বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়ে কেন পিছিয়ে পড়ছে ভারতীয় পাসপোর্ট

বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়ে কেন পিছিয়ে পড়ছে ভারতীয় পাসপোর্ট

ফাইল ছবি।

চলতি বছরের শুরুর দিকে এক ভারতীয় ‘ট্রাভেল ইনফ্লুয়েন্সার’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ভিডিও পোস্ট করেন।ভিডিওটি খুব দ্রুত ভাইরাল হয়। ভিডিওতে তিনি অভিযোগ করেন, ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশে সহজে ভিসা পাওয়া যায় না। ভারতের দুর্বল পাসপোর্ট নিয়ে অভিযোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশী দেশগুলো ভারতীয় পর্যটকদের স্বাগত জানালেও, বেশিরভাগ পশ্চিমা ও ইউরোপীয় দেশে ভিসা পাওয়া এখনও চ্যালেঞ্জ।

ওই ইনফ্লুয়েন্সারের অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হয়েছে নতুন হেনলে পাসপোর্ট ইনডেক্সে। এই ইনডেক্স কোন দেশের পাসপোর্ট দিয়ে কত দেশে ভিসা ছাড়া যাওয়া যায় তার র‍্যাংকিং করে। এই ইনডেক্স বা সূচক অনুযায়ী, বিশ্বের পাসপোর্ট র‌্যাংকিংয়ে ভারত গত বছরের তুলনায় ৫ ধাপ পিছিয়েছে। বর্তমানে ভারতের অবস্থান ১৯৯ দেশের মধ্যে ৮৫তম স্থানে।

ভারত সরকার এখনও এই প্রতিবেদন নিয়ে কোনও মন্তব্য করেনি। বিবিসি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করেছে।

রুয়ান্ডা, ঘানা ও আজারবাইজানের মতো দেশ— যাদের অর্থনীতি ভারতের তুলনায় অনেক ছোট (ভারত বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি)—তারা যথাক্রমে ৭৮তম, ৭৪তম ও ৭২তম স্থানে রয়েছে।

গত দশকে ভারতের র‍্যাংকিং ৮০-এর ঘরে ঘোরাফেরা করেছে। ২০২১ সালে এমনকি ৯০তম অবস্থানে নেমে গিয়েছিল। এটি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো এশীয় দেশগুলোর তুলনায় হতাশাজনক, যারা ধারাবাহিকভাবে শীর্ষে রয়েছে।

এ বছরও আগের মতোই সিঙ্গাপুর প্রথম স্থানে আছে। কারণ সেখানকার নাগরিকরা ১৯৩টি দেশে ভিসা-ফ্রি ভ্রমণ করতে পারেন। দক্ষিণ কোরিয়া দ্বিতীয় এবং জাপান তৃতীয় স্থানে রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ানরা ১৯০ দেশে এবং জাপানিরা ১৮৯ দেশে ভিসা-ফ্রি ভ্রমণ করতে পারেন।

ভারতীয় পাসপোর্টধারীরা ৫৭টি দেশে ভিসা-ফ্রি ভ্রমণ করতে পারেন—যা আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়ার সমান। দেশটি ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে ৮৫তম স্থানে রয়েছে।

পাসপোর্ট শক্তি একটি দেশের সফট পাওয়ার ও বৈশ্বিক প্রভাব প্রতিফলিত করে। এটি নাগরিকদের চলাচলের স্বাধীনতা বাড়ায়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করে। দুর্বল পাসপোর্ট মানে বেশি কাগজপত্র, বেশি ভিসা খরচ, কম ভ্রমণ সুবিধা ও দীর্ঘ অপেক্ষার সময়।

তবে র‍্যাংকিং কমলেও গত এক দশকে ভারতীয়দের জন্য ভিসা-ফ্রি গন্তব্যের সংখ্যা বেড়েছে।

২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসে। ওই বছর ৫২টি দেশে ভারতীয়রা ভিসা-ফ্রি ভ্রমণ করতে পারতেন। তখন ভারতের পাসপোর্ট র‍্যাংকিং ছিল ৭৬তম।

পরের বছর এটি ৮৫তম স্থানে নেমে আসে। পরে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে ৮০তম স্থানে উঠে এবং এ বছর আবার ৮৫তম স্থানে নেমে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর প্রধান কারণ হলো বৈশ্বিক গতিশীলতার প্রতিযোগিতা বাড়া। অর্থাৎ দেশগুলো নিজেদের নাগরিক ও অর্থনীতির সুবিধার্থে বেশি ভ্রমণ অংশীদারত্ব করছে। হেনলে অ্যান্ড পার্টনার্সের ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালে গড় ভিসা-ফ্রি গন্তব্য সংখ্যা ছিল ৫৮ যা ২০২৫ সালে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ১০৯ হয়েছে।

গত দশ বছরে চীনা নাগরিকদের ভিসা-ফ্রি গন্তব্য ৫০ থেকে বেড়ে ৮২ হয়েছে। এর ফলে চীনের র‍্যাংকিং ৯৪তম থেকে উঠে ৬০তম হয়েছে।

ভারত জুলাইয়ে ৫৯টি ভিসা-ফ্রি গন্তব্য নিয়ে ৭৭তম স্থানে ছিল। অক্টোবরে দুটি দেশে ভিসা-ফ্রি প্রবেশাধিকার হারিয়ে ৮৫তম স্থানে নেমে যায়। হেনলে ইনডেক্স প্রতি তিন মাস পরপর আপডেট হয়।

আরমেনিয়ায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত আচল মালহোত্রা বলেন, দেশের পাসপোর্ট শক্তির ওপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বিদেশিদের স্বাগত জানানোর নীতি প্রভাব ফেলে।

মালহোত্রা বলেন, ১৯৭০-এর দশকে ভারতীয়রা অনেক পশ্চিমা ও ইউরোপীয় দেশে ভিসা-ফ্রি ভ্রমণ করতে পারতেন। কিন্তু ১৯৮০-এর দশকে খালিস্তান আন্দোলনের পর তা বদলে যায়। পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা ভারতের স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তিতে আরও ক্ষতি করেছে।

তিনি বলেন, এছাড়া অনেক দেশ অভিবাসন নিয়ে আরও সতর্ক হচ্ছে। অনেক ভারতীয় বিদেশে গিয়ে ভিসার সময় শেষ হলেও ফিরে আসে না— এতে ভারতের ইমেজ খারাপ হয় এবং ভিসা পেতে সমস্যা বাড়ে।

ভারতের পাসপোর্ট এখনও নিরাপত্তা ঝুঁকিতে। ২০২৪ সালে দিল্লি পুলিশ ভিসা ও পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগে ২০৩ জনকে গ্রেফতার করেছে। ভারত জটিল ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া ও ধীর ভিসা প্রসেসিংয়ের জন্যও পরিচিত।

মালহোত্রা বলেন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ওই সমস্যা সমাধান করতে পারে। যেমন : ভারতে চালু হওয়া ই-পাসপোর্ট। এই পাসপোর্টে বায়োমেট্রিক তথ্যসহ মাইক্রোচিপ থাকে, যা জাল করা কঠিন।

তবে তার মতে, কূটনৈতিক উদ্যোগ ও ভ্রমণ চুক্তি বাড়ানোই ভারতীয়দের বৈশ্বিক চলাচল এবং পাসপোর্ট র‍্যাংকিং উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।