করোনাকালের চোর চতুর্দশী

করোনাকালের চোর চতুর্দশী

নিজস্বপ্রতিনিধি

এমদাদুল হক সরকার,

সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষের মধ্যে চুরির নেশা বিদ্যমান। সাহিত্যে চুরিকে প্লেজিয়ারিজম বা কুম্ভীলক বলে। ইংরেজ নাট্যকার বেন জনসন ১৬০১ সালে 'প্লেজিয়ারিজম' শব্দটিকে ইংরেজি সাহিত্যে পরিচয় করিয়ে দেন। কারণ তারই এক বন্ধু ফ্লবে আত্র ‘ডিফল্টার’ নামে তাঁর এক নাটক ফরাসি ভাষায় হুবহু চুরি করে লিখেছিলেন। আর বাংলা লোকসাহিত্যের ভান্ডার তো চোরের বুদ্ধিমত্তা ও চাতুর্যের নানা গল্পে পরিপূর্ণ। হাজার বছর পূর্বে রচিত বাংলা সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন চর্যাপদেও রয়েছে চোরের কথা। আর প্রবীর মুখোপাধ্যায় তো সেই চৌর্যবৃত্তির গল্পগুলো নিয়ে বই সংকলন করে ফেল্লেন। উইলিয়াম কেরী, গিরিশচন্দ্র বসু, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, রেভারেন্ড লালবিহারী দে প্রমুখের লেখা চোরের গল্প নিয়ে প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের চমত্কার সংকলন সম্পাদনা 'চোর চতুর্দশী' । চোর চতুর্দশীর চোরেরা বুদ্ধিমান ও কৌশলী। তারা যেটুকু ক্ষতি করে তার পেছনে সামাজিক প্রশ্রয় আছে। উপেন্দ্রকিশোরের ঝানু চোর চানু তো রাজাকে বলে কয়ে বুদ্ধি করে ঠকিয়ে রাজকন্যে লাভ করল। চোর চতুর্দশীতে সংকলিত উইলিয়াম কেরির ইতিহাসমালায় রয়েছে এক চমকপ্রদ কাহিনি: চোর কীভাবে নিজের বুদ্ধির বলে রাজার শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার পর উল্টো রাজাকে মুগ্ধ করে সোজা তারই রাজসভায় তৎক্ষণাৎ মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেল। চৌর্যবৃত্তির সেই ধারা বাংলায় আজো বজায় রয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী করোনায় অসহায়দের জন্য বরাদ্দকৃত চাল বিতরণ করতে গিয়ে ২৫ জেলায় চাল চুরি হয়েছে ৩৪১ টন, মামলা হয়েছে ৯১টি এবং গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮৯ জনকে। সরকারি চাল আত্মসাতের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের ১৯ জন চেয়ারম্যান, ৩১ জন সদস্য, একজন জেলা পরিষদ সদস্য এবং একজন পৌর কাউন্সিলরসহ মোট ৫২ জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এমনকি নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ঈদ উপহারের আর্থিক সহায়তার তালিকায়ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৯৯ ব্যক্তির নামের পাশে একজনের মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার মুড়িয়াউক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মলাইয়ের বিরুদ্ধে। বাগেরহাটের শরণখোলায় ৪০ জনের নামের সঙ্গে নিজের ফোন নম্বর জুড়ে দিয়েছেন এক ইউপি সদস্য। সরকার মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সহায়তার অর্থ পাঠায় বলে এ ধরনের কৌশল বেছে নিচ্ছেন অনেক অসাধু জনপ্রতিনিধি। তারা নিজের পরিবার, আত্মীয়, সমাজের বিত্তশালীদের ফোন নাম্বার দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিতে চেষ্টা করছে। প্রশ্ন জাগে ত্রাণের নামে চাল, অর্থ চুরি করা ব্যক্তিরা জনপ্রতিনিধি হলেন কিভাবে? তারাও কি চোর চতুর্দশীর উইলিয়াম কেরির গল্পের চোরের ন্যায় নিজের বুদ্ধি বলে কিংবা আমলাদের সামাজিক প্রশ্রয়বলে কৃত চৌর্যবৃত্তিকে ঢেকে জনপ্রতিনিধি হওয়ার মাধ্যমে তথাকথিত রাজকন্যা কিংবা মন্ত্রীত্ব লাভ করলেন? বাংলার চোরের কৌশলি খপ্পর থেকে রেহাই পাননি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। ১৯১৮ সালে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে তাঁর খুব প্রিয় একটি ফাউন্টেন পেন চুরি হয়ে যায়। ২০০৪ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরায়নের রবীন্দ্র জাদুঘর থেকে রহস্যজনকভাবে 'নোবেল পদক' সহ চুরি যায় কবির ব্যবহার্য অন্তত অর্ধশত মূল্যবান জিনিস। এ জন্যই হয়তো রবিঠাকুর বঙ্গমাতা কবিতায় প্রিয় মাতৃভূমির কাছে নালিশ করে গেছেন, "সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করনি।" করোনা মহামারির মতো এমন পরিস্থিতিতেও চুরি প্রমাণ করে প্রাচীন চুরির সে ধারা বাঙ্গালী আজও বজায় রেখে চৌর্যবৃত্তিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। হয়তো প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের ন্যায় বাংলা সাহিত্যেও কোনো লেখকের জন্ম হবে যিনি করোনাকালে চাল, তেল আর অর্থ চুরির সেই গল্পগুলো সংকলন করে রচনা করবেন " করোনাকালের চোর চতুর্দশী "। এতে ঝানু চোর চানু চরিত্রে থাকবেন হালের তথাকথিত জনপ্রতিনিধিরা। আর বাংলা সাহিত্যের পাঠকরা রসিকতার সঙ্গে সেই চোরদের গল্প পড়ে মজা পাবেন। তথ্যসূত্র: প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের 'চোর চতুর্দশী', আন্দবাজার পত্রিকা, প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ।