২৭ বছর পর পাবনা সুগার মিল বন্ধ বিকল্প পথে আখ বিক্রি করছেন চাষিরা

২৭ বছর পর পাবনা সুগার মিল বন্ধ বিকল্প পথে আখ বিক্রি করছেন চাষিরা

২৭ বছর পর পাবনা সুগার মিল বন্ধ বিকল্প পথে আখ বিক্রি করছেন চাষিরা

১৯৯২ সালে ঈশ্বরদী উপজেলার দাশুড়িয়া ইউনিয়নের পাকুড়িয়া মৌজায় ৬০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত পাবনা চিনিকলটি এখন মৃতাবস্থায় পড়ে আছে। নেই কোন মানুষের আনাগোনা। কলাহলশূন্য মিলের বিস্তৃত আঙিণা যেন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। গতবছর সরকার একই সাথে পাবনা চিনিকলসহ ছয়টি চিনিকল বন্ধ ঘোষণা করায় মিলের এই দূরাবস্থা।

অব্যাহত লোকসানের কারণে গত বছর পাবনা চিনিকলসহ দেশের ছয়টি চিনিকলের উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। বন্ধ চিনিকলগুলোর মধ্যে পাবনা চিনিকল একটি। এদিকে চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন পাবনা জেলার আখচাষিরা। চিনিকল বন্ধ থাকায় অধিকাংশ কৃষক আখের আবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও পাবনার বিভিন্ন উপজেলার অনেক কৃষক আশায় বুক বেঁধে আখের আবাদ করেছিলেন। কিন্তু এখন তাদের উৎপাদিত আখ মিলে সরবরাহ করা নিয়ে পড়েছেন বিপাকে।

চিনিকল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে,মিল বন্ধ থাকায় এ বছর পাবনা চিনিকল এলাকার কৃষকদের উৎপাদিত আখ সরবরাহের দায়িত্ব তারা নেবে না। পাবনার নিকটবর্তী গোপালপুর চিনিকলে গত বছর কৃষকেরা আখ সরবরাহ করতে পারলেও এ বছর এখনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পাননি চাষিরা। যে কারণে আখ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।

এদিকে পাবনা সুগার মিল বন্ধ থাকলেও  পাবনা চিনিকল সংলগ্ন এলাকাসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে আখ চাষিরা বিকল্প পথ খুঁজে বের করেছেন। পুরো জেলার হাটবাজারে আখ বিক্রির ধূম পড়েছে। তৈরি করা হচ্ছে আখের গুড়। জেলা শহর ও উপজেলা সদরসহ গ্রামগঞ্জের হাট বাজারগুলোতে দেখা গেছে আখ বিক্রি।

চাটমোহর উপজেলার হরিপুর এলাকার আখ চাষি আবদুল মুতালিব জানান, এ বছর ২ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছেন তিনি। মিলে আখ দিতে না পারায় জমি থেকেই ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন। একশত আখের দাম পাওয়া যাচ্ছে ১২ থেকে ১৫ শ’ টাকা। চাটমোহর পুরাতন বাজারে আখ বিক্রেতা আবেদ আলী জানান, প্রতিটি আথ ২০/২৫ টাকায় বিক্রি করছি। প্রতিদিন একেকজন বিক্রেতা ১ থেকে দেড়শ’ আখ বিক্রি করেন।

এদিকে আখ মাড়াই করে গুড় তৈরি করা হচ্ছেও বিভিন্ন স্থানে। এছাড়া ভ্রাম্যমান আখের রস বিক্রেতার সংখ্যাও কম নয়। বিপুল সংখ্যক ব্যক্তি আখের রস বিক্রি করে জীবীকা নির্বাহ করছেন। আখ বিক্রেতা আবদুল মজিদ জানান,এক গ্লাস আখের রসের দাম ১০ টাকা। প্রতিদিন ২/৩ শত গ্লাস রস বিক্রি করেণ তিনি।

পাবনা চিনিকলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অলস পড়ে আছে জেলার এই বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানটি। ২০২১-২২ মৌসুমেও আখ মাড়াই হচ্ছেনা। আখের স্বল্পতা এবং লোকসানের মুখে গত ২০২০-২১ আখ মাড়াই মৌসুমের আগে মাড়াই কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। এরই মধ্যে মিলে কর্মরত কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের বেশিরভাগকেই বিভিন্ন মিলে বদলি করা হয়েছে। মিল জোন এলাকার অধিকাংশ কৃষকরাও এবছর আখ চাষ করেননি। মিল কর্তৃপক্ষও আখ চাষের জন্য কৃষকদের ঋণ এবং কৃষি উপকরণ সরবরাহ করেনি। যে সকল কৃষক নিজ উদ্যোগে আখ চাষ করেছেন তারাও আখ সরবরাহ নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, পাবনা চিনি কলে দৈনিক মাড়াই ক্ষমতা ছিল ১ হাজার ৫শ’ মেট্রিক টন আখ। এর জন্য ১০ হাজার একর জমিতে আখ আবাদ করা প্রয়োজন হতে। এই মিলে আখ মাড়াই শুরুর পর থেকে ২০০২-০৩ মৌসুমে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৫৩৭ এরক জমিতে আখ আবাদ করা হয়। এ ধারা ২০০৭-০৮ অর্থবছর পর্যন্ত চলতে থাকে। কিন্তু ২০০৮-০৯ অর্থ বছর থেকে বিভিন্ন ফসলের সাথে প্রতিযোগিতায় আখের আবাদ হ্রাস পেতে থাকে। ফলে মাড়াই মৌসুমে আখের স্বল্পতা দেখা দেয়।

এদিকে আখ দীর্ঘ মেয়াদী ফসল হওয়ায় পাবনার ঈশ্বরদী অঞ্চলের চাষীরা স্বল্পমেয়াদী ফসলের দিকে ঝুঁকেছে। ফলে আখ উৎপাদন কমে গেছে। এছাড়া এ অঞ্চলের লিচুর ফলন ভালো হওয়ায় অনেক কৃষক তাদের জমিতে লিচু বাগান করেছেন।

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থ বছরে পাবনা জেলার মিল জোন এবং নন মিল জোন মিলে আখ আবাদ হয়েছিল ৩ হাজার ২৯৯ হেক্টর জমিতে। মিলে চিনি উৎপাদন বন্ধ ঘোষণার পর ২০২১-২২ অর্থ বছরে জেলায় মোট ১ হাজার ৩৬৮ হেক্টর জমিতে আখ আবাদ করা হয়েছে।

মিল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ মাড়াই মৌসুমে আখ মাড়াই স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এই মৌসুমে মিল জোন থেকে প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন আখ পাশ্ববর্তী মিলগুলোতে সরবরাহ করা হয়। এর আগে ২০১৯-২০ মাড়াই মৌসুমে পাবনা সুগার মিলে ১ লাখ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করা হয়েছিল।

এদিকে গত মৌসুম থেকে পাবনা চিনিকলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অলস পড়ে আছে পাবনা সুগার মিলের শতাধিক কোটি টাকার সম্পদ। পরিচর্যার অভাবে মিলের পুরো এলাকা আগাছায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। দ্রুত মিল চালু করা না গেলে মিলের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন মিলের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও কৃষকেরা। কৃষকদের স্বার্থে মিলের উৎপাদন পুনরায় চালু করার দাবি করেন তারা।

চলতি মৌসুমে পাবনা চিনি কল কর্তৃপক্ষ আখ চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ না করলেও অনেক কৃষক নিজ উদ্যোগে তাদের জমিতে আখ চাষ করেছেন। তারা এখন উৎপাদিত আখ নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন। তবে মিল কর্তৃপক্ষ বলছেন, পাবনা অ লে উৎপাদিত আখ নর্থবেঙ্গল চিনি কল থেকে ক্রয় করা হবে। এদিকে অনেক কৃষক তাদের জমিতে উৎপাদিত আখ কেটে বিভিন্ন হাট-বাজারে খুচরা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন।   

পাবনা চিনিকল শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি সাজেদুল ইসলাম শাহিন জানান, পাবনা চিনি কল পাবনা জেলার একটি বৃহৎ শিল্প। মিলে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি এই মিলকে ঘিরে বিপুল সংখ্যাক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক মানুষের উপার্জনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি আখ চাষিরাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। আর যত দিন পাবনা মিল চালু করা না হয়; তত দিন ঈশ্বরদী এলাকাকে নর্থবেঙ্গল চিনি কল জোনের আওতায় আনা হলে কৃষকরা উপকৃত হবেন। আমরা চাই প্রধানমন্ত্রী মিলটি যেন পুনরায় চালুকরার ঘোষণা দেন।

ঈশ্বরদী উপজেলার কৃষক নেতা মুরাদ আলী মালিথা বলেন, পাবনা চিনি কলে গত বছর আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষণার পর চলতি বছর মিল কর্তৃপক্ষ আখ চাষের জন্য কৃষকদের কোন সহযোগিতা করেননি। তার পরেও অনেক কৃষক নিজ উদ্যোগে আখ চাষ করেছেন। তারা এখন আখ সরবরাহ নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছেন।

পাবনা সদর উপজেলার দক্ষিণ মাছিমপুর গ্রামের কৃষক মোঃ ছলিম জানান, ‘আমি এবছর আড়াই বিঘা জমিতে আখ আবাদ করেছি। প্রতি বছর মিল থেকে সহযোগীতা করা হলেও এবছর কোন সহযোগিতা করা হয়নি। এমনকি আখ ক্রয়ের ব্যাপারেও কিছু জানা যাচ্ছেনা। মিলে বিক্রি করতে না পারলে নিজেদেই গুড় তৈরির ব্যবস্থা নিতে হবে।’

পাবনা চিনিকল কর্তৃপক্ষ জানায়, পাবনা চিনিকলের অন্তর্গত দশটি চিনি উৎপাদনের জোন আছে। তবে উৎপাদন কম হওয়ায় এ বছর মিলের চারটি আখ উৎপাদন জোনকে পাবনার নিকটবর্তী গোপালপুর চিনিকলের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। ফলে কৃষকদের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। যে চারটি জোন নাটোরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে সেগুলো হলো ঈশ্বরদী জোন, মুলাডুলি জোন, লক্ষ্মীকুন্ডা জোন ও মিলগেট জোন। এসব জোনের আওতাধীন কৃষকেরা নির্ধারিত সময়ে আখ সরবরাহ করতে পারবেন।

পাবনা চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোঃ সাইফ উদ্দীন আহম্মেদ জানান, আখের স্বল্পতা, বিভিন্ন ধরনের স্বল্পমেয়াদী ফসলের সাথে প্রতিযোগিতায় আখের আবাদ হ্রাস পেতে থাকা এবং লোকসানের কারণে মিল মাড়াই স্থগিত করা হয়েছে। মিলে প্রায় ৬শ’ কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করতেন। এদের মধ্যে চলতি বছর জানুয়ারি মাস থেকে কর্মকর্তাদের এবং গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে শ্রমিক-কর্মচারীদের বিভিন্ন মিলে বদলি করা হয়েছে। অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীই বদলি হয়ে গেছেন।

এমডি আরো বলেন, সরকার মিল বন্ধ ঘোষণা করেনি। এই মিলাকে আরো আধুনিকিকরণ করা পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। সেটা চিনি কলও হতে পরে আবার অন্য কোন ইন্ড্রাষ্ট্রিও হতে পরে।

১৯৯২ সালের ২৭শে ডিসেম্বর ঈশ্বরদী উপজেলার দাশুড়িয়া ইউনিয়নের পাকুড়িয়া মৌজায় ৬০ একর জমির ওপর পাবনা চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে আখ মাড়াই মৌসুমে কারখানায় পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়। কারখানাটি বাণিজ্যিকভাবে চিনি উৎপাদন শুরু করে ১৯৯৮-৯৯ অর্থ বছরে। চালুর পর থেকেই কারখানাটি উৎপাদন ঘাটতি ও লোকসানের কবলে পড়ে।তারপরও আখ চাষের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পাবনার আখচাষিরা পাবনা চিনিকলটি পুনরায় চালুর আশায় বুক বেধে আছেন।