নৈতিকতা সব উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি

নৈতিকতা সব উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি

নৈতিকতা সব উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি

নৈতিকতা খুবই রসহীন একটি শব্দ। এই নিয়ে কেউ কথা বললে তার প্রতি আগ্রহী লোকের সংখ্যা খুবই নগণ্য পাবেন। এই যে প্রবন্ধটি উপস্থাপন করা হচ্ছে তার পাঠক সংখ্যা ক’জন হবে আল্লাহ মালুম। আগেই বলে রাখি ‘নৈতিকতা’ বলতে আমি তাকওয়াকে বোঝাচ্ছি। যেই তাকওয়া মানুষের চরিত্রকে সুন্দর করে, সমাজ ও সভ্যতাকে সুন্দর করে।

পৃথিবীর জীবনে সব প্রকার উন্নয়নের জন্য নৈতিকতা একটি মৌলিক বিষয়। এটি এমন একটি উপাদান, এটিকে যেখানেই প্রয়োগ করবেন সেখানটায় উন্নয়নের স্রোতধারা প্রবল বেগে বইতে থাকবে। ব্যক্তি জীবনে প্রয়োগ করুন, ব্যক্তি সোনার মানুষে পরিণত হবে। পরিবারে প্রয়োগ করুন, আদর্শ পরিবার গড়ে উঠবে। সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রয়োগ করলে সমাজ ও রাষ্ট্র সোনালি দিনের সমাজ ও রাষ্ট্রে রূপ নেবে। এমনিভাবে শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা, আইন-আদালতসহ মানুষের সামগ্রিক জীবনের যেখানটায় প্রয়োগ করবেন সেখানটায় একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখবেন।

নৈতিকতার অনুপস্থিতির কারণে পৃথিবী দিন দিন ধ্বংসের দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব নেতারা ও সমাজ-সভ্যতার তথাকথিত গ্রেড থিঙ্কাররা বিশ্ব শান্তির জন্য দিন-রাত মাড়িয়ে চলেছেন অনেকটা অন্তহীন মরুভূমির দিকভ্রান্ত পথিকের মতো। দুঃখের বিষয় হলো একান্ত হাতের কাছে, খুবই সহজপ্রাপ্য ও অত্যন্ত কার্যকরী নৈতিকতার প্রশ্নটি তাদের নজরে আসে না বা উর্বর মাথা দিয়ে তাদের চিন্তায় স্থান করে নিতে পারেন না। তবে খুব নিকট ইতিহাস থেকে জানা যায়, একেবারেই শেষপ্রান্তে এসে যখন ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন অনন্যোপায় হয়ে ‘নৈতিকতা’ এর দ্বারস্থ হয়।

আমরা এখানে আপাতত মরণব্যাধি এইডস ও ইয়াবাকে উদাহরণ হিসেবে পেশ করতে পারি। সারা পৃথিবীর চিকিৎসাবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীসহ প্রায় সব চিন্তাবিদ অনেক পথ মাড়িয়ে এসে শেষাবধি তাদের উপলব্ধি হলো যে, মরণব্যাধি এইডস থেকে বাঁচতে হলে ‘ধর্মীয় অনুশাসন মানতে হবে’ বা ‘ধর্মীয় জীবনযাপন করতে হবে’। তারা নর-নারীর অবাধ মেলামেশা, উদ্দাম, উচ্ছৃঙ্খল ও বিকৃত যৌনাচার এইডসের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর এর পরিণাম হলো নিশ্চিত মৃত্যু।

আমাদের কথা হলো শুধু মরণব্যাধি এইডস কেন? জীবনের সামগ্রিক কল্যাণ ও মুক্তির জন্য অবশ্যই নৈতিকতা তথা ধর্মীয় অনুশাসন মানতে হবে। চারদিকে শুধু অবক্ষয় আর অবক্ষয়। মানুষের ব্যক্তি ও জাতীয় চরিত্রের চরম অধঃপতন, পারিবারিক ও সামাজিক সুশৃঙ্খল কাঠামোর ভাঙন এবং রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও সন্ত্রাসসহ পৃথিবীতে আজ বিশাল এক ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। দুর্নীতি, দুষ্কর্ম ও দুঃশাসন পৃথিবীকে গ্রাস করছে। দুনিয়াজুড়ে মানুষ মানুষের রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছে। ভোগের রাজ্যে চলছে অত্যধিক মাতলামি।

মোট কথা মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক জীবন আজ মরণব্যাধি এইডসে আক্রান্ত। জীবনের সার্বিক সুস্থতার জন্য নৈতিকতাই এর একমাত্র প্রতিষেধক। আর নৈতিকতা বলতে ধর্মীয় অনুশাসনকে বলা হয়। আর ধর্মীয় অনুশাসন বলতে আল কুরআনের শাসনকেই বোঝায়। তাই সামগ্রিক ধ্বংস থেকে মুক্তি পেতে হলে এবং সুন্দর এক পৃথিবীর সোনালি প্রভাত অবলোকন করার জন্য আল কুরআনের কাছে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে মানুষ যখন আল্লাহর হুকুম অমান্য করে কোনো প্রকৃতিবিরোধী কাজে লিপ্ত হয়, তখন আল্লাহর কঠিন নিয়মে বাঁধা প্রকৃতি তাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। ফলে বিভিন্ন অভিশাপ মানুষের ওপর নেমে আসে। পরম সত্তার দেয়া জীবনবিধান থেকে দূরে সরে গিয়ে যখন মানুষ নীতি-নৈতিকতাবিবর্জিত কাজে লিপ্ত হয় তখন আল্লাহ তায়ালা বিচ্যুত জাতির পরবর্তী প্রজন্মের সচেতনতার জন্য বিভিন্ন ধরনের ভয়ঙ্কর নজির স্থাপন করেন। অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর ওপর নেমে আসা প্লাবন, মহামারী, পাথরবৃষ্টি, রক্তবৃষ্টি, পতঙ্গবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, প্লেগ ও সুনামির মতো দুর্যোগগুলো ছিল তাদেরই হাতের কামাই। সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ এর ব্যতিক্রম কিছু নয়। বরং তারই ধারাবাহিকতা।

আসলে নৈতিকতা এমন একটি উপাদান বা এমন একটি বিষয় যা সর্বাবস্থায় মনুষ্য জীবের সাথে থাকা জরুরি। অন্যথায় মানুষ ও অন্যান্য প্রাণিকুলের মধ্যে পার্থক্য রেখা টানার মতো নৈতিক কোনো উপায় থাকে না। মানুষ নৈতিক জীব এ জন্যই তো সে মানুষ। তার আছে মনুষ্যত্ব, মানবিক মূল্যবোধ, প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসা।

তার আছে উন্নত পর্যায়ের চিন্তা, উপলব্ধি জ্ঞান, বিবেক-বুদ্ধি ও উন্নত চরিত্র যা অন্য কোনো প্রাণীর নেই। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘আমি মানুষকে উন্নত কাঠামোয় তৈরি করেছি’ (সূরা ত্বিন)। কিন্তু এ মানুষই যখন মনুষ্যত্ব তথা নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধকে বিসর্জন দেয় তখন সে হিংস্র পশুদেরকেও ছাড়িয়ে যায় এবং সে ভয়ঙ্কর এক আজীব প্রাণীতে পরিণত হয়। কারণ হিংস্র প্রাণীরা শুধু নিজের ক্ষুধার খাদ্য জোগাড় করার জন্য অন্য পশুদের শিকার করে। কোনো পশু নিজের জিঘাংসা বা পাশবিকতা চরিতার্থ করার জন্য অন্য প্রাণীর ওপর হামলে পড়ে না।

মানুষের কর্মজীবনে নৈতিক স্বচ্ছতা এমন একটি উপাদান যা মানুষকে সব প্রকার দুর্নীতি, দুষ্কর্ম ও দুরাচারের ঊর্ধ্বে উঠে যাবতীয় নৈতিকতার কষ্টিপাথরে যাচাই করে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছভাবে কাজ করার জন্য প্রেরণা জোগায়। ইসলাম এমন এক জীবনব্যবস্থা যা তার অনুসারীদের প্রতিনিয়ত এ ধরনের নৈতিক স্বচ্ছতার প্রতি দিকনির্দেশ করে থাকে। ইসলাম এমন কতগুলো কর্মসূচি (ইবাদত) দিয়েছে যা দৈনন্দিন আমাদের প্রতিটি কাজকে সুসংহত করে। আমরা যাতে নৈতিক স্বচ্ছতা বজায় রেখে আমাদের সব কাজকর্ম সম্পাদন করতে পারি সেই অভ্যাস আমাদের মাঝে গড়ে তুলে।


আল্লাহ মানুষকে ভালো-মন্দ যাচাই করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিবেক দান করেছেন। আর এ বিবেকের সামনে পেশ কেরেছেন হেদায়াত। প্রথম মানব হজরত আদম আ:কে দুনিয়ায় প্রেরণ করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলে দিলেন, ‘হয়তো আমার পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য হিদায়াত আসতে পারে, যারা আমার এ হিদায়াতের অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় নেই এবং দুঃখ, চিন্তা থাকবে না’ (সূরা বাকারা-৩৮)।

মানুষ যদি তার সুস্থ বিবেকের সাহায্যে আল্লাহর দেয়া হিদায়াত তথা ইসলামী জীবনব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করে, তবে অবশ্যই মনুষ্য জগতে শান্তি আর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হতে বাধ্য। আমরা ইসলামের প্রতিটি ইবাদতের দিকে গভীর মনোযোগ নিবিষ্ট করলে বুঝতে পারি যে, মানুষের বিবেককে শক্তিশালী ও জাগ্রত করে অন্যান্য জগতের মতো পরিপূর্ণ মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মহান আল্লাহ এক কার্যকরী কর্মসূচি প্রণয়ন করে দিয়েছেন।

আর এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের পেছনে আল-কুরআন ষবধফরহম বা নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘ইহা একখানি কিতাব যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে। যাতে তুমি লোকদেরকে তাদের রবের অনুমতিক্রমে জমাট বাঁধা অন্ধকারসমূহ থেকে সেই আলোর পথে নিয়ে আসতে পারো যে পথটি এমন এক সত্তার যিনি পরাক্রমশালী এবং নিজেই প্রশংসিত’ (সূরা ইবরাহিম : ২)। অর্থাৎ মানুষদেরকে টহফবৎ ডড়ৎষফ তথা অন্ধকার জগতের নাগপাশ থেকে মুক্ত করে একটি সুস্থ সমাজের অধিবাসী বানাতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে নৈতিকতা এমন একটা শক্তি, এমন একটা গুণ, যার ওপর ভিত্তি করে মানুষ হক ও বাতিল, ভুল ও সঠিক, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। যে কাজ বা প্রথা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আরো অসংখ্য ক্ষতির সৃষ্টি করে, যেসব কাজে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, সেটিই মানুষের জন্য ক্ষতিকারক। এ ধরনের ক্ষতিকারক কাজ থেকে আত্মরক্ষা করা খুবই জরুরি। আর আত্মরক্ষার জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন। জ্ঞানের চাহিদা মিটাবে আল কুরআন।

কারণ আল কুরআন আল্লাহর নাজিল করা। আত্মরক্ষার জন্য আত্মাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আত্মাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য দরকার নৈতিক গুণ। এ ধরনের নৈতিকতাসম্পন্ন জাতি-গোষ্ঠী ও সমাজের জন্য আল্লাহ তাঁর আকাশ ও জমিনের সব সম্পদ উন্মুক্ত করে দেন।

জাফর আহমাদ : ম্যানেজার, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড, জিন্দাবাজার শাখা, সিলেট