এ যেন মিনি রাশিয়া

এ যেন মিনি রাশিয়া

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরুর পর কয়েক বছরে সেখানে গড়ে উঠেছে নানা অবকাঠামো

এম মাহফুজ আলম(পাবনা): কে জানতো ঈশ্বরদীর পদ্মা পাড়ে ধূ ধূ বালু রাশি আর কাশবনের ঢেউ তোলা বিস্তীর্ণ এলাকায় দেশের একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে উঠবে। পূর্ব আকাশের সূর্যটি হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে যে জায়গাটিতে নেমে আসতো নীরবতা। আঁধার নেমে আসার পর এলাকাটির পাশ দিয়ে কেও যাতায়াত করতো না। দায় বেধে যাতায়াতের সময় গাঁ ছমছম, শিরশির করে ওঠতো।  মাঝে মধ্যে শোনা যেত কি হুয়া বলে ডেকে উঠা শিয়াল পন্ডিতের ডাক। দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নাম বার বার উচ্চারিত হচ্ছে। তাই রূপপুরের নাম এখন আন্তর্জাতিক মহলে। কোনদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি এই বিশাল বালুকাময় প্রমত্তা পদ্মা পাড়ে গড়ে উঠবে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আর এটিকে ঘিরে অদূরে অজগাঁও গ্রাম আর বনবাদাড়ে মধ্যে নির্মিত হবে অত্যাধুনিক ২০তলা ভবন নির্মাণ হবে।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরুর পর কয়েক বছরে সেখানে গড়ে উঠেছে নানা অবকাঠামো। পাশাপাশি রুশভাষাভাষী কয়েক হাজার বিদেশি কর্মীদের অবস্থানে সেখানকার অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় প্রভাব পড়েছে রাশিয়ার ভাষা ও সংস্কৃতির। এলাকার রিসোর্টগুলো ঘুরে দেখা গেছে, অনেক রুশ নাগরিক অবসর সময় কাটাচ্ছেন।

পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রীজ ও লালন শাহ সেতুর পাশেই নদীতীরে চলছে এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের সবচেয়ে মেঘা প্রকল্পের কাজ। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কর্মযজ্ঞ শুরুর পর  থেকে বদলে যেতে থাকে এলাকার চিত্র। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের কল্যাণে এলাকার দৃশ্যপট পুরোটাই পাল্টে গেছে।  পাল্টে যায় জীবনযাত্রার মান। ফলে পাবনার রূপপুর যেন মিনি রাশিয়া বা একখন্ড’রাশিয়া।

এলাকার-বিপণিবিতান, বিদ্যালয়, সুউচ্চ ভবন, আন্তর্জাতিক মানের হোটেল-রেস্টুরেস্ট, রিসোর্ট এখন মুখরিত। এখানকার কাঁচা বাজারগুলোতেও যেন রাশিয়ানদের ছোঁয়া লেগেছে। এর বাইরে চারপাশে গড়ে ওঠা হোটেল, রিসোর্ট, বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো কর্মহীন মানুষের। বিদেশি নাগরিকদের কেনাকাটাসহ দৈনন্দিন নানা প্রয়োজন মেটাতে পাকশী, সাহাপুর, রূপপুর ও ঈশ্বরদী শহরে গড়ে উঠেছে একাধিক বিপণিবিতান, আধুনিক শপিংমল, সুপার শপ, রিসোর্ট ও তারকা হোটেল। উন্নতমানের হাসপাতালও নির্মাণ করা হয়েছে।

রূপপুর প্রকল্পে কাজের সুযোগ পেয়েছেন কয়েক হাজার বেকার যুবক। তাদের ভাগ্য যেমন বদলে গেছে, তেমনি বদলে গেছে সামাজিক চিত্রও। বেড়েছে জমির দাম। শুধু রূপপুর নয়, পার্শ্ববর্তী পাকশী, সাহাপুর ও ঈশ্বরদী শহরেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। পাল্টে গেছে জীবনচিত্র।

রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের পরিচালক সৈকত আকবর জানান, এই প্রকল্পে দেশি-বিদেশি ২৫ হাজার প্রকৌশলী-শ্রমিক সর্বদা কাজ করছেন। রাশিয়া, বেলারুশসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় দুই হাজার বিদেশি শ্রমিক ও কর্মকর্তারা দিনরাত পরিশ্রম করছেন। বাকিরা এ দেশের।

সাহাপুর এলাকার আবদুল্লাহ মোমিন বলেন,‘ভাবতেই পারিনি যে আমাদের এখানে রাশিয়ার মতো বিল্ডিং হবি। রাশিয়ার মাধ্যমে এত উন্নত হবি। বিদ্যুৎকেন্দ্র ঘিরে ওই এলাকার বিভিন্ন গ্রামবাসী বিভিন্ন ধরণের মন্তব্য করেন।’ 

ঈশ্বরদী পৌরসভার মেয়র ইসহাক আলী মালিথা বলেন, বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানে এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। শুধু বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না, এখানে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে। রূপপুরের নাম এখন আন্তর্জাতিক মহলে। রাশিয়ানদের পদচারণায় রূপুপর যেন একখন্ড রাশিয়াপল্লিতে বা মিনি রাশিয়ায় পরিণত হয়েছে।

ঈশ্বরদী উপজেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব মোস্তাক আহমেদ কিরণ বলেন, অভাব-অনটনের কারণে আগে এসব গ্রামে প্রায়ই পারিবারিক ও দাম্পত্য কলহ েেদনা-পাওনার নালিশসহ নানা ধরনের কলহ নিরসন করতে বিচার সালিস করতে হতো। বেকারত্ব দূর হওয়ায় গ্রামে এখন আর সে পরিবেশ নেই। পারিবারিক, সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরেছে। হাজার হাজার মানুষের পদচারণা রয়েছে এখানে। সব মিলে রূপপুর এখন যেন রুশ নগরীতে পরিণত হয়েছে। পশ্চিম রেল পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (ডিআরএম) শাহিদুল ইসলাম জানান, রূপপুর প্রকল্পের ভারী যন্ত্রপাতি রেলপথে আনা-নেয়ার জন্য ৩ শ’ ৩৫ কোটি টাকা খরচে ২৬ কিলোমিটার নতুন  রেলপথ নির্মিত হয়েছে।

উল্লেখ্য, ১৯৬১ সালে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপর দীর্ঘ সময় পার হলেও সেটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে উদ্যোগটিতে গতি আসে। চুক্তি হয় রাশিয়ার সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের অক্টোবরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। পুরোদমে কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর।