লকডাউন, নাকি কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ?

লকডাউন, নাকি কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ?

ছবি : সংগৃহীত

চলমান করোনা পরিস্থিতিতে সরকার সারা দেশে লকডাউন ঘোষণা করবে, নাকি কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে- বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়।

তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাক্কা সামাল দিতে সাময়িকভাবে এক সপ্তাহের 'লকডাউনের আদলে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে সরকার।

গতকাল শনিবার উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক শেষে এসংক্রান্ত বেশ কিছু সুপারিশসহ একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। প্রধানমন্ত্রী সায় দিলে আজ রবিবার প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। আর কাল সোমবার থেকে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে।

গতবারের চেয়ে এবার করোনার রূপ ভয়াবহ হলেও সাধারণ ছুটির কথা এখনই বিবেচনা করছেন না সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। আপাতত কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করার সুপারিশসংবলিত প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হচ্ছে।

সরকারের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, গতবারের সাধারণ ছুটির মতো এবারও যাতে সাধারণ ছুটি ঘোষণা না হয়, তার জন্য ব্যবসায়ী মহলের চাপ আছে। তারা যুক্তি দিচ্ছে, মহামারিতে সব বন্ধ করা সমাধান নয়। প্রথমবার বিশ্বব্যাপী বিষয়টি নতুন হওয়ায় বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি দেওয়া হয়। জরুরি সেবা, কাঁচাবাজার, নিত্যপণ্য ও ওষুধের দোকান ছাড়া সব কিছু বন্ধ রাখায় সেটা ‘লকডাউন’ বলা হয়েছিল। এরপর শিল্প-বাণিজ্যক্ষেত্রে সরকারের বিপুল ভর্তুকির কারণে বড় সমস্যা হয়নি। এবার আবারও সাধারণ ছুটিতে গেলে যে ক্ষতি হবে, তা পোষাতে সরকারের ভর্তুকি দেওয়ার সেই সক্ষমতা থাকবে না।

একজন কর্মকর্তা বলেন, গতবার সরকারের মজুদে প্রচুর চাল ছিল। সাধারণ ছুটি শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ত্রাণ বিতরণ অনেকটা স্বস্তি দিয়েছিল। এবার সরকারের হাতে প্রয়োজনীয় চাল নেই। রমজান উপলক্ষে ভিজিএফ কার্যক্রমের জন্য চালের বদলে টাকা দেওয়া হচ্ছে। তাই এখন ‘লকডাউনে’ গরিব মানুষ কিভাবে চলবে? সরকারকে বিষয়টি বড় করে ভাবতে হচ্ছে।

গতকাল বিকেলে এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদসচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি ভার্চুয়াল বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে ‘কঠোর নিষেধাজ্ঞার’ প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।

বৈঠকে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রায় সব কিছু গত বছরের মতোই হবে। তবে সাধারণ ছুটি হবে না।

বৈঠকে অংশ নেওয়া অন্য একজন কর্মকর্তা জানান, প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে সায় পেলে সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে। আপাতত এই সিদ্ধান্তই থাকতে পারে।

কেমন হতে পারে নিষেধাজ্ঞা : প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া প্রস্তাবে যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে আন্ত জেলা যান চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। জেলা থেকে ঢোকা বা বের হওয়ার পথে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চেকপোস্ট বসানোর ব্যবস্থা হবে। যেসব যান চলবে সেগুলোর ৫০ শতাংশ আসন খালি রাখতে হবে। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হতে পারবে না। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, ওষুধ, মৃতদের দাফন, সিকিউরিটি গার্ডসহ জরুরি কাজের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য পেশার মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাচল করতে পারবে।

মসজিদ মন্দিরসহ সব উপসনালয়ে ন্যূনতম উপস্থিতি ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। প্রতি ওয়াক্তের নামাজে পাঁচজন এবং জুমার নামাজে ১০ জনের উপস্থিতির প্রস্তাব করা হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বেচাকেনার ক্ষেত্রে উন্মুক্ত জায়গা বেছে নেওয়ার নির্দেশনা থাকছে। বেসরকারি আর্থিক সেবার সঙ্গে যুক্ত গাড়িসহ ব্যক্তিদের চলাচলে বাধা থাকবে না। তবে ব্যাংক খাতের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক পৃথক নির্দেশনা দেবে। এর বাইরে গণজমায়েত, সভা-সমাবেশ, সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিসকে তিন ভাগের এক ভাগ জনবল নিয়ে কাজ করতে হবে।

শপিং মল, মার্কেটের সময় বেঁধে দেওয়া হতে পারে। অফিস-আদালতে কাজ করতে হবে এক-তৃতীয়াংশ জনবল নিয়ে। এ নিষেধাজ্ঞা চলাকালে কোনো সরকারি কর্মচারীসহ বেসরকারি কর্মজীবীরাও তাঁদের কর্মস্থল ত্যাগ করতে পারবেন না। হাট-বাজার, শপিং মল সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, বিদ্যুৎ, পানি, ত্রাণ বিতরণ, জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, টেলিফোন, ইন্টারনেট, ডাকসেবা, হাসপাতাল, কৃষিপণ্য, সার, বীজ, খাদ্য, শিল্পপণ্য, রাষ্ট্রীয় প্রকল্পের মালামাল, নার্স, চিকিৎসক, কেবল নেটওয়ার্ককর্মী, গণমাধ্যমকর্মীদের পরিবহন ও চলাচলে স্বাস্থ্যবিধি মানলে বাধা থাকবে না। রপ্তানিমুখী শিল্পসহ সব শিল্প-কারখানা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বজায় রেখে চালু রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের খবর জানায় সরকার। এর ১০ দিনের মাথায় ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুর খবর জানানো হয়। এরপর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ২৩ মার্চ প্রথমবার ‘সাধারণ ছুটির’ ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। শুরুতে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করা হলেও পরে মেয়াদ বাড়ে কয়েক দফা।

সে সময় সব অফিস-আদালত, কল-কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ৩১ মের পর থেকে ধাপে ধাপে বিধি-নিষেধ শিথিল করতে থাকে সরকার। বছরের শেষে এসে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকা ছাড়া আর সব কড়াকড়িই উঠে যায়।

সাধারণ ছুটির আগে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর টোলারবাগে লকডাউন দেওয়া হয়। এরপর ছুটি চলার সময় সারা দেশকে লাল, হলুদ ও সবুজ জোনে ভাগ করে পরিস্থিতি অনুযায়ী লকডাউনের বিধি-নিষেধ আরোপের পরিকল্পনা হয়েছিল। পরীক্ষামূলকভাবে রাজাবাজার, ওয়ারীসহ কয়েকটি এলাকায় সেই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু পরে আর তা এগোয়নি।

নতুন বছরের শুরুতে দেশে সংক্রমণের হার অনেকটা কমে আসে। সারা দেশে শুরু হয় করোনাভাইরাসের গণটিকাদান। কিন্তু মার্চের শুরু থেকে দেশে আবার নতুন রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। গত শুক্রবার সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে ছয় হাজার ৮৩০ জনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে, যা মহামারি শুরুর পর থেকে সর্বোচ্চ। দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ২৪ হাজার ৫৯৪ জনে। আর তাদের মধ্যে মোট ৯ হাজার ১৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সংক্রমণের তীব্রতা দেখে গত ২৯ মার্চ সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়সহ সব ক্ষেত্রে সব ধরনের জনসমাগম সীমিত করাসহ ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করে সরকার। এরপর সেগুলো বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ও কড়াকড়ির ঘোষণা আসতে থাকে।

সূত্র: কালের কণ্ঠ