মুজিব ভাস্কর্য : আলোচনার মাধ্যমে সমাধান কতটা সম্ভব

মুজিব ভাস্কর্য : আলোচনার মাধ্যমে সমাধান কতটা সম্ভব

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে ভাস্কর্য নিয়ে যে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে এখন সরকার এবং ইসলামপন্থীরা-দুই পক্ষই আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা বলছে।হেফাজতে ইসলামের একজন নেতা বলেছেন, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চাইছেন তারা।সরকারের ধর্ম প্রতিমন্ত্রীও বলেছেন, আলোচনা করেই সমস্যার সমাধান হবে ।

ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া ইসলামপন্থী কয়েকটি দল এবং হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে সরকারের সাথে আলোচনায় বসার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।এই উদ্যোগে দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ বা কথাবার্তা চলছে।

তবে সরকার বা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ভাস্কর্য বিরোধীদের ওপর রাজনৈতিক দিক থেকেও একটা চাপ রাখার কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে।ঢাকার দক্ষিণে ধোলাইপাড় এলাকায় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে ইসলামপন্থী কয়েকটি দল এবং সংগঠন মাঠে নামে কয়েক সপ্তাহ আগে।

খেলাফত মজলিশ এবং ইসলামী আন্দোলন নামের দলগুলো এবং হেফাজতে ইসলাম সমাবেশ মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেছে।এসব দল বা সংগঠনের নেতারা এবং ইসলামী চিন্তাবিদরা মিলে ভাস্কর্য বিরোধী ফতোয়াও দিয়েছেন।এখন সরকারের সাথে আলোচনার কথা বললেও তারা ভাস্কর্য বিরোধী অবস্থানে অনড় রয়েছেন।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমমনারা রাজপথে সমাবেশ মিছিল অব্যাহত রেখে ভাস্কর্য বিরোধীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান তুলে ধরছে।দু'পক্ষই যখন যার যার অবস্থানে অনড় রয়েছে, তখন আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব কিনা-সেই প্রশ্নও রয়েছে।

'এটা আমাদের ধর্মীয় ইস্যু'

দেশে কওমী মাদ্রাসাগুলোর সবচেয়ে বড় শিক্ষাবোর্ড বেফাকের চেয়ারম্যান ছিলেন আহমদ শফী। তার মৃত্যুর পর বেফাকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন মাহমুদুল হাসান।

ভাস্কর্য বিরোধী ইসলামপন্থী একটি দলের নেতা জানিয়েছেন, সরকারের সাথে আলোচনার বা বৈঠকের সুযোগ সৃষ্টির জন্য মাহমুদুল হাসানকে তারা দায়িত্ব দিয়েছেন। সেই প্রেক্ষাপটে মি: হাসান উদ্যোগ নিয়েছেন সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সাথে কথাবার্তা বলতে।

তিনি আরও বলেছেন, তারা সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করতে চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক হলে ইসলামপন্থীদের পক্ষে কারা তাতে অংশ নেবেন, মাহমুদুল হাসান সেই তালিকাও তৈরি করছেন। তবে এর আগে সমাধানের একটা উপায় বের করতে এখন দু'একদিনের মধ্যে প্রাথমিকভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে তাদের বৈঠক হতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের এমনটা জানানো হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।মাহমুদুল হাসান বিবিসিকে বলেছেন, তারা আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করছেন।

হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র নায়েবে আমীর আব্দুর রব ইউসুফী বলেছেন, "আমাদের সাথে সরকারের যোগাযোগ হচ্ছে। এটা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হবে-তা আমরা বিশ্বাস করি।"

তবে তিনি ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানকেই তুলে ধরেন। একই সাথে অবশ্য তিনি বলেছেন, "আমরা সরকারকে বোঝাতে চাচ্ছি যে, এখানে বঙ্গবন্ধু ইস্যু নয়। বঙ্গবন্ধুর নামে কোন কিছু হোক, তাতে আমাদের আপত্তি নাই। কিন্তু ভাস্কর্য বা মূর্তি আমাদের ধর্মে নেই। এটা আমাদের ধর্মীয় ইস্যু। এই কথাটিই আমরা বলছি।"

ইসলামী আন্দোলনের আমীর সৈয়দ রেজাউল করীম তাদের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছেন, "ইসলাম বা শরিয়তের দৃষ্টিতে বিষয়টা কী-সেটা আমরা তুলে ধরেছি। এখন সরকার জনগণের মনোভাব বুঝে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু কোন কোন মহল আলেমদের বিরুদ্ধে নানা রকম বক্তব্য দিয়ে একটা অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে," তিনি মন্তব্য করেন।তিনিও মনে করেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সাথে বৈঠক হতে পারে।

আলোচনা নিয়ে সরকারের অবস্থান

ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক বিবিসির সাথে আলাপকালে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন।তিনি বলেছেন, ইসলামপন্থী দল এবং সংগঠনগুলোর আলোচনার প্রস্তাবে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো হয়েছে। এখন অনানুষ্ঠানিক আলোচনা বা যোগাযোগ হচ্ছে।

"আলোচনা হচ্ছে ওলামা মাশায়েখদের সাথে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান করবেন। এটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। বিতর্ক সৃষ্টির কোন সুযোগ নেই। যতটুকু হয়েছে, এটা আর বেশি কিছু হওয়ার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করিনা," বলেছেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী।ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত সোমবার ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের মহাপরিচালক ১২জন ইসলামী চিন্তাবিদের সাথে বৈঠক করে পরামর্শ নিয়েছেন। এর ভিত্তিতে ফাউণ্ডেশন একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা সরকারকে দেবে।

একজন সিনিয়র মন্ত্রীও বলেছেন, আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হতে পারে।একাধিক মন্ত্রীর সাথে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া যায়, যে উত্তপ্ত পরিস্থিতি হয়েছে, তা তারা আর বাড়তে দিতে চান না। কিন্তু শেখ মুজিবের ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধ করতেও সরকার রাজি নয়।

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশল

দলটির একাধিক সিনিয়র নেতা বলেছেন, ইসলামীপন্থী কয়েকটি দল এবং হেফাজতে ইসলাম হঠাৎ করে ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে কেন মাঠে নেমেছে, এর পেছনে রাজনৈতিক কোন উদ্দেশ্য আছে কিনা- এসব প্রশ্ন তাদের দলে উঠেছে।

এছাড়া তারা মনে করেন, তাদের আদর্শের প্রধান ভিত্তি শেখ মুজিবের ওপর আঘাত করা হয়েছে। এরই মাঝে কুষ্টিয়ায় শেখ মুজিবের নির্মাণাধীন একটি ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে প্রতিবাদ না করলে তাদের রাজনীতি প্রশ্নের মুখে পড়বে।আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ে এবং সিনিয়র নেতাদেরও একটা অংশ ভাস্কর্য বিরোধীদের সাথে কোন আলোচনায় না গিয়ে আইনগত এবং রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার পক্ষে বলে মনে হয়েছে।

দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, "ভাস্কর্য বিরোধিতার পেছনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির ভূমিকা রয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করি। উগ্রপন্থীরা মাঠে নেমেছে। এখানে তাদের সাথে আলোচনা করা ঠিক নয়।"ফলে সরকারে আলোচনার কথা যেমন রয়েছে, একইসাথে রাজনৈতিক এবং আইনগতভাবে এগুনোর কৌশলের ব্যাপারে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

কুষ্টিয়ায় ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনায় সন্দেহভাজন চারজনকে গ্রেপ্তারের পর আইনগতভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা সরকার বলেছে।অন্যদিকে আওয়ামী লীগ, তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো এবং শিক্ষক-সাংবাদিক-চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পেশায় থাকা তাদের সমর্থকরা সমাবেশ-মানববন্ধন করে প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন।দলটির নেতারা মনে করেন, অব্যাহত প্রতিবাদ কর্মসূচির মাধ্যমে তারা একটা রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে পেরেছেন। তাদের পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে আবার একটা ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে।

দুই পক্ষই যেখানে স্ব স্ব অবস্থানে অনড়

ভাস্কর্য বিরোধী ইসলামপন্থী দলগুলো যদিও সরকারের সাথে আলোচনায় বসার চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু তারা তাদের অবস্থানে অনড় রয়েছে।এই দলগুলোর পক্ষে কওমী মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান আলোচনার যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তার অংশ হিসাবে তিনি সোমবার প্রধানমন্ত্রী বরাবরে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। কিন্তু সেই চিঠিতেও তিনি লিখেছেন, "ইসলামে ভাস্কর্য নির্মাণ করা জায়েজ নয়।" তারা ঢাকার ধোলাইপাড়ে শেখ মুজিবের ভাস্কর্যের বিকল্প কিছু করার ব্যাপারে তাদের অবস্থানকেই তুলে ধরেন।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সোমবার সাংবাদিকদের বলেছেন, সেখানে শেখ মুজিবের ভাস্কর্য হবেই।এই অবস্থান থেকে আওয়ামী লীগ বা সরকার সরে এলে সেটা পরাজয় হবে বলে দলটির নেতাদের অনেকে মনে করেন।দুই পক্ষই স্ব স্ব অবস্থানে অনড় থাকার কারণে আলোচনায় সমাধান কতটা হবে-তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।ইসলাম নিয়ে লেখক ও গবেষক ওসমান গণি বলেছেন, দুই পক্ষকেই ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়ে আলোচনায় বসা উচিত।

তবে হেফাজতে ইসলামের অন্যতম নেতা আব্দুর রব ইউসফী বলেছেন, আলোচনায় বসলে একটা উপায় বের করা সম্ভব হবে বলে তারা মনে করছেন।সেই উপায় কিভাবে বের হবে এই প্রশ্নে তিনি আলোচনার আগে তিনি পরিষ্কার করে কিছু বলতে রাজি হননি।

ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনগুলো অব্যাহত কর্মসূচির মাধ্যমে রাজপথ দখলে রাখছে। তবে কোন উস্কানিমূলক পরিস্থিতি যাতে না হয়, সে ব্যাপারেও তারা সতর্ক বলে দলটির নেতারা বলেছেন।অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের নেতা আব্দুর রব ইউসুফী দাবি করেছেন, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান চান বলে তারা এখন মাঠে কোন কর্মসূচি নিচ্ছেন না। সূত্র : বিবিসি