শিশু কন্যাকে মাসের পর মাস যৌন নির্যাতনের অভিযোগ, পিতা গ্রেপ্তার

শিশু কন্যাকে মাসের পর মাস যৌন নির্যাতনের অভিযোগ, পিতা গ্রেপ্তার

শিশু কন্যাকে মাসের পর মাস যৌন নির্যাতনের অভিযোগ, পিতা গ্রেপ্তার

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি জেলা বরগুনায় চার বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে বাবার বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় একটি মামলা দায়েরের পর অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।ভুক্তভোগী শিশুটির মা এজাহারে উল্লেখ করেছেন, তার অনুপস্থিতিতে গত পাঁচ-ছয় মাস ধরে শিশুটির পিতা ধর্ষণ করে আসছিল। চার বছর বয়সী শিশুটি সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন তিনি স্বামীর বিরুদ্ধে মেয়েকে ধর্ষণের মামলা করেন।

এজাহারে পাঁচ ছমাস ধরে ধর্ষণের অভিযোগ করলেও শিশুটির মা বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''দেড়-দুই বছর ধরে আমার মেয়েকে সে ধর্ষণ করে আসছে। মেয়ে তো পুরোপুরি বলতে পারে না, প্যান্ট খুলে বলতো, এখানে বাবা ব্যথা দিয়েছে।''''আমি শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে জানিয়েছি, তারা বলে, মেয়ের ভবিষ্যৎ আছে, চুপচাপ থাকো। এ নিয়ে এলাকার চৌকিদার, চেয়ারম্যানকেও জানিয়েছি। থানায় গেছি, কেউ আমার কথা শোনেনি।''

তিনি জানান, ছয় মাস আগে সর্বশেষ মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়। এরপর থেকে তার যৌনাঙ্গে ক্ষতের তৈরি হয়। সেই ক্ষত চিকিৎসা করাতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর শিশুটিকে ধর্ষণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সোমবার রাতে পুলিশ হাসপাতালে এসে তার বক্তব্য গ্রহণ নিয়ে মামলা নেয়।

সেদিন রাতেই শিশুটির পিতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি একজন শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন।এখন শিশুটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।চিকিৎসকরা তার যৌনাঙ্গে ক্ষত ও ধর্ষণের আলামত পেয়েছেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন।

বরগুনার পুলিশ সুপার মুহম্মদ জাহাঙ্গীর মল্লিক বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ''শিশুটি এখন চিকিৎসাধীন রয়েছে। সেখানকার চিকিৎসকরা আমাদের জানিয়েছেন, শিশুটিকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে পরীক্ষায় দেখতে পেয়েছেন। আমরা মেয়েটির মায়ের অভিযোগ ও ডাক্তারের মতামতকে গ্রহণ করেই সামনে এগোচ্ছি।''তিনি জানান, এই ঘটনায় মামলা হওয়ার পর শিশুটির পিতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

শিশুটির মা অভিযোগ করেছেন, এর আগেও এই ঘটনায় প্রতিকার চেয়ে তিনি স্থানীয় থানায় গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই থানার ওসি তার অভিযোগ গ্রহণ না করে থানা থেকে বের করে দিয়েছেন।অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওই থানার ওসি। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ''তিনি এর আগে তো আমার কাছে আসেন নাই। এটা তো সেনসিটিভ একটা অভিযোগ, আসলেই তো আমি অভিযোগ নিয়ে ব্যবস্থা নিতাম।''

বরগুনার পুলিশ সুপার মি. মল্লিক জানাচ্ছেন, এই অভিযোগ তারাও পেয়েছেন। একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে অভিযোগটি তদন্ত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।''তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেলে যে সুপারিশ দেবেন, সেই অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে,'' বলছেন মি. মল্লিক।অভিযুক্ত পিতা পুলিশ হেফাজতে থাকায় তার কোন বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

শিশু নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কিনা কী করে বুঝবেন?

বাংলাদেশে পরিবারের সদস্য বা নিকটআত্মীয়দের দ্বারা শিশু নির্যাতনের ঘটনা গণমাধ্যমের খবর হতে দেখা যায় প্রায়ই।বাংলাদেশে শিশু অধিকার কর্মীদের ভাষ্যমতে, দেশটির শতকরা নব্বই ভাগ শিশুই পারিবারিক গণ্ডিতে ধর্ষণ থেকে শুরু করে অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক স্পর্শসহ নানা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে।কোনও কোনও ক্ষেত্র নিকটাত্মীয় বিশেষ করে, বাবা, চাচা, কিংবা ভাইয়ের হাতেও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে শিশুরা।

ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সিল সেন্টারের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ইশরাত শারমিন রহমান বলেন, তিনি তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় দেখেছেন শিশুরা বাইরের মানুষের দ্বারা নয় বরং পরিবারের খুব কাছের মানুষদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

তিনি বলেন, "এটা অনেক দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে শিশুরা অপরিচিত ব্যক্তিদের চেয়ে বেশি নির্যাতিত হয় পরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা। এক্ষেত্রে বড় ভাই, কাজিন, চাচা, ফুফু, টিউটর, বাড়ির দারোয়ান বা কাজের লোক এরকম যেকোন ব্যক্তির দ্বারাই নির্যাতনের শিকার হবার আশঙ্কা থাকে"।

এসব ক্ষেত্রে শিশুর আচরণের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। যেমন:

১. কোন একটা নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে শিশু যদি যেতে ভয় পায় বা যেতে না চায়।

২. যেসব শিশুরা বিছানায় প্রস্রাব করা বন্ধ করে দেয় (৫ বছরের মধ্যে বাচ্চারা বিছানায় প্রস্রাব করা বন্ধ করে দেয়) তারা যদি হঠাৎ বিছানায় প্রস্রাব করে দেয়।

৩. যদি সে তার যৌনাঙ্গে ব্যথার কথা বলে।

৪. শিশু হঠাৎ করে ভয় পাচ্ছে কিনা, চমকে উঠছে কিনা, অন্ধকার ভয় পায় কিনা এই বিষয়গুলো লক্ষ্য করতে হবে।

৫. বাচ্চা হঠাৎ করে বিরক্ত হচ্ছে কিনা, মেজাজ খারাপ করছে কিনা, ছোট ছোট বিষয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে কিনা, টেনশন করছে কিনা এসব দিকগুলো খেয়াল করতে হবে।

৬. অনেক সময় বাচ্চারা নিজেদেরকে গুটিয়ে নেয়, একা একা থাকে, মন খারাপ থাকে।

৭. কোন কাজে মনোযোগ দিতে না পারা, পড়ালেখাতে মনোযোগ না থাকা, দৈনন্দিন কাজে আগ্রহ না থাকা।

৮. অনেক সময় নির্যাতনের শিকার শিশু নিজের যৌনাঙ্গে হাত দিতে থাকে আবার অন্য বাচ্চাদের যৌনাঙ্গে হাত দিয়ে থাকে।

অভিভাবকদের করণীয়:

শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন অনেক ক্ষেত্রে একটা শিশু নিজেই বুঝতে পারে না কোনটা নির্যাতন।নির্যাতনকারীরা খেলার ছলে অনেক শিশুকে নির্যাতন করে, শিশুরা তখন মনে করে এটা একটা খেলা।ইশরাত শারমিন রহমান বলেন, আবার নির্যাতনকারীরা নির্যাতনের পর শিশুকে ভয় দেখায়।তিনি বলেন "বলে দিলে তোর বাবা বা মাকে মেরে ফেলবো" এমন কথা বলে শিশুকে ভয় দেখানো হয়।

শিশু তার বাবা -মাকে বলতে না পারার পিছনে আরেকটা কারণ কাজ করে সেটা হল বাবা-মায়েরা বিশ্বাস করতে চায় না। এসব ক্ষেত্রে বাবা-মাকে যেটা করতে হবে:

১. 'গুড টাচ-ব্যাড টাচ' নামে যে ধারণা আছে সেটার সাথে বাচ্চাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ কোন স্পর্শ ভালো, কোনটা খারাপ সেটা শিশুকে বোঝাতে হবে।

২. মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে বুক, ঠোঁট, যৌনাঙ্গ এবং পশ্চাতদেশ-ছেলে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ঠোঁট, যৌনাঙ্গ এবং পশ্চাতদেশ এসব জায়গাকে স্পর্শকাতর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই দুই বছর বয়স থেকে শিশুকে শরীরের এসব অঙ্গ সম্পর্কে ছবি একে বা গল্পের মাধ্যমে ধারণা এবং সচেতন করতে হবে। কিছুদিন পরপর তাদেরকে বিষয়টা মনে করিয়ে দিতে হবে।

৩. পরিবারের নির্দিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া কেউ তার শরীরের এসব স্থানে হাত দিতে পারবে না এটা তাকে বলতে হবে, সেক্ষেত্রে বাবা-মা হতে পারে।

৪. যদি শরীরের এই অঙ্গগুলো কেউ স্পর্শ করে তাহলে তাৎক্ষনিক শিশুটি চিৎকার করতে পারে, চলে আসতে পারে, এবং যাকে পাবে তার কাছে বলে দিতে হবে। আর যখন বাবা-মাকে কাছে পাবে তখনি তাদেরকে সব খুলে বলবে-এটা শেখাতে হবে।

৫. বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকে মন খুলে কথা বলা শেখাতে হবে, তারা যখন কিছু বলবে তখন বকাঝকা না করে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে যৌন নির্যাতনের মত যে ঘটনাগুলো আছে সেগুলো ভয় না পেয়ে তারা বাবা-মায়ের সাথে শেয়ার করতে পারবে।

৬. নির্যাতনের ঘটনা যদি ঘটে তাহলে কখনো বাচ্চাকে দায়ি করা যাবে না। তাকে মানসিক সমর্থন করতে হবে, তার সামনে এই ঘটনা নিয়ে বার বার আলোচনা করা বা কান্নাকাটি করা যাবে না।

ইশরাত শারমিন রহমান বলেন এছাড়া বাচ্চারা তাদের বাবা-মায়ের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক অনেক সময় দেখে ফেলে।"সেটা দেখে তারা আগ্রহের বশবর্তী হয়ে অন্য বাচ্চাদের সাথে সেটা করতে চায়। এটাতেও যৌন নির্যাতনের শিকার হয় শিশুরা" বলেন তিনি।

সূ্ত্র : বিবিসি