ইসলামে ইট-পাথরের ছাদের নিচে আবদ্ধ থাকার নাম পরিবার নয়

ইসলামে ইট-পাথরের ছাদের নিচে আবদ্ধ থাকার নাম পরিবার নয়

ফাইল ছবি

ইসলামের পরিবারচিন্তা সুন্দর ও মনোরম, যা হবে সুখ, শান্তি, স্বস্তি ও সহমর্মিতায় ভরপুর। মানুষ যেখানে ফিরে ক্লান্তি ভুলবে, প্রশান্তিতে ভরে যাবে তার হৃদয়। ঘর হবে এতটাই প্রিয় যে পৃথিবীর যেখানেই থাকুক, মন পড়ে থাকবে ঘরে, পরিবারে। দিনশেষে পাখির মতো ঘরে ফিরতে ব্যাকুল হবে তার প্রাণ। পরিবারের সদস্যরাও হবে স্নেহ, মমতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার অঙ্গীকারে আবদ্ধ। আল্লাহ তাআলাও এমনটাই বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য করেছেন প্রশান্তির আবাস।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৮০)

এই প্রশান্তির আবাস তৈরি হবে যখন স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরের প্রতি আস্থাশীল হবে, তাদের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন সুদৃঢ় থাকবে এবং সবার মধ্যে ক্ষমা, সহযোগিতা, আত্মত্যাগ ও উপেক্ষার (অন্যের ভুলত্রুটি) মানসিকতা প্রবল হবে। একে অন্যকে বুঝবে, বোঝার চেষ্টা করবে এবং একজনের সংকট সমাধানে সবাই আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসবে। আধিপত্য ও ত্রাসের রাজত্বের পরিবর্তে মায়ার ভুবন তৈরির চেষ্টা করবেন অভিভাবকরা। এ ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী ও মা-বাবার ভূমিকাই মুখ্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তার নিদর্শন হলো, তিনি তোমাদের থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য সঙ্গিনী, যেন তোমরা প্রশান্তি লাভ করো। তিনি তোমাদের মধ্যে দান করেছেন ভালোবাসা ও সহমর্মিতা। নিশ্চয়ই এতে রয়েছে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন।’ (সুরা : রুম, আয়াত : ২১) কোরআনের ব্যাখ্যাকাররা বলেন, প্রশান্তিলাভের শর্ত হলো পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহমর্মিতা।

মুমিন পরিবারের বন্ধন হবে কাপড়ের বুননের মতো দৃঢ় ও নৈকট্যপূর্ণ। তাদের কষ্ট-সুখের অনুভূতিগুলো হবে অভিন্ন। একজনের ব্যথায় অন্যরা ব্যথিত হবে। সুখের আনন্দে ভাগ থাকবে সবার। ভালো কাজে তারা পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। কেউ পথ হারালে তাকে অন্যরা সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। আল্লাহ যেমনটি বলেছেন, ‘তোমরা ভালো কাজ ও খোদাভীতিতে পরস্পরকে সহযোগিতা করো। পাপ ও অবাধ্যতায় সহযোগিতা কোরো না। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তি দানকারী।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ২)

যখন পরিবারের কোনো একজন বিপদগ্রস্ত হবে, আশার কোনো আলো চোখে দেখবে না, তখন অন্যরা বিশ্বাসের সঙ্গে বলবে, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না।’ (সুরা :  জুমার, আয়াত : ৫৩) ‘নিশ্চয় দুর্দিনের পরই সুদিন আসে।’ (সুরা : আশ শারাহ, আয়াত : ৩) আল্লাহর অনুগ্রহলাভে সম্মিলিত চেষ্টা ও প্রার্থনায় মগ্ন হবে পরিবারটি।

কোনো সন্দেহ নেই, একজন মুমিন ও বিশ্বাসীর ঘর পৃথিবীর অন্য যেকোনো মানুষের ঘর থেকে ভিন্ন। কেননা মুমিন আল্লাহর ভাগ্য বণ্টনে বিশ্বাসী। যখন সে রাজপ্রাসাদে থাকে, তখন সে আল্লাহর দান ও অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা আদায় করে। আবার যখন সে কুঁড়েঘরে থাকে, তখনো সে আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। না পাওয়ার হাহাকার তাকে বিচলিত করতে পারে না। বরং সে আল্লাহর অভিভাবকত্বে আশ্বস্ত ও কল্যাণকামিতার প্রতি সংশয়হীন থাকে। আল্লাহর স্মরণে তার হৃদয় থাকে প্রশান্ত। কেননা সে আল্লাহকে প্রভু হিসেবে বিশ্বাস করে, ইসলামকে জীবনবিধান মেনে, রাসুল (সা.)-কে রাসুল হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট। ঈমান ও পরকাল তার জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ।

একজন মুমিনের ঘর-পরিবার কেমন হবে? যেমন ছিল প্রিয় নবী (সা.)-এর ঘর-পরিবার। ছোট ছোট আয়োজন, বিনম্র প্রত্যাশা, স্নিগ্ধ ভালোবাসা, নিঃশর্ত আনুগত্য, সৌভাগ্য ও আল্লাহর দয়ায় পূর্ণ। পার্থিব জীবন নিয়ে তারা চিন্তিত নয়, পরকাল আবাদের চিন্তায় বিভোর সবাই। সর্বদা আল্লাহর স্মরণ ও ইবাদত সজীব। তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনই জীবনের পরম প্রত্যাশা। মুমিনের ঘর হবে ঠিক এমনই। আল্লাহর প্রত্যাশাও বুঝি তা-ই। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা তাদের ঘরের ভিত্তি রেখেছে তাকওয়া ও আল্লাহর সন্তুষ্টির ওপর; তারা উত্তম, নাকি তারা যারা তাদের ঘরের ভিত্তি রেখেছে একটি ধ্বংসোন্মুখ খাদের কিনারে? যা তাকেসহ জাহান্নামের আগুনে পতিত হবে। আল্লাহ অবিচারকারীদের সত্য পথ দেখান না।’ (সুরা : তওবা, আয়াত : ১০৯)

আর যে ঘরে বিশ্বাসের সুবাস থাকবে না, আল্লাহর স্মরণ ও ইবাদতের প্রদীপ জ্বলবে না, সেই ঘরের পরিণতির কথাও আল্লাহ বলেছেন, অবিশ্বাসের আগুনে পুড়বে সেই ঘর, কষ্টের ভাঙা কাচে কাটবে হৃদয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘ঘর নির্মাণকারীদের ঘর তাদের অন্তরে সংশয় (কাঁটা) হয়ে থাকবে। যতক্ষণ না তাদের অন্তর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা : তওবা, আয়াত : ১১০) শুধু কি হৃদয় ছিন্নবিচ্ছিন্ন হবে, অশান্তির দাবানলে ছাই হবে জীবন। পার্থিব জীবনের কোনো উপায়-উপকরণ তার আশ্রয় হবে না, হতে পারবে না। নিরাশ্রয় জীবনে ঘুরপাক খাবে সে। তাহলে কি মুমিনের জীবনে পার্থিব প্রয়োজন উপেক্ষিত থাকবে? না, তার জাগতিক জীবনের সব আয়োজন তার ঘরেও হয়। তবে তা জীবনের লক্ষ্যে পরিণত হয় না। সে সন্তুষ্ট থাকে প্রয়োজন পূরণে, স্বস্তিকর জীবনে আর সন্তুষ্ট থাকে আল্লাহর সিদ্ধান্ত ও বণ্টনে। প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার পরিবারের সঙ্গে নিরাপদ থাকে, তার দেহ রোগমুক্ত থাকে, তার কাছে এক দিনের খাবার থাকে, তার জন্য পৃথিবীকে প্রশস্ত করা হয়েছে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৪৬)

যদিও কখনো মুমিন হৃদয় পারিপার্শ্বিকতায় প্রভাবিত হয়, নিজেকে বঞ্চিত বোধ করে, সে সঙ্গে সঙ্গে তার নবী, নবীর পরিবার ও সাহাবিদের জীবনের প্রতি তাকায়। সে দেখতে পায়, দোজাহানের বাদশাহও অভুক্ত দিন কাটিয়েছেন, অভুক্ত থেকে আল্লাহর দ্বিনের জন্য উত্তপ্ত মরুতে অবিরাম পথ চলেছেন তাঁর সাহাবিরা, তাঁর একান্ত আদরের কন্যা ফাতেমা (রা.)-এর জীবনে ছিল না কোনো বিলাসিতা; বরং অভাব ছিল তাঁর পরিবারের নিত্যসঙ্গী। অভাব-অভিযোগে রাসুল (সা.) তাঁর কন্যাকে পরকালের পাথেয় অর্জনের পথ বাতলে দিচ্ছেন। অল্প তুষ্টি ও মোহমুক্ত জীবনের যে দৃষ্টান্ত সে তাদের জীবনে খুঁজে পায়, তা তার হৃদয়কে প্রশান্ত করে, করণীয় ঠিক করে দেয়। তবে সে ভুলে যায় না, সাহাবিদের মধ্যে উচ্চ আশাও ছিল, সচ্ছল ও সমৃদ্ধ জীবনের জন্য তাঁরা পরিশ্রমও করতেন। অর্জিত সম্পদ ব্যয় করে নিজেদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের বহিঃপ্রকাশ করতেন। আবার কেউ এক হাতে উপার্জন করে অন্য হাতে বিলিয়ে দিতেন। আল্লাহ যার জন্য পৃথিবীকে প্রশস্ত করেছেন, সে কেন নিজের জীবনকে সংকীর্ণ করে তুলবে? এই প্রশ্ন স্বয়ং আল্লাহর। তিনি বলেছেন, ‘বলুন! আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যে সৌন্দর্য ও উত্তম জীবিকা দান করেছেন, তা কে হারাম করেছে?’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩২) অন্য আয়াতে বলেছেন, ‘অতঃপর তোমরা সেদিন অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে নিয়ামত সম্পর্কে।’ (সুরা : তাকাসুর, আয়াত : ৮)

সুতরাং মুসলমানের ঘর-পরিবারে আল্লাহর নিয়ামতের বহিঃপ্রকাশ থাকবে। সে সুন্দর ও স্বস্তিকর জীবন লাভের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জন করবে এবং তা নিঃসংকোচে ব্যয় করবে। তার সব কিছু হবে সুরুচিসম্পন্ন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘চারটি প্রাপ্তি সৌভাগ্যস্বরূপ : নেককার স্ত্রী, প্রশস্ত আবাস, উত্তম প্রতিবেশী ও উন্নত বাহন।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৪৪৮)

তিনি আরো বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর বান্দার জীবনে নিয়ামতের প্রকাশ দেখতে চান।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৮১৯)

তাই মুমিন অবশ্যই এই সৌভাগ্য থেকে বিমুখ থাকবে না। জীবনে নিয়ামতের প্রকাশ ঘটাতে দ্বিধা করবে না। তবে সম্পদ ও প্রাচুর্য মুমিনকে আল্লাহ থেকে বিমুখ করতে পারে না। শান্তি ও আরামের জীবনের জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে সে। কারণ সে আল্লাহর ঘোষণা সম্পর্কে অবগত। আল্লাহ বলেছেন, ‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা আদায় করো, তবে আমি অবশ্যই তা বৃদ্ধি করব। আর যদি তোমরা অস্বীকার করো (অকৃতজ্ঞ হও) তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি অতি কঠোর।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৭)

শুধু মনে মনে কৃতজ্ঞ হওয়াই যথেষ্ট নয়, তা মুখেও বলতে হবে। আল্লাহর নির্দেশ হলো, ‘আপনার প্রভুর নিয়ামতগুলো বর্ণনা করুন।’ (সুরা : দুহা, আয়াত : ১১)

শেষ কথায় বলতে পারি, মুমিন তার উভয় জীবন সুন্দর করতে প্রয়াসী হবে। তবে অবশ্যই পরকালকে প্রাধান্য দেবে। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রহ.) এ কথাই বলতে চেয়েছেন, ‘তুমি তোমার জাগতিক জীবনের জন্য এমনভাবে পরিশ্রম করো, যেন অনন্তকাল বাঁচবে। আর পরকালের জন্য এমনভাবে আমল করো, যেন কালই মারা যাবে।’