সাইবার বুলিং ও ইসলাম

সাইবার বুলিং ও ইসলাম

সাইবার বুলিং ও ইসলাম

বুলিং হলো তিক্ত বা কটু কথা। সাইবার বুলিং মানে কোনো ব্যক্তিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হেয় প্রতিপন্ন করার অয়োজন; যা ভীতি ও মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, অর্থ হাতিয়ে নেয় ও অনৈতিক কাজে বাধ্য করে। ইন্টারনেটের জোয়ারে গা ভাসিয়ে ক্ষণিকের জন্য আনন্দ অনুভব করলেও, অসচেতন ব্যবহারকারী নিজের জীবনে ডেকে আনে ঘোর অন্ধকার। মুহূর্তেই গোপনীয় সব কর্মকাণ্ডের চিত্র ভাইরাল হয়ে, ব্যবহারকারীর কাছে পৃথিবীর আবহাওয়া তিক্ত ও বিষাদে ভারী হয়ে আসে। অনেকেই হতাশার কালো ছায়ায় ডুবে আত্মহত্যার পথ ধরে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা নিজেরা নিজদের হত্যা করো না।’ (সূরা নিসা, আয়াত-২৯)

সাইবার বুলিং একটি জঘন্য অপরাধ। সাইবার অপরাধ ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের চেয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে আঘাত করে, যার ফলে জীবন হয়ে পড়ে তুফানের কবলে পড়া নৌকার মাঝির মতো। নৌকার মাঝি হাল শক্ত হাতে ধরে নিজেকে শঙ্কামুক্ত করলেও, সংশোধনের চেষ্টায় মানুষের সাথে কঠোরতার প্রদর্শন করলে, সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। কিন্তু ভালোবাসার চাদরে আবৃত করে, আঁধার গুছিয়ে দেয়া যায়; খুব সহজে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর ভালো ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দকে প্রতিহত করো তা দ্বারা যা উৎকৃষ্টতর, ফলে তোমার ও যার মধ্যে শত্রুতা রয়েছে সে যেন হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু।’ (সূরা হা-মিম, আয়াত-৩৪)

ডায়েটবিহীন প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। সুবিশাল মরুভূমিতে পথ হারালে মৃত্যু নিশ্চিত। একইভাবে ইন্টারনেটের অন্তহীন দুনিয়ার ফাঁদে আটকা পড়ে, বহু মানুষ হতাশার বাহুবাঁধনে বন্দী হয়ে, রৌদ্রের মাঝে এক ফালি মেঘ যেমন চঞ্চল ছুটোছুটি করে; সেই জীবন ছেড়ে হিমালয়ে শীতল হয়ে বসে থাকে। লোকলজ্জার ভয়ে কেউ আত্মহত্যায় সমাধান খুঁজে। করোনা মহামারীতে গৃহবন্দী হয়ে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী নিজেদের আত্মনিয়ন্ত্রণহীন হয়ে অদৃশ্য খাদে পড়েছে। নিজেদের আত্মার উন্নয়নের জন্য আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় সালাত অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে।’ (সূরা আনকাবুত, আয়াত-৪৫)

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টুইটার, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ হাতড়ে কূলে ভিড়বার ফুরসত অনেকের হয় না, তার আগেই হারিয়ে যায় সমুদ্রে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশের তিন-চতুর্থাংশ নারীই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। ইউনিসেফের সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ৩৮ শতাংশ ১০-১৩ বছর বয়সের, ৩৬ শতাংশ ১৪-১৫ বছর এবং ১৬-১৭ বছর বয়সী ২৫ শতাংশ। এর আগে তরুণ-তরুণীদের মধ্যেই কিছুটা সীমাবদ্ধ থাকলেও, বর্তমানে করোনা মহামারীর সাথে পাল্লা দিয়ে সাইবার বুলিং আঘাত করেছে, রঙে ভরা যৌবন থেকে শুরু করে মরীচিকা ধরা বৃদ্ধকে।

বক পাখির মতো লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে দুর্বল স্থানে আঘাত করে, মেসেজ, ই-মেইলে বাক্যবিস্ফোরণ, অশ্লীল ছবি বা ভিডিও প্রেরণ করে; বয়সে কাঁচা তরুণীদের অনেকেই দেখা মাত্র চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করে। আবার অধিকাংশই আগ্রহী ও কৌতূহলপ্রবণ হয়ে ফাঁদে আটকা পড়ে। তারপর কখনো মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, আপত্তিকর প্রস্তাব ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রলুব্ধ হতে বাধ্য করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় যারা এটা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ুক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জানো না।’ (সূরা নূর, আয়াত-১৯)

প্রযুক্তির উৎকর্ষ দিনে দিনে বেড়েই চলছে। আর মানুষের সব কাজে ইন্টারনেট-নির্ভর হয়ে পড়ছে। করোনায় মানুষ গৃহবন্দী হওয়ায় ইন্টারনেট ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণে। সাইবার অপরাধীরা নতুন নতুন প্রতারণার ফাঁদ এঁটে বসে আছে, মানুষদের সহজে আকৃষ্ট করতে। ছুরির আঘাতে দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয়, মুখের কথা অন্তরে আঘাত করে। কিন্তু লিখিত বাক্যব্যয় অন্তরকে রক্তাক্ত করে। অনেক প্রেমিক প্রেমের সম্পর্ক যাচাই করে, ফেসবুক পাসওয়ার্ড প্রদানে, অন্তরঙ্গ ছবি ও ভিডিও কলে লজ্জার মাথা খেয়ে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক-জাহেলি যুগের মতো সৌন্দর্য প্রদর্শন করো না।’ (সূরা আহজাব, আয়াত-৩৩)

বিশ্ববাসীর জন্য সাইবার অপরাধ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য দেশে বহুমুখী রূপ ধারণ করলেও বাংলাদেশে তরুণ-তরুণীদের সাইবার অপরাধের শিকার হতে বেশি দেখা গেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর মুসা যখন যৌবনে পদার্পণ করল এবং পরিণত বয়স্ক হলো, তখন আমি তাকে বিচারবুদ্ধি ও জ্ঞান দান করলাম। আর এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কার দিয়ে থাকি।’ (সূরা কাসাস, আয়াত-১৪)

২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণীত হয়। যেখানে সাইবার নিরাপত্তা আইন ১৪ ধারায় অপরাধের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বহু মানুষ আইনের ব্যাপারে সচেতন নয়। আইনের আশ্রয় নিয়ে নিজেকে সুরক্ষিত করার সৎ সাহস নেই বা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিন পার করে। এই সুযোগে অপরাধীরা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।

সবার মনে রাখা উচিত, ওস্তাদের মাইর শেষ রাতে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর সামুদ সম্প্রদায়, আমি তাদেরকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিয়েছিলাম; কিন্তু তারা সঠিক পথে চলার পরিবর্তে অন্ধ পথে চলাই পছন্দ করেছিল। ফলে তাদের অর্জনের কারণেই লাঞ্ছনাদায়ক আজাবের বজ্রাঘাত তাদেরকে পাকড়াও করল।’ (সূরা হা-মিম, আয়াত-১৭)

আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে করেছে উন্নত ও সহজতর। ইন্টারনেটের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিতে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রত্যেকে নিজের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রাণান্তকর লড়াই করে। কিন্তু অনেকেই অবচেতন মনে ইন্টারনেটে ঘোরাঘুরি করে, জীবন নৌকার ভরাডুবি ঘটায়; নিজেকে আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিজ হাতে নিজদের ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না। আর সুকর্ম করো। নিশ্চয় আল্লাহ সুকর্মশীলদের ভালোবাসেন।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৯৫)

যারা নিজেদের জঘন্য অপরাধ থেকে ফিরিয়ে আনতে চায়, আল্লাহ তায়ালা তাদের সুসংবাদ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বলো, হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজেদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা জুমার, আয়াত-৫৩) হে আল্লাহ! আমাদের সাইবারের মতো জঘন্য অপরাধ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন।
মাসুম আলভী : প্রাবন্ধিক