বর্তমান পরিস্থিতিতে কোরবানি

বর্তমান পরিস্থিতিতে কোরবানি

বর্তমান পরিস্থিতিতে কোরবানি

কোরবানি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং দীনের একটি নিদর্শন। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর এ কঠিন সময়ে কিভাবে কোরবানি আদায় করা যেতে পারে সে সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা পেশ করা হলো :

কোরবানির বিধান : ইসলামে কোরবানির বিধান তথা শরয়ি মর্যাদা নিয়ে আলিমরা দুটি মত ব্যক্ত করেছেন :

১. ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম যুফার, রবিআহ, লাঈস ইবন সাআদ, ইমাম আওযায়ী, সুফিয়ান ছাওরির মতে কোরবানি ওয়াজিব। এ ব্যাপারে ইমাম মালিক ও ইমাম আবু ইউসুফের দুটি করে মত পাওয়া যায়, তার মধ্যে একটি মত অনুযায়ী কোরবানি ওয়াজিব। এটাকে হানাফি মাজহাবের সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। তারা কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার পক্ষে যেসব দলিল পেশ করেন তার মধ্যে রয়েছে :

ক. মহান আল্লাহর বাণী, তুমি তোমার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করো ও কোরবানি দাও। (সূরা আল-কাওছার: ২)। এ আয়াতের তাফসিরে এসেছে, তুমি ঈদের নামাজ আদায় করো ও কোরবানি প্রদান করো। এখানে আল্লাহ আদেশসূচক শব্দ ব্যবহার করেছেন; যা সাধারণভাবে আবশ্যকতার হুকুম রাখে। আর রাসূল সা: এর জন্য আবশ্যক হলে তা উম্মতের জন্যও আবশ্যক।

খ. মহানবী সা. এর বাণী, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানি করে না সে যেন আমাদের সাথে ঈদগাহে না আসে’ (ইবনু মাজাহ)। হাদিসটিতে কোরবানি পরিত্যাগকারীদের বিরুদ্ধে কঠিন সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছে, এ ধরনের সতর্কবার্তা সাধারণত ওয়াজিব পরিত্যাগকারীদের ব্যাপারেই দেয়া হয়।

গ. রাসূলুল্লাহ সা:-এর বাণী, ‘যে ব্যক্তি (ঈদের) সালাতের আগে কোরবানি করেছে সে যেন (সালাতের পরে) তার পরিবর্তে পুনরায় একটি ছাগী জবেহ করে, পক্ষান্তরে যারা এখনো জবেহ করেনি তারা যেন আল্লাহর নামে জবেহ করে’ (সহিহ মুসলিম)। এ হাদিস থেকেও কোরবানি ওয়াজিব হওয়া প্রমাণিত হয়।

২. ইমাম মালিকের অধিকতর নির্ভরযোগ্য মত, ইমাম আবু ইউসুফের দুটি অভিমতের একটি এবং শাফিয়ি ও হাম্বলি মাজহাবের সিদ্ধান্ত মতে কোরবানি সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। হজরত আবু বকর, উমর, বিলাল, আবু মাসউদ রা: এবং তাবেয়িগণের মধ্যে সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, আতা, আলকামা প্রমুখ এ মত পোষণ করতেন। তাদের দলিল :

ক. রাসূলুল্লাহ সা:-এর বাণী, ‘যখন জিলহজ মাসের প্রথম দশক শুরু হবে এবং তোমাদের কেউ যদি কোরবানি করাতে চায় সে যেন তার চুল ও নখ না কাটে’ (মুসলিম)। এ হাদিসে ‘কোরবানি করাতে চায়’ দ্বারা প্রতীয়মান হয় কোরবানি করা বা না করার এখতিয়ার আছে, যদি এটা ওয়াজিব হতো তবে এ ধরনের এখতিয়ার থাকত না।

খ. ইমাম বায়হাকি বর্ণনা করেছেন, আবু বকর ও উমর রা: এক দুই বছর পরে পরে কোরবানি করতেন এই আশঙ্কায় যে অন্যরা এটাকে ওয়াজিব মনে না করে।

কোরবানির ধরন : হানাফি মাজহাব অনুযায়ী প্রত্যেক সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর কোরবানি ওয়াজিব। অতএব একই পরিবারে একাধিক ব্যক্তি যদি সামর্থ্যবান হয় তবে প্রত্যেককে আলাদা আলাদা কোরবানি করতে হবে। একটি ছাগল, ভেড়া, দুম্বা বা গরুর ৭ ভাগের ১ ভাগ দ্বারা শুধু ১ জনের কোরবানি আদায় হবে। পক্ষান্তরে অন্যান্য ফকিহ কোরবানিকে সামষ্টিক কর্তব্য বিবেচনা করেছেন, এ জন্য তাদের মতে, একটি পরিবারের পক্ষ থেকে একটি কোরবানিই যথেষ্ট।

তারা তাদের মতের পক্ষে হাদিস থেকে প্রমাণ পেশ করেন। আবু আইয়ুব আল-আনসারী রা: বলেন, আমরা একটি ছাগল দ্বারা কোরবানি করতাম যা ব্যক্তি তার নিজের ও নিজ পরিবারের পক্ষ থেকে জবেহ করত (মুয়াত্তা মালেক)। এ সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা: ঈদুল আজহার দিন পরপর দুটি বকরি জবেহ করেন।

প্রথমটির ব্যাপারে বলেন, এটি আমার ও আমার পরিবারের পক্ষ থেকে এবং দ্বিতীয়টির ব্যাপারে বলেন, এটি আমার উম্মতের পক্ষ থেকে (মুসনাদে আহমদ)। তবে এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানি দিলে কোরবানিদাতাকে অবশ্যই সবার পক্ষ থেকে দেয়ার নিয়্যাত করতে হবে অন্যথায় সবাই সওয়াবের ভাগি হবেন না।

বর্তমান পরিস্থিতিতে কিভাবে কোরবানি আদায় করা যাবে?

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতে কোরবানির পশু ক্রয়ের জন্য বাজারে গমন, জবেহ, প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি জনসমাগম এড়িয়ে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পালন করা কষ্টকর হলে সে ক্ষেত্রে আমরা নিম্নোক্ত পন্থা অবলম্বন করতে পারি :

১. মধ্যপ্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্রের মতো সরকারি ব্যবস্থাপনায় অথবা সরকার অনুমোদিত সংস্থার অধীনে নাম রেজিস্ট্রেশন করে কোরবানি করা যেতে পারে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে এ কাজ সম্পন্ন করবে, ফলে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
অথবা

২. ইসলাম মানুষের কল্যাণ বিবেচনা করে ও কোরবানির বিধান পালনের সুবিধার্থে যেহেতু জিলহজ মাসের ১০, ১১, ১২ এ তিন দিন (কোনো কোনো মত অনুযায়ী চার দিন অর্থাৎ ১৩ তারিখ পর্যন্ত) কোরবানি আদায় করার সুযোগ দিয়েছে সেহেতু সবাই ১০ তারিখে একত্রে ভিড় না করে বরং প্রত্যেক এলাকাকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিভক্ত করে পর্যায়ক্রমে ১০-১২ তারিখের মধ্যে কোরবানি সম্পন্ন করা যেতে পারে;
অথবা

৩. মাজহাবি মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে প্রত্যেক পরিবারের পক্ষ থেকে ১টি ছাগল, ভেড়া কোরবানির মাধ্যমে ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত পালন করা। এ ক্ষেত্রে যেসব পরিবারে একাধিক কোরবানি দেয়ার প্রয়োজন ছিল তারা তাদের কোরবানির জন্য বাজেটের বাকি টাকা গরিব-অসহায় ও কর্মহীন মানুষকে দিয়ে তাদের আহার ও মানবিক প্রয়োজন পূরণে সাদকাহ করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, গত বছর যে পরিবারে এক লাখ টাকার গরু কোরবানি করেছিলেন তারা এ বছর সীমিত পরিসরে একটি ছাগল কোরবানি করলেন। ছাগলের মূল্য হয়তো ১০ হাজার টাকা। বাকি ৯০ হাজার টাকা তখন সাদকাহ হিসেবে দান করতে পারবেন।

কোরবানির নির্ধারিত দিনগুলোতে কোরবানি করতে না পারলে ওই অর্থ সাদকাহ করার বিধান আলেমগণের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সাধারণ অবস্থায় কোরবানি না করে সে অর্থ দান করা যাবে না, বরং কোরবানিই করতে হবে। কেননা কোরবানি ওয়াজিব, কারো কারো মতে সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। পক্ষান্তরে দান-সাদকাহ নফল। কোনো নফল ওয়াজিব বা সুন্নাতের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। তাছাড়া কোরবানির ব্যাপারে সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহের নির্দেশ রয়েছে।

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবি, তাবিঈ, তাবে তাবিঈগণের কেউ কোরবানি না করে সে অর্থ দান-সাদকাহ করেছেন মর্মে কোনো প্রমাণ নেই। উপরন্তু, শরিয়তের প্রতিটি বিধানের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য থাকে যাকে মাকাসিদুশ শরিয়াহ বলা হয়। কোরবানির বিধানের ক্ষেত্রে সে উদ্দেশ্য হলো, অসহায়-দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নততর খাদ্যের (হালাল ও পবিত্র গোশত) সংস্থান করা। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কোরবানির পশুর গোশত খাও ও নিঃস্ব ফকিরদের খাওয়াও’ (সূরা আল-হাজ: ২৮)।

এ কারণে ফকিহগণ তাদের গ্রন্থে কোরবানিদাতা কর্তৃক কোরবানির গোশত সংরক্ষণ করে রাখার বিপক্ষে আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। অথচ কোরবানির পরিবর্তে সমপরিমাণ অর্থ দান করলে সে উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না। তথাপি হানাফি মাজহাবে জটিল পরিস্থিতির কারণে যদি কোরবানি আদায় করা সম্ভব না হয় এবং কোরবানির নির্দিষ্ট তিন দিন অতিবাহিত হয়ে যায় তবে কোরবানির পশুর সমপরিমাণ অর্থ সাদকাহ করার অভিমত বর্ণিত হয়েছে। যদিও অন্যান্য মাজহাবের ইমামগণ এ ব্যাপারে মতভেদ করেছেন।

হানাফি মাজহাবের প্রামাণ্য গ্রন্থ আল-হিদায়াহ এর প্রণেতা ইমাম মারগিনানী বলেন, ‘যদি সে কোরবানি না করে থাকে এমতাবস্থায় কোরবানির দিনগুলো অতিবাহিত হয়ে যায় তবে কেউ যদি কোরবানি নিজের জন্য আবশ্যক করে নেয় (যেমন মানতের কোরবানি) অথবা গরিব হয় সে যদি কোরবানির পশু ক্রয় করে থাকে তবে ওই পশুটিই জীবিত দান করে দেবে; পক্ষান্তরে যদি সে ধনী হয় তবে পশু ক্রয় করুক বা না করুক সে ছাগলের মূল্য পরিমাণ অর্থ সাদকাহ করবে’ (আল-হিদায়াহ, কোরবানি অধ্যায়, ৪/৩৫৮)।

অতএব এ মাজহাব মতে, একেবারে নিরুপায় হলে এ সুযোগটি গ্রহণ করা যেতে পারে; আর সে ক্ষেত্রে কোরবানির জন্য বাজেটের পুরো অর্থই সাদকাহ করা উত্তম হবে। আশা করা যায় আল্লাহ তার পক্ষ থেকে এটি কবুল করবেন।

মহান আল্লাহই সমধিক জ্ঞাত।

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন তালুকদার : অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।