পাবনার প্রত্যন্ত গ্রামে সন্ত্রাসী বাহিনীর তান্ডবে অর্ধশত পরিবার ৬ মাস ঘর ছাড়া

পাবনার প্রত্যন্ত গ্রামে সন্ত্রাসী বাহিনীর তান্ডবে অর্ধশত পরিবার ৬ মাস ঘর ছাড়া

পাবনার প্রত্যন্ত গ্রামে সন্ত্রাসী বাহিনীর তান্ডবে অর্ধশত পরিবার ৬ মাস ঘর ছাড়া

পাবনা প্রতিনিধি:পাবনার প্রত্যন্ত গ্রামে সন্ত্রাসী বাহিনীর তান্ডব, ৪৭ পরিবার ৬ মাস ঘর ছাড়া। কর্তৃপক্ষের নজরে থাকলেও গৃহহারাদের নিজ বাড়ি-ঘরে ফিরিয়ে আনার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ধোপাদহ ইউনিয়নের প্রত্যন্ত দয়ারামপুর গ্রামের ৪৭টি পরিবারের অন্তত: দু’শ’ মানুষ গত ৬ মাস ধরে বাড়ি ঘর ছাড়া। তারা আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি-ঘরসগহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। নিজের বাড়ী ঘর থাকতেও আজ তারা পরবাসী। সন্ত্রাসীদের ভয়ে তারা বাড়ি ফিরতে পারছেনা।

সন্ত্রাসী গ্রুপ ঘরছাড়া পরিবারগুলোর গরু, ছাগল, ধান, চাল, পাটসহ বাড়ীর সমস্ত আসবাবপত্রসহ অন্তত: ৫ কোটি টাকা মূল্যের সমস্ত জিনিসপত্র লুটপাট করে নিয়ে গেছে। এ ছাড়া বাড়ি ছাড়া মানুষজনের অন্তত: ২শ’ বিঘা জমি এখন চাষবাস করছে সন্ত্রাসী গ্রুপ।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে সন্ত্রাসীরা বাড়ীর টাইলস, বেসিন, টিউবওয়েল, বৈদ্যুতিক তার ও টিনের ঘরের চালও খুলে নিয়ে গেছে। এ ব্যাপারে সাঁথিয়া পুলিশকে বার বার অভিযোগ দিলেও তারা  কোন ভূমিকায় রাখেনি; উল্টো লুটপাটকারীদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সরেজমিন পরিদর্শনকালে এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগিরা জানান, সাঁথিয়া উপজেলার ধোপাদহ ইউনিয়নের প্রত্যন্ত দয়ারামপুর  গ্রামের সর্বহারা পার্টির সাবেক নেতা মোশারফ হোসেনের ছেলে কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ী এনামুল কবীর শশীর সঙ্গে একই ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের তাজমুল মেম্বরের সঙ্গে দীর্ঘদিন বিরোধ চলছিল।

শশী এলাকার বেকার যুবকদের চাকরি  দেয়ার কথা বলে কয়েকজনের কাছ থেকে ১০ থেকে ২০ লক্ষ টাকা নেয়। এই টাকা ফেরত দেয়া নিয়ে এলাকায় বেশ উত্তেজনা চলছিল। এই টাকার ব্যাপারে তাজমুল মেম্বর কয়েক দফা শালিশ বিচার করে; যা শশীর বিপক্ষে যায়। এই নিয়ে তাদের মধ্যে আরও বিরোধ বেড়ে যায়।

সেই বিরোধের জের ধরে চলতি বছরের ২৫ মার্চ শশীর নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী তাজমুল মেম্বরের বড় ভাই নাজমুলকে হাতুরি ও লোহার রড দিয়ে বেদম মারপিট করে এবং একটি ঘরের মধ্যে আটকে রাখে। পরে মৃত্যু হয়েছে মনে করে অচেতন অবস্থায় নাজমুলকে ফেলে চলে যায়।

পরবর্তীতে এ ঘটনা জানাজানি হলে তাজমুল মেম্বরের লোকজন একত্রিত হয়ে নাজমুলকে উদ্ধার করতে যায়। এ সময় শশী তার কাছে থাকা অবৈধ অস্ত্র দিয়ে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি করে। আশপাশের লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে শশী, আছির, খোয়াজ, রাফি, আক্তার, বাইশবাবু, সিহাব, হাশু, টিপু, রঞ্জু, জসিম, সবুজ, সুমন, রাজা, নাজির, জাফর, আক্কাস, শের আলী, মোশারোফ হোসেন, আমির হামজা, সজল, ফরিদ, ও ফরহাদকে ধাওয়া করে।

এ সময় মৃত এলবাজ প্রামাণিকের ছেলে নাজির হোসেন (৩০) নামের এক ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়। এলাকাবাসী আরও জানায়, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এবং মামলাতে জিততে শশী ও তার ভাবী মিলে তাদের বাড়ী নিয়ে নাজিরের মৃত্যু নিশ্চিত করে।

নাজির হত্যার পর তার স্ত্রী বৈশাখী খাতুন বাদী হয়ে তাজমুল মেম্বর, নাজমুল, ফরদাহসহ ২৯ জনের নামে হত্যা মামলা দায়ের করে। এর পর পরই শুরু হয় শশী বাহিনীর তান্ডব। শশী বাহিনী দয়ারামপুর গ্রামে অন্তত: ৪৭টি বাড়ীতে লুটপাট ও তান্ডব চালিয়ে শ্মশান বানিয়ে ফেলেছে। ফলে সকল সম্পদ ও বাড়ীঘর ফেলে পরিবার পরিজন নিয়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে যায় এ সব লোকজন। এ ঘটনায় পুলিশ আসামীদের গ্রেফতার করে কারাগারে  পাঠায়। তাদের অনেকেই আদালত থেকে জামিন পেলেও নিজ বাড়ীতে ফিরতে পারছেনা।

দয়ারামপুর গ্রামের আব্দুর রহমান (১০০), মোঃ হাছেন (৭০), সিদ্দিক, আলহাজ, আকব্বর আলী, খোকন, খোকা, মঞ্জু, ইমদাদুল, আয়নাল, আজিত, এনাই, রতন, গাজী, কামরুল, ইদ্রিস, বাবলু, খাজেম, ফিরোজ, ফরহাদ, সাহেদুল, আলাউদ্দিন, ফরিদ, জবেদ, গুলজার হাজী, মোজাম্মেল, ছকের, করিম, ইব্রাহিম, ইজ্জাহাত, মিরাই, লাল, জুলমত, জয়েন, সেলিম, আনারুল, দিরাজ, রাজ্জাক, ঝন্টু, শওকত, রবিউল, মান্নান মাষ্টার, মতিন, ঠান্ডু ও রাহেলার বাড়ী ঘর এখন নিস্তব্ধ। লুটপাট ও তান্ডবে বাড়ী ঘরে এখন কিছুই নেই।

দয়ারামপুর গ্রামের শত বছরের আব্দুর রহমান বলেন, নাজির মরার পর শশী বাহিনীর লোকজন তার বাড়ীর সব কিছু লুটপাট করে নিয়ে গেছে। এমনকি বাথরুমের দরজা জানালা, বেসিন ট্যাপ পর্যন্ত নিয়ে গেছে। একই গ্রামের হাজেরা খাতুন (৯৫) বলেন,‘পুলিশ সাথে নিয়া আইসা আমাগোর গরু ছাগল নিয়া গেছে।’

দয়ারামপু থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা বর্তমানে হলুদঘরে বসবাস করা আব্দুল আজিজজের স্ত্রী স্বপ্না খাতুন বলেন,‘এতদিন বাপের বাড়ি ছিলাম। ৬ জনের সংসারে কতদিন আরেকজনের সংসারে বোঝা হয়ে থাকা যায়। আমরা এখন তারা বাড়ি ফিরবার চাই।’

গ্রামের ডালিম খাতুন বলেন, তার স্বামী অসুস্থ তাকে নিয়ে আর কতদিন পালিয়ে বেড়ানো যায়। যেভাবেই হোক আমরা বাড়ি ফিরতে চাই। একই এলাকায় অবস্থান করা ফাতেমা খাতুন বলেন, তার মেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে। শশীর লোকজন এমনভাবে বাড়িঘর লুট করেছে যে সেখানে বই পুস্তক পর্যন্ত নিয়ে গেছে। এখন মেয়ের কলেজ খুললে বাড়িতে না ফিরতে পারলে তার পড়াশুনার খুব ক্ষতি হবে।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত এনামুল কবীর শশী সাংবাদিকদের বলেন, তার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ মিথ্যে।

সাঁথিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসিফ মুহাম্মদ সিদ্দিকুল ইসলাম,‘ একটি হত্যা মামলাকে কেন্দ্র করে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। আমরা খুব শিগগির বাড়ি ছাড়াদের বাড়িতে উঠিয়ে  দেয়ার ব্যবস্থা করবো।’

পাবনার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান বিপিএম বলেন,‘এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সাঁথিয়া পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।