নামাজে খুশু-খুজু অর্জন

নামাজে খুশু-খুজু অর্জন

নামাজে খুশু-খুজু অর্জন

খুশু-খুজু হলো নামাজের প্রাণ। ইবাদতের মধ্যে স্থিরতা অবলম্বন করা হলো ‘খুশু’। আর ইবাদতটি একাগ্রতাসহকারে আদায় করার নাম ‘খুজু’। খুশুর আভিধানিক অর্থাৎ বিনয়, স্থিরতা, মিনতি ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায় এর অর্থ হলো অন্তরে বিনয় ও স্থিরতা থাকা। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর কল্পনাকে অন্তরে ইচ্ছাকৃতভাবে উপস্থিত না করা এবং অঙ্গপ্রতঙ্গকে স্থির রাখা, সেগুলোকে অযথা নাড়াচাড়া না করা (বয়ানুল কুরআন)।

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমে সূরা মুমিনুনে মুমিনদের স্পেশাল ১০টি গুণাবলির মধ্যে প্রথমেই বলেছেন যে, ‘মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে, যারা নিজেদের নামাজে খুশু অবলম্বনকারী’(সূরা মুমিনুন : ১-২)।
খুশু-খুজুর দুটি অংশ রয়েছে : এক. নামাজে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্থির রাখা। দুই. মনোযোগ ও একাগ্রতা রক্ষা করা।

এক. বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ স্থির রাখা : খুশু-খুজু সম্পর্কে হাদিস শরিফে হজরত আবুজর রা: থেকে বর্ণিত রাসূলে আকরাম সা: ইরশাদ করেন, ‘নামাজের সময় আল্লাহ তায়ালা বান্দার প্রতি সর্বক্ষণ দৃষ্টি নিবন্ধ রাখেন, যতক্ষণ নামাজি অন্য দিকে ভ্রক্ষেপ না করে। কিন্তু নামাজি অন্য দিকে ভ্রক্ষেপ করলে আল্লাহ তায়ালা তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন’ (সুনানে নাসায়ি, সুনানে আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ-২১৫০৮)।এ প্রসঙ্গে অপর একটি হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম সা: একদা এক ব্যক্তিকে নামাজে দাড়ি নিয়ে খেলা করতে দেখে বললেন, ‘এই ব্যক্তির অন্তরে যদি খুশু থাকত, তাহলে তার অঙ্গপ্রতঙ্গ স্থির থাকত’ (মাজহারি)।

আম্মাজান আয়েশা রা: বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:কে জিজ্ঞেস করেছি যে, নামাজে এদিক সেদিক তাকানোর ব্যাপারে আপনি কী বলেন? জবাবে তিনি বলেছেন, ‘এটা হলো শয়তানের ছোঁ মারা, যা দ্বারা শয়তান আল্লাহর বান্দাদেরকে নামাজ থেকে গাফেল ও উদাসীন করে ফেলে’ (সহিহ বুখারি, হাদিস-৭৫১)।

দুই. নামাজে মনোযোগ ও একাগ্রতা রক্ষা করা :

ক. এমন মনোভাব নিয়ে নামাজ আদায় করা যে, এটিই তার জীবনের শেষ নামাজ।বিশিষ্ট সাহাবি আবু আইয়ুব আনসারী রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলে আকরাম সা:-এর কাছে এসে বলল, আল্লাহর রাসূল! আমাকে সংক্ষিপ্তভাবে দ্বীনের কিছু কথা বলে দিন। জবাবে রাসূলে আকরাম সা: বললেন, তুমি যখন নামাজ পড়ো তখন জীবনের শেষ নামাজ আদায়কারীর মতো নামাজ পড়ো’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস-৪৭১)।

খ. পুরো নামাজ এ অনুভূতি নিয়ে আদায় করা যে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে দেখছেন, আমি তার সামনে দণ্ডায়মান।
প্রসিদ্ধ হাদিসে-জিবরিলে এসেছে, রাসূলে আকরাম সা: বলেছেন, ‘তুমি এমনভাবে ইবাদত করো যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ। আর তুমি যদি আল্লাহকে না-ও দেখো তবে আল্লাহ তো তোমাকে অবশ্যই দেখছেন’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস-৮)।

গ. সাথে সাথে এ খেয়াল করবে যে, আমি আল্লাহ তায়ালার সম্মুখে দাঁড়িয়েছি এবং তাঁর সাথে কথা বলছি। কেননা, নামাজ হলো আল্লাহ তায়ালার সাথে একান্তে কথোপকথন করা।

সহিহ বুখারিতে এসেছে, সাহাবি আনাস ইবনে মালেক রা: থেকে বর্ণিত রাসূলে আকরাম সা: বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন নামাজে দাঁড়ায় তখন সে আল্লাহর সাথে একান্তে কথা বলে; যতক্ষণ সে তার নামাজের জায়গায় থাকে’ (সহিহ বুখারি-৪১৬)
খুশু-খুজু অর্জনের কিছু কার্যকর পন্থা : ইবাদতের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়া অন্য কিছু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা না করা খুশু-খুজুর জন্য সহায়ক। তবে অনিচ্ছাকৃতভাবে মনে যেটা আসে, সেটার জন্য বান্দা দায়ী নয়। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য কিছু মনে করা যাবে না এবং মন কখনো অন্যত্র চলে গেলে স্মরণ হওয়া মাত্রই নামাজে নিয়ে আসতে হবে।

সেই সাথে নামাজে অন্তঃকরণকে আল্লাহমুখী করার ব্যাপারে ইমাম গাজ্জালি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিলে নামাজের প্রাণ পূর্ণ হয় ।

১. হুজুরে কালব বা অন্তরের উপস্থিতি : এটা হচ্ছে মানুষ যে কাজ করে এবং যে কথা বলে, সেটি ব্যতীত অন্যান্য কাজ ও কথা থেকে মনকে মুক্ত রাখা। এর দ্বারা অন্তরের উপস্থিতি হাসিল হয়।

২. ফাহম বা কালামের অর্থ বোঝা : এটা কিন্তু অন্তরের উপস্থিতি থেকে পৃথক। কেননা, অনেক অন্তর শব্দের সাথে উপস্থিত থাকে কিন্তু অর্থের সাথে উপস্থিত থাকে না। তাই ফাহমের লক্ষ্য হচ্ছে অন্তরে শব্দের অর্থ অনুধাবন করা, যাতে অর্থের সাথেও অন্তর উপস্থিত থাকে। আর ফাহমের আরেকটি দিক লক্ষণীয় হলো কালামের অর্থ অনুধাবন করলে নামাজ খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।

৩. তাজিম তথা শ্রদ্ধা : এটি অন্তরের উপস্থিতি ও ফাহম থেকে পৃথক। কেননা, মানুষ যখন তার খাদেমের সাথে কথা বলে, তখন অন্তরও হাজির থাকে এবং নিজের কথার অর্থও বুঝে; কিন্তু খাদেমের তাজিম করে না। এ থেকে বোঝা গেল, তাজিম হুজুরে কালব ও ফাহমের ঊর্ধ্বে। তাই মহান আল্লাহর কাছে তাজিম বা শ্রদ্ধাবোধ রেখে মনকে তাঁর দিকে নিবিষ্ট করতে হবে। তাতেই মন ইতমিনান হবে এবং খুশু-খুজুও অর্জন হবে (এহইয়াউ উলুমিদ্দিন,পৃষ্ঠা-১৪৪)।

পরিশেষে বলা যায়, এমনি করে মহান আল্লাহর কাছে দেহ ও মন নিয়ে আত্মসমর্পণ করাই হচ্ছে খুশু-খুজুর একমাত্র লক্ষ্য। নামাজ মহান আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় ও যথাযথ মূল্যায়িত হওয়ার জন্য খুশু-খুজু অর্জন একান্তভাবে জরুরি।


জাহাঙ্গীর আলম ইব্রাহীম : খতিব, বড়চাঁদপুর পূর্বপাড়া জামে মসজিদ, সরসপুর, মনোহরগঞ্জ, কুমিল্লা ।