করোনাভাইরাস : বাংলাদেশে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে কি?

করোনাভাইরাস : বাংলাদেশে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে কি?

করোনাভাইরাস : বাংলাদেশে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে কি?

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস চিকিৎসায় রোগীদের অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে সম্প্রতি বেশ কয়েকজন চিকিৎসক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এদের মধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশী চিকিৎসক রয়েছেন, যারা বিভিন্ন পশ্চিমা দেশে কাজ করছেন।ব্রিটেনের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত আছেন বাংলাদেশী গোলাম রাহাত খান। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন।

করোনাভাইরাস মহামারীর এ সময়ে ডা: রাহাত খান অনলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু এবং পরিচিত অনেককে চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ দিয়েছেন। পরিচিতজনদের মধ্যে কোভিড আক্রান্ত অনেকেই হোয়াটস্অ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার ও স্কাইপে তার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছেন।

চিকিৎসক রাহাত খান বলেন, বাংলাদেশে রোগীদের সাথে কথা বলতে গিয়ে কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখেছেন যে এখানে অনেক ক্ষেত্রে কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ দেয়া হচ্ছে।

নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে রাহাত খান বলেন, ‘আমি দেখেছি কোভিড রোগীদের ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়, সেটা আমরা ব্রিটেনে একজন আইসিইউ পেশেন্টকে দিতে হলে মাইক্রোবায়োলজিস্টদের সাথে ১০ বার কথা বলি।’বাংলাদেশে কোভিড ১৯ রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ওষুধের যথেচ্ছ প্রয়োগ হচ্ছে বলে বিভিন্ন সময় রোগীর স্বজনদের কাছ থেকেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

এসব ওষুধ কতটা প্রয়োজন আছে সেটি নিয়ে খোদ ডাক্তারদের মধ্যেই মতভেদ রয়েছে।ওষুধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে বড় ধরণের পার্থক্যও তৈরি হচ্ছে বলে চিকিৎসার সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন।

গাইডলাইন কী বলে?
কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে সরকারিভাবে একটি ন্যাশনাল ক্লিনিকাল গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে।

কিভাবে রোগীদের চিকিৎসা দিতে হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে এই গাইডলাইনে। বাংলাদেশের প্রথম সারির চিকিৎসকদের অনেকে এই গাইডলাইন তৈরির সাথে সম্পৃক্ত।

গাইড লাইন তৈরির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ এবং সুপরিচিত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক টিটু মিয়া।অধ্যাপক টিটু মিয়া বলেন, যেসব রোগীর সর্দি, কাশি, জ্বর, গায়ে ব্যথা আছে কিন্তু অক্সিজেন স্যাচুরেশন স্বাভাবিক থাকে তারা বাড়িতে বসেই চিকিৎসা নিতে পারে। এ ধরণের রোগীর সংখ্যা ৮৫ শতাংশ। তাদের ক্ষেত্রে হাসপাতালে আসার কোনো প্রয়োজন নেই। তারা জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল এবং কাশির জন্য অ্যান্টি-হিসটামিন খেতে পারে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক মিয়া।

তারপরেও অনেক চিকিৎসক রোগীদের জন্য বাড়তি ভিটামিন এবং জিংক ট্যাবলেট খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু ন্যাশনাল গাইড লাইন অনুযায়ী ভিটামিন এবং জিংক ট্যাবলেট খাওয়ার কোনো পরামর্শ দেয়া হয়নি জাতীয় গাইডলাইনে।বাকি ১৫ শতাংশে রোগীর ক্ষেত্রে উপসর্গ মধ্যম থেকে জটিল হতে পারে। এই ১৫ শতাংশ রোগীর হাসপাতাল প্রয়োজন হয়। এদের অনেকের ক্ষেত্রে অক্সিজেন প্রয়োজন হয়।

অধ্যাপক টিটু মিয়া বলেন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য মূল চিকিৎসার জায়গা তিনটি। এগুলো হচ্ছে অক্সিজেন, স্টেরয়েড এবং ব্লাড থিনার।‘যারা হাসপাতালে ভর্তি হয় তাদের ক্ষেত্রে ব্লাড থিনার (রক্ত পাতলা করার ওষুধ) দিতে বলি। যাদের অক্সিজেন কমতে থাকে এবং অক্সিজেন সাপ্লিমেন্ট দরকার হয়, তাদের ক্ষেত্রে আমরা স্টেরয়েড ইনজেকশন দিই,’ বলেন তিনি।

ব্রিটেনের চিকিৎসক গোলাম রাহাত খানও অধ্যাপক টিটু মিয়ার সাথে একমত। ব্রিটেনেও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের জন্য এভাবেই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

রেমডেসেভির ও একটেমরা ওষুধ
এছাড়া রোগীর অবস্থা পর্যালোচনা করে রেমডেসেভির এবং একটেমরা নামক ইনজেকশন ব্যবহার হতে পারে বলে চিকিৎসকরা বলেছেন।কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য ব্যয় করতে যেয়ে অনেকে আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে জানা যায়, চিকিৎসকরা রেমডেসেভির ওষুধ প্রয়োগ করছেন। রেমডেসেভির ব্যয়বহুল ওষুধ।অধ্যাপক টিটু মিয়া বলেন, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সব রোগীর ক্ষেত্রে রেমডেসেভির ওষুধ প্রয়োগ করার প্রয়োজন নেই।

‘রেমডেসেভির ইনজেকশন তাদেরই দেয়া হয় যাদের অক্সিজেন কনসেন্ট্রেশন কমতে থাকে। সেক্ষেত্রে তাদের একটা খরচের ব্যাপার থাকে। সাধারণত পাঁচ থেকে ছয়টা ইনজেকশন লাগে।’কারো কারো ক্ষেত্রে রেমডেসেভির ইনজেকশন ১০ দিনও প্রয়োজন হতে পারে বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক মিয়া।

অধ্যাপক টিটু মিয়ার সাথে একমত পোষণ করে ব্রিটেনের চিকিৎসক গোলাম রাহাত খান বলেন, রোগীদের বাঁচানোর ক্ষেত্রে রেমেডেসেভির ওষুধের কোনো ভূমিকা নেই। রেমডেসেভির রোগীর হাসপাতালে অবস্থানের সময় কমিয়ে আনে।উভয় চিকিৎসক বলেন, যেসব রোগীর ফুসফুসে কিছুটা সংক্রমণ থাকে এবং যাদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন ধীরে ধীরে কমতে থাকে, তাদের ক্ষেত্রে রেমডেসেভির দিতে হয়। কিন্তু অক্সিজেন স্যাচুরেশন ব্যাপকভাবে কমে গেলে রেমডেসেভির দিয়ে লাভ নেই।

আরেকটি ব্যয়বহুল ওষুধ আছে 'একটেমরা'। যেসব রোগীর ক্ষেত্রে এ ওষুধ প্রয়োগ করতে হয় তাদের খরচ অনেক বেড়ে যায়।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চিকিৎসক বলেন, অনেক বেসরকারি হাসপাতালে 'একটেমরা' ওষুধটি প্রয়োগ করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে।

অধ্যাপক টিটু মিয়া বলেন, বিষয়টি এ রকম হওয়ার কথা নয়। কারণ, বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে অনেক অভিজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। তিনি বলেন, রোগীর অবস্থা পর্যালোচনা করে এই ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে।‘রোগী যখন ক্রিটিকাল থাকে, রোগী যখন হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলাতে থাকে। পাশাপাশি রোগীর রক্তে কিছু পরিবর্তন হয়। পাশাপাশি রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমতে থাকে, তখন সাধারণত একটেমরা দেয়া যেতে পারে,’ বলেন অধ্যাপক মিয়া।

কিন্তু একটেমরা ইনজেকশন প্রয়োজন হতে পারে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে পাঁচ শতাংশের। কিন্তু একটেমরা ইনজেকশন দিলেই যে রোগী ভালো হয়ে যাবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা।সিটি স্ক্যান আরেকটি খরচের জায়গা। অধ্যাপক টিটু মিয়া বলেন, যারা হাসপাতালে ভর্তি হয় তাদের ক্ষেত্রে সিটি স্ক্যান একবার করলেই চলে।

পরবর্তী সময়ে ফলোআপ চিকিৎসার জন্য এক্সরে করলেই চলে। এছাড়া ফলোআপ চিকিৎসার জন্য ১২ সপ্তাহ পরে সিটি স্ক্যানের পরামর্শ দেয়া হয়।ব্রিটেনের চিকিৎসক গোলাম রাহাত খান বলেন, রোগীদের টেস্ট করানো এবং ঔষধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্রিটেনে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়।


সূত্র : বিবিসি