ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় পুলিশ কী লিখতে পারে, কী পারে না

ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় পুলিশ কী লিখতে পারে, কী পারে না

ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় পুলিশ কী লিখতে পারে, কী পারে না

সিলেটে পুলিশের একজন কর্মকর্তাকে সম্প্রতি প্রথমে প্রত্যাহার ও পরে বদলি করা হয়েছে, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি একটি ভাইরাল ইস্যু নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদকারী একটি পক্ষকে কটাক্ষ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন এবং সমালোচনার শিকার হয়েছেন।

ভাইরাল ইস্যুটি হচ্ছে, ঢাকায় একজন নারী শিক্ষকের কপালে টিপ পরার কারণে একজন পুলিশ সদস্যের হাতে হেনস্থা হওয়ার ঘটনা। ওই ঘটনাটি ঘটবার পর থেকেই নারীদের পাশাপাশি অনেক পুরুষও ফেসবুকে নিজেদের টিপ পরিহিত ছবি প্রকাশ করছিলেন।

এই টিপ ইস্যু নিয়েই ঢাকার আরেকজন পুলিশ কর্মকর্তা ফেসবুকে একটি ছবি প্রকাশ করেছেন, যেখানে একটি কুকুরের কপালে টিপ দেয়া হয়েছে পরে অবশ্য তিনি ছবিটি মুছে ফেলেন এবং নিজের ফেসবুক পাতায় ক্ষমা প্রার্থনা করে একটি পোস্ট দেন।

এর আগেও কয়েকটি ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট বা কমেন্ট করে আলোচনায় এসেছিলেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য, যে কারণে প্রশ্ন উঠেছে যে সামাজিক মাধ্যমে পুলিশ সদস্যরা কী করছেন সেটি দেখভালের কোন ব্যবস্থা আছে কি-না।ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ফারুক হোসেন বিবিসিকে বলেছেন, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে এ সংক্রান্ত গাইডলাইন দেয়া হয়েছে এবং সেটিই সব পুলিশ সদস্যকে ফলো করতে হয়।

তিনি বলেন কেউ এ নির্দেশনা অমান্য করলে তা দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নেয়া হয়।সরকারি চাকুরীজীবীদের সোশ্যাল মিডিয়া গাইডলাইনসরকারি কর্মকর্তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের বিষয়ে বাংলাদেশে ২০১৬ সালে প্রথম একটি নির্দেশিকা জারি করেছিলো মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ।

পরে ২০১৯ সালে সেটি আরও পরিমার্জন করা হয়।

এ নির্দেশিকায় সামাজিক মাধ্যমের আওতায় ব্লগ, মাইক্রোব্লগস, ফেসবুক, টুইটার, গুগল প্লাস, স্কাইপ, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যাল, ইউটিউব, উইচ্যাট, ইনস্টগ্রাম, ম্যাসেঞ্জার ও ইমোর কথা উল্লেখ করা হয়।

এ নির্দেশনায় সরকারের বিভিন্ন দাপ্তরিক অ্যাকাউন্ট ও ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট ব্যবস্থাপনার বিষয়টি বলা হয়।এতে জাতীয় ঐক্য ও চেতনা পরিপন্থী, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে, রাজনৈতিক মতাদর্শ, কোন ব্যক্তি, রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানকে হেয় করা, আত্মপ্রচারণা মূলক পোস্ট বা অসত্য ও অশ্লীল তথ্য প্রচার না করতে বলা হয়।

তবে ফারুক হোসেন বলছেন পুলিশ বাহিনীর কাজের ধরণ কিছুটা ভিন্ন হওয়ায় সরকারি নির্দেশনার আলোকেই পুলিশ সদস্যদের জন্য যথোপযুক্ত গাইডলাইন তৈরি করেছিলো।

সামাজিক মাধ্যমে আলোচিত কয়েকটি পোস্ট

কপালে টিপ পরা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে কটাক্ষ করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় সিলেটে এক পুলিশ পরিদর্শককে প্রত্যাহার করা হলেও এ ধরণের ঘটনা নতুন নয়।এর আগে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে হেফাজত ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক নারীসহ অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনায় ফেসবুক লাইভ করে আলোচনায় এসেছিলেন এক পুলিশ সদস্য। তার বক্তব্য ভাইরাল হলে পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

তারও আগে জাতীয় সংসদের একজন হুইপের নাম উল্লেখ করে তিনি একটি ক্লাবের জুয়ার আসর থেকে ১৮০ কোটি টাকা আয় করেছেন - এমন অভিযোগ এনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন পুলিশের পরিদর্শক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। এ ঘটনায়ও তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

সামাজিক মাধ্যমের বিষয়ে কী আছে পুলিশের গাইডলাইনে

গত ২২শে ফেব্রুয়ারি 'বাংলাদেশ পুলিশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার নির্দেশিকা, ২০২২' পুলিশের সব ইউনিটে পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয় পুলিশ সদর দপ্তর।

এ নির্দেশিকা প্রকাশের যুক্তি হিসেবে বলা হয়- "বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যগণ পেশাগত এবং ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করেন। তবে পেশাদারিত্বের সাথে ব্যবহার করা না হলে বিষয়টি পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে পারে"।এতে আরও বলা হয়েছিলো যে পুলিশ বাহিনীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও এর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতের মাধ্যমে যে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়ানোর স্বার্থে এ নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়েছে।

পুলিশ যা করতে পারবে না

সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের এই গাইডলাইনে বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে যেগুলো বিবেচনায় নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করতে হবে পুলিশ সদস্যদের। এর মধ্যে আছে:

•রাষ্ট্র, সরকার বা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এরকম কোন পোস্ট, ছবি, ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, ট্যাগিং, রেফারেন্সিং বা শেয়ার করা যাবে না।

•জাতীয় ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থী কোন রকম কমেন্ট করা কিংবা কন্টেন্ট আপলোড করা যাবে না।

•ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে এমন বা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পরিপন্থী কোন কমেন্ট বা কন্টেন্ট আপলোড করা যাবে না।

•রাজনৈতিক মতাদর্শ, জঙ্গি কর্মকাণ্ড অথবা ধর্মীয় উগ্রবাদ সংশ্লিষ্ট কোন কমেন্ট বা কন্টেন্ট আপলোড করা যাবে না।

•বাংলাদেশে বসবাসকারী কোন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক, বিদ্বেষমূলক বা হেয় প্রতিপন্নমূলক কমেন্ট বা কন্টেন্ট আপলোড করা যাবে না।

•সরকারের সমালোচনা, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকার বা রাষ্ট্রকে হেয় প্রতিপন্ন করে এমন কমেন্ট বা কন্টেন্ট আপলোড করা যাবে না।

•মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে কোন প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণামূলক কমেন্ট বা কন্টেন্ট আপলোড করা যাবে না।

•লিঙ্গ বৈষম্য বা এ সংক্রান্ত বিতর্কমূলক কমেন্ট বা কন্টেন্ট আপলোড করা যাবে না।

•জনমনে অসন্তোষ বা অপ্রীতিকর মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে এমন কোন বিষয় লেখা, অডিও বা ভিডিও প্রকাশ করা যাবে না।

•চিহ্নিত, অভ্যাসগত অপরাধী বা এরূপ কোন বিতর্কিত কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের সাথে ছবি তোলা ও পোস্ট করা যাবে না।

•দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ইউনিট প্রধানের অনুমতি ছাড়া তদন্তাধীন বা বিচারাধীন বিষয়ে কোন ভিডিও, স্থিরচিত্র, অডিও বা তথ্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না।

•পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে মোবাইল ফোন ও ক্যামেরার যথেচ্ছভাবে অপারেশনাল কার্যক্রমের ভিডিও, স্থিরচিত্র বা অডিও ধারণ করা যাবে না। তবে অবৈধ মাদক, অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ ইত্যাদি উদ্ধার এবং ক্রাইম সিনের ভিডিও বা স্থিরচিত্র ধারণ করা যেতে পারে। এসকল তথ্য ধারণের মূল উদ্দেশ্য হবে বিচারিক কাজে সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার। কোন অবস্থাতেই উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ব্যতীত এ সকল তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড, শেয়ার বা পোস্ট করা যাবে না।

•ইন্টারনেটে অপ্রীতিকর কিছু সার্চ করা বা নিষিদ্ধ কোন সাইটে প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

•পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ব্যক্তিগত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার পরিহার করতে হবে।

•গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, অস্ত্রশস্ত্রের মতো সরঞ্জামের ভিডিও, স্থিরচিত্র বা অডিও ধারণ করা যাবে না।

•গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনর দায়িত্ব পালন কালে ব্যক্তিগত বা অফিসিয়াল মোবাইলে জিপিএস বা লোকেশনাল সার্ভিস চালু রাখা যাবে না।

যেভাবে মনিটর করা হয়

সিলেটে যে পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে, কিংবা অন্য যেসব পুলিশ সদস্যের বিভিন্ন পোস্টের কথা এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেখা যাচ্ছে তাদের প্রত্যেকেই পুলিশের জন্য তৈরি এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের নির্দেশিকার শর্ত ভঙ্গ করেছেন।ডিএমপির মুখপাত্র ফারুক হোসেন বলেন পুলিশের প্রতিটি বিভাগে একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে টিম আছে সামাজিক মাধ্যম মনিটর করার জন্য এবং কোন পুলিশ সদস্য গাইডলাইন ভঙ্গ করলে তিনি যেই হোন না কেন তদন্ত করে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়।ইউনিট প্রধানগণ তাদের ইউনিটের সদস্যদের সামাজিক মাধ্যমের তথ্য সংরক্ষণ ও নিয়মিত মনিটর করে থাকেন।

কেউ এর ব্যত্যয় করলে সেটির স্ক্রিনশট ও ডিভাইস ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে পাঠান তারা।মনিটরিংয়ের জন্য প্রয়োজন বিশেষায়িত ফোর্স বা প্রশিক্ষিত কর্মকর্তাদের সহায়তা নেয়ার সুযোগ আছে।পুলিশ সদর দপ্তরের গাইডলাইন অনুযায়ী এসব নির্দেশনা পালনে কেউ ব্যর্থ হলে সেটিকে তার অসদাচরণ ও অদক্ষতা হিসেবে গণ করা হবে।এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও প্রয়োজন হলে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সূত্র : বিবিসি