সৃষ্টির ভাঁজে স্র্রষ্টার হাসি

সৃষ্টির ভাঁজে স্র্রষ্টার হাসি

ছবি: সংগৃহীত

সৃষ্টির পরতে পরতে সুনিপুণ স্রষ্টার অস্তিত্ব লুকিয়ে আছে অতি সূক্ষ্মভাবে। সূক্ষ্মতার সেই মোড়ক যারা খুলতে জানে; তারাই জ্ঞানী, ‘উলুল আলবাব’। স্র্রষ্টাকে কেউ ধূলির ধরায় কখনো দু’চোখে দেখবে না। দু’হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারবে না। তাই বলে অস্বীকার করবে? সৃষ্টিকর্তা নাই বলে বাগাড়ম্বর করবে? সেটা বোকামি হবে। তিনি দুনিয়ায় মানুষ পাঠিয়েছেন পরীক্ষা করার জন্য। পরীক্ষার সাবজেক্ট নির্ধারণ করেছেন ‘ইবাদত’ তথা তাঁর আনুকূল্য। সেটি করণীয়-বর্জনীয় দু’টিই হতে পারে। স্রষ্টাকে না দেখে, না ছুঁয়ে, তাঁর কথা সম্মুখভাবে না শুনে, তাঁর প্রতি বিশ্বাস আনয়ন- সেই সাবজেক্টেরই একটি অংশ। অতএব দেখা, ছোঁয়া কিংবা কথা বলা বা শুনা না গেলেই তাঁকে অস্বীকার করতে হবে সেটাও বিবেকগ্রাহ্য কথা নয়। এই বিশ্ব চরাচরে কত কিছুই দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না; তাই বলে কি বস্তুটির অনস্তিত্ব আবশ্যক হয়? বাতাস কে দেখেছে! কার সাধ্য আছে তাকে স্পর্শ করার! টক, মিষ্টি, ঝাল, ঠাণ্ডা, গরম, জ্ঞান, বুদ্ধি, লাল, কালো, আরো কত কি বস্তুগুণ- এসবের কোনোটি কেউ বস্তু থেকে আলাদা করে দেখতে পেরছে? ধরতে পেরেছ? অসম্ভব! কেবলই অসম্ভব! তারপরও কি কেউ মরিচের ঝাল, তেঁতুলের টক কিংবা চিনির মিষ্টতা অস্বীকার করে? বায়ুর চাপ চারদিকে না থাকলে তো আমরা ভারসাম্যই হারাতাম।

সুতরাং দেখতে না পাওয়া, ধরতে না পারা বস্তুর অস্তিত্বহীনতাকে আবশ্যক করে না। কোথাও ধোঁয়া উড়লে মনে হয় না আগুন আছে? ধুলো উড়লে বোঝা যায় না বাতাস বইছে? চেহারা দেখেই তো বলতে পারেন ভেতরে কষ্ট নাকি দুঃখ লুকিয়ে আছে। চোখে জল, ব্যথার জন্যই আসে। এতসব নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। শীত-গরমের অনুভব দিব্যি বুঝেন। কিছু দিন আগেই চীনারা মঙ্গল গ্রহ থেকে মাটি কালেক্ট করেছে। উদ্দেশ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জলীয় কণার উপস্থিতি অনুধাবন। কারণ পানি বা জল সব প্রাণওয়ালা বস্তুর মূল। আর কুরআনও সে কথাই বলেছে, ‘ওয়া জায়ালনা মিনাল মায়ি কুল্লøা শাইয়িন হাইয়িন (সূরা আম্বিয়া-৩০) পানির সন্ধান মিললে মঙ্গলে কখনো প্রাণের অস্তিত্ব ছিল বলে ধারণা পাওয়া যাবে। কত দূরের গবেষণা দিয়ে কী বুঝতে চায়? চিন্তাশক্তির কতটা উৎকর্ষ সাধন মানুষ করেছে তা এই প্রজন্মের কাছে বলার অপেক্ষা রাখে না। কী শিক্ষা, কী চিকিৎসা কিংবা বাসস্থান, যোগাযোগব্যবস্থা অথবা প্রযুক্তির আধুনিকায়ন, মহাকাশযান, মারণাস্ত্র কোনটাতে মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত কাজের প্রশংসনীয় ভূমিকা না আছে!

কিন্তু এত বুদ্ধিমান হয়েও মানুষের বিরাট একটি অংশ গবেষণায় আল্লøাহকে খুঁজে পান না। তাকে দেখতে চান, ছুঁতে চান, তাঁর সাথে কথা বলে তাঁর ক্ষমতা পরিমাপ করে তাঁকে মানতে চান। দৃশ্যমান না হলে স্র্রষ্টাকে তারা মানতে নারাজ। কিন্তু তারা একবারো চিন্তা করে না যে, সে চাইলেই তার দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে দেখা করতে পারে না। কারণ রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে দেখা করতে বিষেশ পদ-ক্ষমতা দরকার হয়। একইভাবে আল্লাহর সাথে দেখা করা বা কথা বলার জন্য বিষেশ ক্ষমতা দরকার। যা আল্লাহ সাধারণ মানুষকে দেননি। তাঁকে দেখার জন্য উপযুক্ত চোখ দরকার, দেহ দরকার। তাঁর কথা শোনার জন্য ‘হিয়ারিং রেঞ্জ’ উপযুক্ত মাত্রায় থাকা প্রয়োজন। কিন্তু চরম বাস্তবতা হলো- মানুষ বড়ই দুর্বল। ঘরে থাকা মুরগির বাচ্চাদের দিকে থাকালেই মানুষের অসহায়ত্বের চিত্র ফুটে ওঠবে। ডিম থেকে টেনে হিঁচড়ে বেরিয়ে, অল্পক্ষণের মধ্যে তারা চমক দেখায়! হাঁটতে শুরু করে! খাবারের জন্য মাটিতে বার বার চঞ্চু লাগায়! মাকে চিনে তার পিছু পিছু দৌড়ায়! এগুলো কমন দৃশ্য।

সৃষ্টিজগতে এমন লাখো কোটি নমুনা আপনি খোঁজে পাবেন। কিন্তু একটি মানব শিশু সে তুলনায় কতটা দুর্বল তার ব্যাখ্যা নতুন করে দেয়ার দরকার আছে বলে মনে করি না। সামান্য বজ্রপাতে কানে তুলো দিয়ে রাখে। আওয়াজ ১৮০ থেকে ২০০ ডেসিবলের হলেই জানি মানুষ মারা যায়। হায়রে দুর্বল চোখ, কান আর দেহের মালিক! এরপরও এত অহঙ্কার! এত বাহাদুরি! আল্লøাহকে দেখার আবদার! তাকে স্পর্শ করা যায় না! তাঁর কথা শোনার এত বাসনা! হ্যাঁ, এসব খায়েসও পূরণ হবে একদিন। এখানে নয়, ওখানে। ইহকালে নয়, পরকালে- জান্নাতে। এখানে কেবল ভাবতে হবে সৃষ্টিকে নিয়ে। দেখতে হবে তার বৈচিত্র্যময়তাকে। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘বিশ^াসীদের জন্য পৃথিবীতে আছে বহু নিদর্শন। (এমনকি হে মানুষ) তোমাদের নিজেদের মধ্যেও (সূরা জারিয়াত : ২০-২১)। ‘তবে কি তারা তাকায় না উটের প্রতি, কিভাবে (বিস্ময়রূপে) তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে! দেখে না আকাশ কিভাবে (খুঁটিহীন) সমুন্নত করা আছে! পাহাড় দেখে না কিভাবে (মজবুত করে জমিনের পেরেক হিসেবে) স্থাপন করা! ওরা জমিন দেখুক কিভাবে তাকে বিছানো হয়েছে! (মানুষ ও জন্তু-জানোয়ারের বসবাস উপযোগী করে) (সূরা গাশিয়াহ : ১৭-২০)। উল্লেøখ্য, এখানে দেখা বলতে চিন্তা-গবেষণার কথা বলা হয়েছে। সূরা মুলকে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি স্তরে স্তরে সপ্তাকাশ সৃষ্টি করেছেন। তুমি কি তাতে কোনো অসঙ্গতি দেখছ? আবার দৃষ্টি দাও, কোনো ফাটল পেয়েছ? (মেরাজের রাতে নবীজী আকাশমালা ঘুরে এসেছেন সুতরাং কেউ কি সব আসমান দেখেছে এ প্রশ্ন অবান্তর) বারবার তাকাও তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও পরিশ্রান্ত হয়ে তোমার কাছেই ফিরে আসবে (কিন্তু আল্লøাহর সৃষ্টিতে খুঁত পাবে না)। তারা কি লক্ষ করে না, মাথার উপর দুই পাখা বিস্তার ও সঙ্কোচন করে পাখিরা কিভাবে উড়ে বেড়ায়? দয়াময় আল্লøাহই তাদের স্থির রাখেন। তিনিই সর্বদ্রষ্টা (আয়াত : ৩, ৪ ও ১৯)। পরিশেষে বলব-

‘সৃষ্টির ভাঁজে স্র্রষ্টা হাসেন; দূরে নয় তিনি কাছেই থাকেন। ভাবো দমেদম স্মরো হরদম; তিনি প্রিয়তম বড়, অনুপম!’

লেখক: আবদুল আউওয়াল

-শিক্ষক, কবি ও ইসলামী গবেষক