাদ, তাকওয়া ও আল্লাহর আনুগত্যের পাশাপাশি আয়াতগুলোতে আছে ভদ্রতা, শালীনতা ও শিষ্টাচার সংবলিত পাঁচ ধরনের শিক্ষা।

১. একত্ববাদের শিক্ষা : ‘হে পুত্র, আল্লাহর সঙ্গে শরিক কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা মহা অন্যায়।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৩)

২. তাকওয়ার শিক্ষা : ‘হে পুত্র! যদি তা (পাপ-পুণ্য) হয় সরিষার দানার সমান এবং তা থাকে পাথরের ভেতর অথবা আসমান-জমিনের যেকোনো স্থানে, আল্লাহ তা উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী।’

(সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৬)

৩. আল্লাহর আনুগত্যের শিক্ষা : ‘হে পুত্র! নামাজ কায়েম করো, মানুষকে সৎকাজের আদেশ করো, মন্দ কাজে বাধা দাও এবং তোমার যে কষ্ট দেখা দেয়, তাতে ধৈর্য ধারণ করো। নিশ্চয়ই এটা অত্যন্ত দৃঢ় ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৭)

৪. শিষ্টাচার শিক্ষা : ‘মানুষের সামনে (অহংকারে) নিজ গাল ফুলিয়ো না এবং ভূমিতে দর্পভরে চলিয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দর্পিত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৮)

৫. ভদ্রতা ও শালীনতার শিক্ষা : ‘নিজ পদচারণে মধ্যপন্থা অবলম্বন করো এবং নিজ কণ্ঠস্বর সংযত রেখো। নিশ্চয়ই সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট স্বর গাধাদেরই স্বর।’

(সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৯)

এই উপদেশগুলোর বিপরীত আচরণ‌ই কিশোরদের নানা অপরাধে প্ররোচিত করে। মা-বাবারা তাঁদের দাম্পত্য জীবনে কোরআনের এই উপদেশ নিজেরা চর্চার পাশাপাশি সন্তানদের অভ্যস্ত করাতে পারলে তাদের বর্তমান ও আগামী সুন্দর ও সাফল্যময় হবে।

শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের করণীয়

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। শিক্ষকরা হচ্ছেন সেই নির্মাণের অনন্য কারিগর। শিক্ষার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। শিক্ষার্থীরা ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে শেখে। তাই কিশোর অপরাধ দমনে শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ শিক্ষার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন। তাই প্রাতিষ্ঠানিক পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের উত্তম চরিত্র ও সামাজিক শিষ্টাচার অনুশীলনে শিক্ষকদের পাঠ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধ বৃদ্ধিতে ধর্ম শিক্ষার বিকল্প নেই। আর এ জন্য শিক্ষার্থীদের নৈতিক মূল্যবোধ রক্ষায় ধর্ম শিক্ষার বইকে কিভাবে প্রায়োগিকরূপে পাঠদান করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদীক্ষার বিষয়গুলো হলো আমানত সমতুল্য। শিক্ষকদের এই আমানত রক্ষার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে। ইসলামে আমানত রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা আমানতগুলো প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দাও।’

(সুরা : নিসা, আয়াত : ৫৮)

নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে আমানত রক্ষা করে না, তার ঈমানের দাবি যথাযথ নয় এবং যে অঙ্গীকার পূরণ করে না, তার দ্বিন যথাযথ নয়।’

(মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৩১৯৯)

সমাজ ও রাষ্ট্রের করণীয়

কিশোর অপরাধ একটি প্রকট সামাজিক সংকট। এই সংকট দূরীকরণে সমন্বিতভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে। সমাজের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ব্যক্তিদের এর উত্তরণে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। মসজিদভিত্তিক সামাজিক দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এ ব্যাপারে ইমাম-খতিবদের সঙ্গে পরামর্শ করে অপরাধীদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি চর্চার কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সহায়তায় সমাজ নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিতে পারেন। কিশোরদের অপরাধপ্রবণতায় মাদকের প্রতি আসক্তির বিষয়টিও রয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রকে আরো কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। অসহায় ও পথশিশুদের সুশিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নিতে হবে। কিশোররা যেন রাজনৈতিক অপব্যবহারের বলি না হয়, সেদিকেও রাষ্ট্রকে ভূমিকা নিতে হবে। কিশোর অপরাধ দমনে প্রত্যেক নাগরিকের উচিত রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করা। ‘অন্যের সন্তান অপরাধ করলে আমার কী’ এই মনোভাব লালন করলে একটা সময় নিজের শিক্ষিত ও ধার্মিক সন্তানের ওপরও কিশোর গ্যাংয়ের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে যেতে পারে। নিজের পরিবার ও সন্তানকে রক্ষা করতে হলে আমাদের সবাইকেই সমাজ রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। কিশোর অপরাধ দমনে যার যার অবস্থান থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন কোনো অন্যায় (অপকর্ম) হতে দেখে, সে যেন সম্ভব হলে তা হাত দ্বারা রুখে দেয়। আর এটা সম্ভব না হলে প্রতিবাদী ভাষা দিয়ে তা প্রতিহত করে। আর তা-ও না পারলে সে যেন ওই অপকর্মকে হৃদয় দ্বারা বন্ধ করার পরিকল্পনা করে (মনে মনে ঘৃণা করে), এটি দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২১৭২)

আল্লাহ তাআলা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের শৃঙ্খলার স্বার্থে কিশোর অপরাধ দমনে সমন্বিতভাবে কার্যকর ভূমিকা নেওয়ার তাওফিক দান করুন।