মহামারী পরবর্তী স্বাভাবিক জীবনে ফেরা মানুষের জীবন এখন যেমন

মহামারী পরবর্তী স্বাভাবিক জীবনে ফেরা মানুষের জীবন এখন যেমন

ফাইল ছবি

সরকারী চাকুরী করেন মিতু মরিয়ম। মহামারীর দু’বছরে বেশ কিছুটা সময় অফিস করেছেন বাসা থেকেই। একই সাথে তার তিন সন্তানের স্কুল না থাকায় লম্বা একটা সময় তিনি সন্তানদের সাথে কাটানোর সুযোগ পেয়েছেন।

‘আমার ১২ বছরের চাকুরি জীবনে এই প্রথম লম্বা সময়ে বাসায় সন্তানদের সাথে কাটিয়েছি। আমি বাসায় থেকে অফিসের কাজ করেছি, ওরা বাসায় থেকে অনলাইনে ক্লাস করেছে,’ বলছিলেন তিনি।

এখন তাকে প্রতিদিন ভোর ছটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠতে হয় তিন বাচ্চাকে স্কুলের জন্য রেডি করানোর জন্য।

‘এখন ওদের ঘুম থেকে তুলে খাওয়ানোর পর স্কুলের জন্য রেডি করি। ওরা গেলে আমি অফিসের জন্য রেডি হই। আবার গত দু বছর ওরা কি পড়ছে সেটি সামনে দেখতাম। এখন সেই সুযোগ নেই’।

প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তা বলছেন যে মহামারীর সময়ে যখন অফিসে গেছেন তখন তার ফার্মগেটের বাসা থেকে সচিবালয়ে যেতে খুব একটা সময় লাগতো না।

তিনি বলছিলেন, এখন বাসা থেকে অফিসে যাওয়া আর অফিস থেকে ফেরার পথে তীব্র যানজটে পড়তে হচ্ছে, যা স্ট্রেস বাড়িয়ে দিচ্ছে।

তবে মহামারীর সময়ে শপিং মল, বাজার ও জনসমাগম হয় এমন জায়গাগুলোতে না যেতে যেতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি।

‘টুকটাক কেনাকাটা অনলাইনেও সেরে ফেলার অভ্যাস হয়ে গেছে। শপিং মল ও বাজারে যেতে ইচ্ছেই করে না। অথচ আগে স্বাভাবিক সময়ে রেগুলারই যেতাম দোকানপাটে’।

বাংলাদেশে ২০২০ সালের ৮ই মার্চ প্রথম করোনা শনাক্ত হওয়ার পর কয়েক দফায় লকডাউনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি বেসরকারি অফিস বন্ধ ছিলো।

বিকল্প হিসেবে হোম অফিস ও অনলাইনে ক্লাস চালু করা হয়েছিলো। ফলে সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই বাসায় থেকেই অফিস করেছেন লম্বা সময় ধরে।

আর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুরোদমে আবার চালু হয়েছে চলতি মাসেই। ফলে দু বছরের পুরনো চেহারা আবার ফিরে এসেছে অর্থাৎ গত কয়েকদিন ধরেই ভয়াবহ যানজট দেখা যাচ্ছে শহর জুড়ে।

একসময় বেসরকারি চাকুরী করতেন কিন্তু এখন পুরোদস্তুর গৃহিনী মাহবুবা দিনা। তিনিও বলছেন যানজটের কষ্ট আবার ফিরে এসেছে, কিন্তু তিনি মনে করেন এর যেহেতু সমাধান নেই তাই মেনে নিয়েই পরিকল্পনা করতে হবে।

‘তবে মহামারীর সময়ে হাত ধোয়া আর মাস্ক পড়ার অভ্যাস হয়েছে। যা নতুন স্বাভাবিক সময়েও অনুশীলন করছি। করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর দেশের বিশেষ করে ঢাকাসহ শহরগুলোর মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে।

রাস্তাঘাটে চলাফেরা সীমিত হয়, রেস্টুরেন্টগুলো ছিল ফাঁকা,ম এমনকি সবসময় লোকসমাগম হতো এমন শপিংমলগুলোও অনেকদিন বন্ধ কিংবা সীমিত খোলা রাখা হয়।

ফলে অনলাইনে ক্লাস ও অফিসের পাশাপাশি ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিলো অনলাইনে কেনাকাটা। ২০২০ সালের মার্চের শেষের দিকে গণপরিবহন বন্ধসহ কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

তবে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় বিধিনিষেধ ওই বছরের জুলাই থেকে কিছুটা শিথিল হতে থাকে। কিন্তু গত বছরের মার্চে পুনরায় করোনাভাইরাসের ডেলটা ধরনের সংক্রমণ দেখা দিলে আবারো আরোপ করা হয় কঠোর বিধিনিষেধ।

পরে গত বছরের অগাস্টে এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকে। কিন্তু করোনাভাইরাসের নতুন ধরন অমিক্রন এসে আবার পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। ফলে আবারো বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

এখন পরিস্থিতি আবার ভালো হওয়ার প্রেক্ষাপটে গত সপ্তাহ থেকেই সব ধরণের বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছে সরকার। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকুরী করেন অর্পিতা সাহা। তার মতে করোনাভাইরাস মহামারীর সময়টা জীবনে বড় পরিবর্তন এনেছে।

তিনি বলছিলেন, ‘এক সময় কাজের পেছনে ছুটেছিলাম। মহামারী শুরুর পর কিছুটা ভয় ফেলেও পরিবারের সাথেই বেশি সময় কেটেছে। বহু দিন বাইরেই যাইনি। আবার বের হলেও রাস্তাঘাট খালি থাকতো বলে দ্রুতই গন্তব্যে যেতাম। এখন আবার সেই আগের পরিস্থিতি। কাজ শেষে জ্যামে বিধ্বস্ত হয়ে বাসায় ফেরা।’

দু বছর ছিলো ‘শিথিল’ সময়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শামীম রেজা বলছেন গত দু বছর অনেকের জন্য একটা শিথিল সময় গেছে, কিন্তু এখন ঢাকা তার চিরচেনা রূপে ফেরায় তার সঙ্গে মানিয়ে নিতেও অনেকের কষ্ট হচ্ছে।

তিনি বলছিলেন, ‘আমরা নিজেরাও কয়েকটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সাথে দেখা করারই সুযোগ পাইনি। তবে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক চর্চা চোখে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে।’

তিনি বলেন গত দু বছর ছিলো বিশেষ পরিস্থিতি। তবে যারা আনুষ্ঠানিক খাতে চাকুরী করেন বা শিক্ষা ক্ষেত্রে, তাদের জন্য এক ধরনের সময় গেছে। কিন্তু পোশাক কারখানা বা গণমাধ্যম বা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি।

‘অনেকে একটা শিথিল সময়ে অভ্যস্ত হয়েছেন। নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে যাওয়ার তাড়া ছিলো না। ফলে সময় ও খরচ বেঁচেছে। চলাফেরার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও কমেছে। এখন কিন্তু তার উল্টো’।

শামীম রেজার মতে নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতি আসলে কেমন হয় সেটা বুঝতে আরও কিছুটা সময় লাগবে।

বিকল্প চিন্তার দরকার কতটা?
শামীম রেজা বলছেন গত দু বছরে অনেক কাজেই এটা প্রমাণ হয়েছে যে ভার্চুয়ালি বা হোম অফিস করা সম্ভব এবং এখন নতুন স্বাভাবিক সময়ে এসে অফিসগুলো তার কাজের ধরণ অনুযায়ী কাজের বিন্যাস করতে পারে।

তিনি বলছিলেন ‘এটি করতে পারলে সবাইকে অফিসে আসার দরকার হবে না। যার প্রভাব পড়বে চলাফেরা থেকে শুরু করে পরিবার পর্যন্ত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও উদ্ভাবনী চিন্তার প্রয়োগ ঘটানো দরকার, বলছিলেন তিনি।

তিনি বলেন গত দু বছরে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে সাংস্কৃতিক চর্চা ব্যাপক বেড়েছে যেটিকে আরো এগিয়ে নেয়া সম্ভব।

সূত্র : বিবিসি