দীর্ঘ প্রায় দু’যুগ পর দক্ষিণ-পশ্চিমা অঞ্চলের ৫ জেলায় খাবার পানির সংকট

দীর্ঘ প্রায় দু’যুগ পর দক্ষিণ-পশ্চিমা অঞ্চলের ৫ জেলায় খাবার পানির সংকট

খুলনা অঞ্চলের নদীগুলোতে পানি সংকটের কারণে এসব এলাকার মানুষের মধ্যে পানির অভাব দেখা দিয়েছে- সংগৃহীত ছবি

খুলনা বিভাগ জুড়েই খাবার পানির সংকট চলছে । তবে পাঁচটি জেলা কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, চুয়াডাঙা ও মাগুরায় তীব্র সংকট। তবে এর আগে এসব জেলায় এত বেশি পানির সংকট দেখা যায়নি। এর আগে এ সংকট উপকূলের জেলাগুলোতে ছিল। এবার উপকূল ছাড়াও দিন দিন অন্যত্রে পানির অভাব দেখা দিয়েছে। অনেকে বলছেন,‘ প্রায় দু’যুগ আড়াই যুগ আগে এইসব এলাকায় এ ধরণের পানির সংকট হয়েছিল।’

খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীরা জানান,‘উপকূল জেলাগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে পানির সংকট চললেও এবার সংকট দেখা দিয়েছে পদ্মা বেষ্টিত-গড়াই বিধৌত মিঠা পানির জেলাগুলোতেও। মার্চের শুরু থেকে এই সংকট দেখা দেয় উল্লেখিত জেলাসমূহে। অবশ্য দীর্ঘদন বৃষ্টি না হওয়ায় এই সংকট বলে এই কর্মকর্তা জানান। খুলনা বিভাগে অর্থাৎ দক্ষিণ-পশ্চিমা লে প্রায় ৮ মাস ধরে বৃষ্টির স্বাভাবিক মৌসুমেও বৃষ্টির দেখা নেই। ফলে পুরো অ ল জুড়েই পানির স্তর এলাকা ভেদে ২শ’ থেকে ৪শ’ ফুট পর্যন্ত নেমে গেছে। ইতোমধ্যে শুষ্ক মৌসুমের গড় স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ৭৮ ভাগ খাবার পানির জলাশয়গুলো শুকিয়ে গেছে। নলকূপগুলোও অকেজো হয়ে গেছে বলে তিনি উল্লেখ করেণ।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলগণ বলছেন, নদী-বিধৌত জেলায় পানির স্তর ২৫০ ফুটের স্তর থেকে আরও প্রায় ৩২ ফুট অর্থাৎ ২৮২ ফুট নিচে নেমে গেছে। ফলে এলাকাসমূহে সাধারণ নলকূপের পানি উৎপাদন ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ কমে গেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও পানি বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, বিভাগের নদীগুলোতেও মৌসুমের এই সময়টাতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ অনেক কমে গেছে। একই সঙ্গে নিয়ম না মেনে একটির কাছাকাছি একাধিক সাব-মার্সিবল পাম্প বসানোয় পানির স্তর নিচে নেমে এ সংকট তৈরি হওয়ার আরেকটি কারণ।

ঝিনাইদহ জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, এসব অ লে সাধারণত: পানির সংকট হয় না। তবে এবার পানি ওঠছে তুলনামূলক কম।’

ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ  পৌর এলাকার চাঁপালী গ্রামের সোহরাব হোসেন জানান,তারসহ অধিকাংশ মোটরে পানি ওঠছে কম। আবার কোন কোন জায়গায় একেবারেই পানি ওঠছে না বলে জানান তিনি।

একই জেলার হরিনাকুন্ডু উপজেলার আদর্শ-আন্দুলিয়া গ্রামের মূখলেছুর রহমান লাড্ডু জানান,‘আমার টিউবওলে পানি ওঠাতে মাথার ঘাম পায়ে পড়ছে। পানি পাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তাদের পুরো এলাকায় অনুরূপ অবস্থা বলে তিনি জানান’। এ ধরণের পানির সংকট প্রায় দু’যুগ আড়াই যুগ আগে হয়েছিল বলে লাড্ডু জানান।

কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলজি বিভাগের নিবার্হী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম জানান, কুষ্টিয়াসহ আশেপাশের ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, চুয়াডাঙা, মাগুরা অঞ্চল জুড়ে পানির স্তর স্বাভাবিক পর্যায়ে ধরে রাখতে সাহায্য করে পদ্মা ও গড়াইয়ের প্রবাহ। এই প্রবাহ থেকে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প গঙ্গা-কপোতাক্ষ’র (জিকে) ১ হাজার ৬৫৫ কিলোমিটার খালের মধ্য দিয়ে এই জেলাগুলোর ভেতরে প্রবাহিত হয়ে থাকে। এই প্রকল্পের ঘণ্টায় প্রায় ১৫৩ কিউসেক পানি সরবরাহের ক্ষমতা আছে। যা এই অ লের প্রাকৃতিক পানি স্তরের ৬৮ শতাংশ পূরণ করে। সেজন্যই এসব জেলায় পানি সংকট কখনোই সেভাবে দেখা দেয়নি। কিন্তু এবার পদ্মা-গড়াইয়ে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক নেই। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, পদ্মার উজানে গঙ্গা থেকে পানির প্রবাহ যথেষ্ট জোড়ালো না হওয়ায় পদ্মায় পানি সংকটের বিরূপ প্রভাব পড়েছে পদ্মার শাখা গড়াইয়ের ওপর।

হাইড্রোলজি বিভাগের তথ্যানুযায়ী ১ মার্চ শুষ্ক মৌসুমের শুরু থেকেই গঙ্গার পানি ভাগাভাগিতে সমস্যা সৃষ্টি হয়। ঐতিহাসিক গঙ্গা পানি চুক্তির অনুযায়ী পদ্মা নদীতে সর্বনিম্ন ৩৫ হাজার কিউসেক পানির আধার থাকার পরিবর্তে কখনো কখনো তা ২৩ হাজার কিউসেকে নেমে আসে। এর ফলে কয়েক দফা বন্ধ হয়ে যায় জিকের পানি সরবরাহ যা দীর্ঘ হয় প্রায় ২০ দিন। আবার বোরো মৌসুমের পানি সরবরাহ শেষ হওয়ার কারণে গত ১ মে থেকে জিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ রেখেছে পানি উত্তোলন। যা চালু হবে আগামীকাল রোববার (১৬ মে)।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী ইব্রাহীম মোঃ তৈমুর বলেন, পানির স্তর নেমে যাওয়ার পেছনে যত্রতত্র সাবমার্সিবল (গভীর নলকুপ) পাম্প বসানোও দায়ী। তিনি বলেন, পৌর এলাকায় পাইপ লাইনের সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল হলে এ সমস্যা এতো প্রকট হতো না। কিন্তু সরবরাহ পর্যাপ্ত না হওয়ায় মানুষ সাবমার্সিবল পাম্প বসিয়েছে। শহর এলাকায় একের পর এক পাম্প বসিয়ে ভূগর্ভ থেকে পানি তুলে আনায় স্তর দিনে দিনে নামছে। ভালো মতো বৃষ্টি না হলে এ সমস্যার সমাধান হবে না বলে তিনি উল্লেখ করেণ।

কথা হয় মাগুরা জেলা জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা আসলাম আল হাসান এর সাথে। তিনি জানান, ‘স্বাভাবিক সময়ে পানির স্তর মাটির ১৬ ফুট নিচে থাকে। কিন্তু উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় পানির স্তর বর্তমানে ২৫ থেকে ৪০ ফুট নিচে নেমে যাওয়ায় নলকূপে পানি উঠছে না’।
কুষ্টিয়া পৗর কর্তৃপক্ষ বলছে, গড়াইয়ে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি পানির স্তর গত কয়েক বছরের তুলনায় ৩২ ফুট নেমে যাওয়ায় হস্ত চালিত নলকূপ ও পাম্পে উঠছে না পানি। 

কুষ্টিয়া পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, সাধারণত ২৪ ফুট নিচে পর্যন্ত পানির স্তর থাকলে এই শহরে নলকুপ দিয়ে পানি ওঠে। পৌরসভা থেকেই এই শহরে বসানো আছে ৪ হাজার ৩শ’ টিউবওয়েল। নাগরিকরা এর বাইরে নিজ উদ্যোগেও বসিয়েছে। এখানে ঠিকমতো পানি উঠছে না। 

পৌরসভার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, পানির লেয়ার নিচে থাকায় পানির উৎপাদন ক্ষমতাও  ৫০ ভাগ কমে গেছে। তিনি বলেন, আধা ঘণ্টা পানি তুললেই স্তর নিচে চলে যাচ্ছে, আর পানি উঠছে না। 

খুলনা বিভাগীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী  মোঃ জামানুর রহমান নিউজজোনকে শনিবার (১৫ মে ) মোবাইলে বলেন, খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় গ্রীষ্ম মৌসুম শুরু হতে না হতেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানির স্তর আরও কমছে। গত ৫ বছরে খুলনা ল জুড়ে ৩ ফিটের বেশি পানির লেয়ার নিচে নেমে গেছে বলে এই কর্মকর্তা জানান।