কুরবানির হুকুম

কুরবানির হুকুম

কুরবানির হুকুম-

জাকেরুল্লাহ আবুল খায়ের-

কুরবানির হুকুম কি? ওয়াজিব না সুন্নত? এ বিষয়ে ইমাম ও ফকীহদের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে এবং তাদের দুটো মত রয়েছে।

প্রথম মত: কুরবানি ওয়াজিব। ইমাম আওযায়ী, ইমাম লাইস, ইমাম আবু হানীফা রহ. প্রমুখের মত এটাই। আর ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ রহ. থেকে একটি মত বর্ণিত আছে যে তারাও ওয়াজিব বলেছেন।

দ্বিতীয় মত: কুরবানি সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। এটি অধিকাংশ আলেমের মত এবং ইমাম মালেক ও শাফেয়ী রহ.-এর প্রসিদ্ধ মত। কিন্তু এ মতের প্রবক্তারা আবার বলেছেন: সামর্থ্য থাকা অবস্থায় কুরবানি পরিত্যাগ করা মাকরূহ। যদি কোনো জনপদের লোকেরা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সম্মিলিতভাবে কুরবানি পরিত্যাগ করে তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। কেননা, কুরবানি হল ইসলামের একটি শি‘য়ার বা মহান নিদর্শন।

যারা কুরবানি ওয়াজিব বলেন তাদের দলিল:

[এক] আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন:—

﴿ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنۡحَرۡ ٢ ﴾ [الكوثر: ٢]

‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং (পশু) কুরবানি কর।’ [সূরা কাউছার, আয়াত: ২] আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ পালন ওয়াজিব।

[দুই] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:—

«من وجد سعة ولم يضح، فلا يقربن مصلانا ». رواه أحمد وابن ماجه، وصححه الحاكم.

‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে।’ [আহমদ, ইবনু মাজাহ: ৩৫১৬]

যারা কুরবানি পরিত্যাগ করে তাদের প্রতি এ হাদিস একটি সতর্ক-বাণী। তাই কুরবানি ওয়াজিব।

[তিন] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:—

«يا أيها الناس: إن على كل أهل بيت في كل عام أضحية ». . رواه أحمد وابن ماجه، حسنه الألباني

হে মানব সকল ! প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্ব হল প্রতি বছর কুরবানি দেয়া। [ইবনু মাজাহ: ৩১২৫]

আর যারা কুরবানি দেওয়া সুন্নত বলেন তাদের দলিল হচ্ছে:

[এক] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:—

«إذا رأيتم هلال ذي الحجة، وأراد أحدكم أن يضحي، فليمسك عن شعره وأظفاره، حتى يضحي ». رواه مسلم

‘তোমাদের মাঝে যে কুরবানি করতে চায়, যিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর সে যেন কুরবানি সম্পন্ন করার আগে তার কোনো চুল ও নখ না কাটে।’ [মুসলিম: ১৯৭৭]

এ হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ‘যে কুরবানি করতে চায়’ কথা দ্বারা বুঝে আসে এটা ওয়াজিব নয়।

[দুই] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতের মাঝে যারা কুরবানি করেনি তাদের পক্ষ থেকে কুরবানি করেছেন। তার এ কাজ দ্বারা বুঝে নেয়া যায় যে কুরবানি ওয়াজিব নয়। শাইখ ইবনে উসাইমীন রহ. উভয় পক্ষের দলিল-প্রমাণ উল্লেখ করার পর বলেন: এ সকল দলিল-প্রমাণ পরস্পর বিরোধী নয় বরং একটা অন্যটার সম্পূরক।

সারকথা হল যারা কুরবানিকে ওয়াজিব বলেছেন তাদের প্রমাণাদি অধিকতর শক্তিশালী। আর ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মত এটাই[মাজমূ ফাতাওয়া ৩২/১৬২-১৬৪] আর বর্তমান কালের শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালেহ উসাইমীন এ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

কুরবানির ফযিলত

[] কুরবানি দাতা নবী ইবরাহিম আ. ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শ বাস্তবায়ন করে থাকেন।

[খ] পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কুরবানি দাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য অর্জন করেন। যেমন- আল্লাহ তা‘আলা বলেন:—

﴿لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقۡوَىٰ مِنكُمۡۚ كَذَٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمۡ لِتُكَبِّرُواْ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمۡۗ وَبَشِّرِ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٣٧﴾ [الحج : ٣٧]

‘আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন; সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন মুহসিনদেরকে।’ [সূরা হজ, আয়াত: ৩৭]

[] পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও অভাবীদের আনন্দ দান। আর এটা অন্য এক ধরনের আনন্দ যা কুরবানির গোশতের পরিমাণ টাকা যদি আপনি তাদের সদকা দিতেন তাতে অর্জিত হত না। কুরবানি না করে তার পরিমাণ টাকা সদকা করে দিলে কুরবানি আদায় হবে না।

কুরবানির শর্তাবলি:

[১] এমন পশু দ্বারা কুরবানি দিতে হবে যা শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেগুলো হল উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা। এ গুলোকে কুরআনের ভাষায় বলা হয় ‘বাহীমাতুল আন‘আম।’ যেমন, আল্লাহ বলেন:—

﴿ وَلِكُلِّ أُمَّةٖ جَعَلۡنَا مَنسَكٗا لِّيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۗ ٣٤ ﴾ [الحج : ٣٤]

‘আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানির নিয়ম করে দিয়েছি; তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর উপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’[সূরা হজ, আয়াত: ৩৪] হাদিসে এসেছে:—

عن جابر- رضى الله عنه- قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم:لا تذبحوا إلا مسنة، إلا أن تعسر عليكم، فتذبحوا جذعة من الضأن. [رواه مسلم]

জাবের রা. হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমরা অবশ্যই এক বছরের বয়সের ছাগল কুরবানি করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষ-শাবক কুরবানি করতে পার”। [মুসলিম, হাদিস: ১৯৩৬]

আর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ছাড়া অন্য কোনো জন্তু কুরবানি করেননি ও কুরবানি করতেও বলেননি। তাই কুরবানি শুধু এগুলো দিয়েই করতে হবে। ইমাম মালিক রহ.-এর মতে কুরবানির জন্য সর্বোত্তম জন্তু হল শিং ওয়ালা সাদা-কালো দুম্বা। কারণ রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরনের দুম্বা কুরবানি করেছেন বলে বুখারি ও মুসলিমের হাদিসে এসেছে। উট ও গরু-মহিষে সাত ভাগে কুরবানি দেয়া যায়। যেমন হাদিসে এসেছে—

عن جابر- رضى الله عنه- أنه قال: نحرنا بالحديبية مع النبي صلى الله عليه وسلم البدنة عن سبعة، والبقرة عن سبعة.

জাবের রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমরা হুদাইবিয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলাম। তখন আমরা উট ও গরু দ্বারা সাত জনের পক্ষ থেকে কুরবানি দিয়েছি।’ [ইবনে মাজাহ্‌: ৩১৩২]

গুণগত দিক দিয়ে উত্তম হল কুরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশত সম্পন্ন, নিখুঁত, দেখতে সুন্দর হওয়া।

[২] শরিয়তের দৃষ্টিতে কুরবানির পশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরি। উট পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু বা মহিষ দু বছরের হতে হবে। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা হতে হবে এক বছর বয়সের।

[৩] কুরবানির পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটি মুক্ত হতে হবে। যেমন হাদিসে এসেছে:—

عن البراء بن عازب- رضى الله عنه- قال: قام فينا رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال: «أربع لا تجوز في الأضاحي،- وفي رواية: تجزىء – العوراء البين عورها، والمريضة البين مرضها، والعرجاء البين ضلعها، والكسيرة التي لا تنقى ». [رواه الترمذي وفي رواية النسائي] ذكر [العجفاء] بدل [الكسيرة] وصححه الألباني في صحيح سنن النسائي

সাহাবি আল-বারা ইবনে আযেব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন তারপর বললেন: চার ধরনের পশু, যা দিয়ে কুরবানি জায়েয হবে না। অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে পরিপূর্ণ হবে না—অন্ধ; যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত; যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু; যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং আহত; যার কোনো অঙ্গ ভেঙ্গে গেছে। নাসায়ির বর্ণনায় ‘আহত’ শব্দের স্থলে ‘পাগল’ উল্লেখ আছে। [তিরমিযি, হাদিস: ১৫৪৬, নাসায়ী: ৪৩৭১]

আবার পশুর এমন কতগুলো ত্রুটি আছে যা থাকলে কুরবানি আদায় হয় কিন্তু মাকরূহ হবে। এ সকল দোষত্রুটি যুক্ত পশু কুরবানি না করা ভাল। সে ত্রুটিগুলো হল শিং ভাঙ্গা, কান কাটা, লেজ কাটা, ওলান কাটা, লিঙ্গ কাটা ইত্যাদি।

[] যে পশুটি কুরবানি করা হবে তার উপর কুরবানি দাতার পূর্ণ মালিকানা সত্ত্ব থাকতে হবে। বন্ধকি পশু, কর্জ করা পশু বা পথে পাওয়া পশু দ্বারা কুরবানি আদায় হবে না।

কুরবানির ওয়াক্ত বা সময়:

কুরবানি নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পর্কিত একটি ইবাদত। এ সময়ের পূর্বে যেমন কুরবানি আদায় হবে না তেমনি পরে করলেও আদায় হবে না।

যারা ঈদের সালাত আদায় করবেন তাদের জন্য কুরবানির সময় শুরু হবে ঈদের সালাত আদায় করার পর থেকে। যদি ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে কুরবানির পশু যবেহ করা হয় তাহলে কুরবানি আদায় হবে না। যেমন হাদিসে এসেছে—

عن البراء بن عازب -رضى الله عنه- قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يخطب فقال: «إن أول ما نبدأ به من يومنا هذا، أن نصلى ثم نرجع فننحر، فمن فعل هذا فقد أصاب سنتنا، ومن نحر قبل أن يصلي فإنما هو لحم قدمه لأهله، ليس من النسك في شيء ». [رواه البخاري]

আল-বারা ইবনে আযেব রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি শুনেছি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুতবাতে বলেছেন: এ দিনটি আমরা শুরু করব সালাত দিয়ে। অতঃপর সালাত থেকে ফিরে আমরা কুরবানি করব। যে এমন আমল করবে সে আমাদের আদর্শ সঠিকভাবে অনুসরণ করল। আর যে এর পূর্বে যবেহ করল সে তার পরিবারবর্গের জন্য গোশতের ব্যবস্থা করল। কুরবানির কিছু আদায় হল না। [বুখারি: ৯৬৫]

সালাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে কুরবানি পশু যবেহ না করে সালাতের খুতবা দুটি শেষ হওয়ার পর যবেহ করা ভাল। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রকম করেছেন। হাদিসে এসেছে—

قال جندب بن سفيان البجلي -رضى الله عنه-: صلى النبى صلى الله عليه وسلم يوم النحر، ثم خطب ثم ذبح ... ]رواه البخاري [

সাহাবি জুনদাব ইবনে সুফিয়ান আল-বাজালী রা. বলেছেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানির দিন সালাত আদায় করলেন অতঃপর খুতবা দিলেন তারপর পশু যবেহ করলেন। [বুখারি, হাদিস: ৯৮৫]

عن جندب بن سفيان قال: شهدت النبي صلى الله عليه وسلم يوم النحر قال: «من ذبح قبل أن يصلي فليعد مكانها أخرى، ومن لم يذبح فليذبح.» [رواه البخاري]

জুনদুব ইবনে সুফিয়ান বলেন, আমি কুরবানির দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলাম। তিনি বললেন, যে ব্যক্তি নামাজের পূর্বে যবেহ করেছে সে যেন আবার অন্য স্থানে যবেহ করে। আর যে যবেহ করেনি সে যেন যবেহ করে। [বুখারি, হাদিস: ৫৫৬২]

আর কুরবানির সময় শেষ হবে যিলহজ মাসের তেরো তারিখের সূর্যাস্তের সাথে সাথে। অতএব কুরবানির পশু যবেহ করার সময় হল চার দিন। যিলহজ মাসের দশ, এগারো, বার ও তেরো তারিখ। এটাই উলামায়ে কেরামের নিকট সর্বোত্তম মত হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ:

এক. আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন:—

﴿ لِّيَشۡهَدُواْ مَنَٰفِعَ لَهُمۡ وَيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ فِيٓ أَيَّامٖ مَّعۡلُومَٰتٍ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُم مِّنۢ بَهِيمَةِ ٱلۡأَنۡعَٰمِۖ ٢٨ ﴾ [الحج : ٢٨]

‘যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদের চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিজিক হিসেবে দান করেছেন তার উপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে।’ [সূরা আল-হজ, আয়াত: ২৮]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারি রহ. বলেন: ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন: ‘এ আয়াতে নির্দিষ্ট দিনগুলো বলতে বুঝায় কুরবানির দিন ও তার পরবর্তী তিন দিন।’

অতএব এ দিনগুলো আল্লাহ তা‘আলা কুরবানির পশু যবেহ করার জন্য নির্ধারণ করেছেন।

দুই. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:—

كل أيام التشريق ذبح. [رواه أحمد، صححه الألباني في السلسلة الصحيحة]

‘আইয়ামে তাশরীকের প্রতিদিন যবেহ করা যায়।’[বর্ণনায় আহমদ, হাদিস: ৪/৮২] আইয়ামে তাশরীক বলতে কুরবানির পরবর্তী তিন দিনকে বুঝায়।

তিন. কুরবানির পরবর্তী তিন দিনে সওম পালন জায়েয নয়। এ দ্বারা বুঝে নেয়া যায় যে এ তিন দিনে কুরবানি করা যাবে।

চার. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘আইয়ামে তাশরীক হল খাওয়া, পান করা ও আল্লাহর জিকির করার দিন।’

এ দ্বারা বুঝে নিতে পারি যে, যে দিনগুলো আল্লাহ খাওয়ার জন্য নির্ধারণ করেছেন সে দিনগুলোতে কুরবানির পশু যবেহ করা যেতে পারে।

পাঁচ. সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত হয়, কুরবানির পরবর্তী তিনদিন কুরবানির পশু যবেহ করা যায়।

ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন: আলী ইবনে আবি তালেব রা. বলেছেন: ‘কুরবানির দিন হল ঈদুল আজহার দিন ও তার পরবর্তী তিন দিন।’ অধিকাংশ ইমাম ও আলেমদের এটাই মত। যারা বলেন, কুরবানির দিন হল মোট তিন দিন; যিলহজ মাসের দশ, এগারো ও বার তারিখ, বার তারিখের পর যবেহ করলে কুরবানি হবে না, তাদের কথার সমর্থনে কোনো প্রমাণ নেই ও মুসলিমদের ঐক্যমত্য [ইজমা] প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

মৃত ব্যক্তির পক্ষে কুরবানি

মূলত কুরবানির প্রচলন জীবিত ব্যক্তিদের জন্য। যেমন আমরা দেখি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সাহাবিগণ নিজেদের পক্ষে কুরবানি করেছেন। অনেকের ধারণা কুরবানি শুধু মৃত ব্যক্তিদের জন্য করা হবে। এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। তবে মৃত ব্যক্তিদের জন্য কুরবানি করা জায়েয ও একটি সওয়াবের কাজ। কুরবানি একটি সদকা। আর মৃত ব্যক্তির নামে যেমন সদকা করা যায় তেমনি তার নামে কুরবানিও দেয়া যায়।

যেমন মৃত ব্যক্তির জন্য সদকার বিষয়ে হাদিসে এসেছে—

عن عائشة- رضى الله عنها- أن رجلا أتى النبى صلى الله عليه وسلم فقال يا رسول الله: إن أمي افتلتت نفسها ولم توصى، وأظنها لو تكلمت تصدقت، أفلها أجر إن تصدقت عنها ؟ قال: « نعم » . [رواه البخاري ومسلم]

আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত: এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল—হে রাসূল! আমার মা হঠাৎ মারা গেছেন। কোনো অসিয়ত করে যেতে পারেন নি। আমার মনে হয় তিনি কোনো কথা বলতে পারলে অসিয়ত করে যেতেন। আমি যদি এখন তার পক্ষ থেকে সদকা করি তাতে কি তার সওয়াব হবে ? তিনি উত্তর দিলেন: হ্যাঁ। [বুখারি: ১৩৩৮,২৭৬০, মুসলিম: ১০৪]

মৃত ব্যক্তির জন্য এ ধরনের সদকা ও কল্যাণমূলক কাজের যেমন যথেষ্ট প্রয়োজন ও তেমনি তা তাঁর জন্য উপকারী।

এমনিভাবে একাধিক মৃত ব্যক্তির জন্য সওয়াব প্রেরণের উদ্দেশ্যে একটি কুরবানি করা জায়েয আছে। অবশ্য যদি কোনো কারণে মৃত ব্যক্তির জন্য কুরবানি ওয়াজিব হয়ে থাকে তাহলে তার জন্য পূর্ণ একটি কুরবানি করতে হবে।

অনেক সময় দেখা যায়, ব্যক্তি নিজেকে বাদ দিয়ে মৃত ব্যক্তির জন্য কুরবানি করেন। এটা মোটেই ঠিক নয়। ভাল কাজ নিজেকে দিয়ে শুরু করতে হয় তারপর অন্যান্য জীবিত ও মৃত ব্যক্তির জন্য করা যেতে পারে। যেমন হাদিসে এসেছে—

عن عائشة وأبي هريرة -رضى الله عنهما- أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان إذا أراد أن يضحي، اشترى كبشين عظيمين سمينين أقرنين أملحين موجوئين، [مخصيين] فذبح أحدهما عن أمته، لمن شهد لله بالتوحيد، وشهد له بالبلاغ، وذبح آخر عن محمد، وعن آل محمد- صلى الله عليه وسلم- . [صحيح ابن ماجة [صححه الألباني]

আয়েশা রা. ও আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কুরবানি দিতে ইচ্ছা করলেন তখন দুটো দুম্বা ক্রয় করলেন। যা ছিল বড়, হৃষ্টপুষ্ট, শিং ওয়ালা, সাদা-কালো বর্ণের এবং খাসি। একটি তিনি তার ঐ সকল উম্মতের জন্য কুরবানি করলেন; যারা আল্লাহর একত্ববাদ ও তার রাসূলের রিসালাতের সাক্ষ্য দিয়েছে, অন্যটি তার নিজের ও পরিবার বর্গের জন্য কুরবানি করেছেন। [ইবনে মাজা, হাদিস: ২৫৩১]

মৃত ব্যক্তি যদি তার সম্পদ থেকে কুরবানি করার অসিয়ত করে যান তবে তার জন্য কুরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যাবে।

অংশীদারির ভিত্তিতে কুরবানি করা কুরবানি:

যাকে ‘শরীকে কুরবানি দেয়া’ বলা হয়।

ভেড়া, দুম্বা, ছাগল দ্বারা এক ব্যক্তি একটা কুরবানি করতে পারবেন। আর উট, গরু, মহিষ দ্বারা সাত জনের পক্ষ থেকে সাতটি কুরবানি করা যাবে। ইতোপূর্বে জাবের রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদিস দ্বারা এটা প্রমাণিত হয়েছে।

অংশীদারি ভিত্তিতে কুরবানি করার দুটি পদ্ধতি হতে পারে:

[এক] সওয়াবের ক্ষেত্রে অংশীদার হওয়া। যেমন কয়েক জন মুসলিম মিলে একটি বকরি ক্রয় করল। অতঃপর একজনকে ঐ বকরির মালিক বানিয়ে দিল। বকরির মালিক বকরিটি কুরবানি করল। যে কজন মিলে বকরি খরিদ করেছিল সকলে সওয়াবের অংশীদার হল।

[দুই] মালিকানার অংশীদারির ভিত্তিতে কুরবানি। দু জন বা ততোধিক ব্যক্তি একটি বকরি কিনে সকলেই মালিকানার অংশীদার হিসেবে কুরবানি করল। এ অবস্থায় কুরবানি শুদ্ধ হবে না। অবশ্য উট, গরু ও মহিষের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি জায়েয আছে।

মনে রাখতে হবে কুরবানি হল একটি ইবাদত ও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য লাভের উপায়। তাই তা আদায় করতে হবে সময়, সংখ্যা ও পদ্ধতিগত দিক দিয়ে শরিয়ত অনুমোদিত নিয়মাবলী অনুসরণ করে। কুরবানির উদ্দেশ্য শুধু গোশত খাওয়া নয়, শুধু মানুষের উপকার করা নয় বা শুধু সদকা [দান] নয়। কুরবানির উদ্দেশ্য হল আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের একটি মহান নিদর্শন তার রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে আদায় করা।

তাই, আমরা দেখলাম কীভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোশতের বকরি ও কুরবানির বকরির মাঝে পার্থক্য নির্দেশ করলেন। তিনি বললেন যা সালাতের পূর্বে যবেহ হল তা বকরির গোশত আর যা সালাতের পরে যবেহ হল তা কুরবানির গোশত।

কুরবানি দাতা যে সকল কাজ থেকে দূরে থাকবেন:

যখন কেউ কুরবানি পেশ করার ইচ্ছা করে আর যিলহজ মাস প্রবেশ করে। তার জন্য চুল, নখ অথবা চামড়ার কোনো অংশ কাটা থেকে বিরত থাকবে, যতক্ষণ না কুরবানি করবে।

হাদিসে এসেছে—

عن أم سلمة- رضى الله عنها- أن النبي- صلى الله عليه وسلم- قال: « إذا رأيتم هلال ذي الحجة، وأراد أحدكم أن يضحي، فليمسك عن شعره وأظفاره» . [رواه مسلم] وفي رواية له: « فلا يمس من شعره وبشره شيئا » ، وفي رواية: حتى يضحي.

উম্মে সালামাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তোমাদের মাঝে যে কুরবানি করার ইচ্ছে করে সে যেন যিলহজ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে। ইমাম মুসলিম হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। তার অন্য একটি বর্ণনায় আছে—‘সে যেন চুল ও চামড়া থেকে কোনো কিছু স্পর্শ না করে। অন্য বর্ণনায় আছে ‘কুরবানির পশু যবেহ করার পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থায় থাকবে।’[ মুসলিম: ১৯৭৭]

কুরবানি দাতার পরিবারের লোক জনের নখ, চুল ইত্যাদি কাঁটাতে কোনো সমস্যা নেই।

কোন কুরবানি দাতা যদি তার চুল, নখ অথবা চামড়ার কোনো অংশ কেটে ফেলে তার জন্য উচিৎ তাওবা করা, পুনরাবৃত্তি না করা, তবে এ জন্য কোনো কাফফারা নেই এবং এ জন্য কুরবানিতে কোনো সমস্যা হবে না। আর যদি ভুলে, অথবা না জানার কারণে অথবা অনিচ্ছাসত্বে কোনো চুল পড়ে যায়, তার কোনো গুনাহ হবে না। আর যদি সে কোনো কারণে তা করতে বাধ্য হয়, তাও তার জন্য জায়েয, এ জন্য তার কোনো কিছু প্রদান করতে হবে না। যেমন নখ ভেঙ্গে গেল, ভাঙ্গা নখ তাকে কষ্ট দিচ্ছে সে তা কর্তন করতে পারবে, তদ্রূপ কারো চুল লম্বা হয়ে চোখের উপর চলে আসছে সেও চুল কাটতে পারবে অথবা কোনো চিকিৎসার জন্যও চুল ফেলতে পারবে।

কুরবানি দাতা চুল ও নখ না কাটার নির্দেশে কি হিকমত রয়েছে এ বিষয়ে উলামায়ে কেরাম অনেক কথা বলেছেন। অনেকে বলেছেন: কুরবানি দাতা হজ করার জন্য যারা এহরাম অবস্থায় রয়েছেন তাদের আমলে যেন শরিক হতে পারেন, তাদের সাথে একাত্মতা বজায় রাখতে পারেন।

ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেছেন: ‘কুরবানি দাতা চুল ও নখ বড় করে তা যেন পশু কুরবানি করার সাথে সাথে নিজের কিছু অংশ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কুরবানি [ত্যাগ] করায় অভ্যস্ত হতে পারেন এজন্য এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’ যদি কেউ যিলহজ মাসের প্রথম দিকে কুরবানি করার ইচ্ছা না করে বরং কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর কুরবানির নিয়ত করল সে কি করবে? সে নিয়ত করার পর থেকে কুরবানির পশু যবেহ পর্যন্ত চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকবে।

গ্রন্থঃযিলহজ মাসের প্রথম দশ দিন, ঈদ, কুরবানি ও আইয়ামে তাশরীকের দিনসমূহ।