মাইন্ড ট্রেনার সাবিত রায়হান যেভাবে বদলে দিচ্ছেন তাসকিন-সাব্বিরদের

মাইন্ড ট্রেনার সাবিত রায়হান যেভাবে বদলে দিচ্ছেন তাসকিন-সাব্বিরদের

মাইন্ড ট্রেনার সাবিত রায়হান যেভাবে বদলে দিচ্ছেন তাসকিন-সাব্বিরদের

'কোনও ক্রিকেটার যদি দক্ষ হন তবেই তাকে মন মানসিকতার ট্রেনিং দেয়া যায়'- এমনটাই জানাচ্ছেন ক্রিকেটারদের মাইন্ড ট্রেনার সাবিত রায়হান।

তার কথায়, "এখানে একজন ক্রিকেটার নিজে যা পারেন সেটা সামনে থাকবে, ব্যাক অফ দ্য মাইন্ডে যেটা চলছে সেটা চেষ্টা করি যাতে নেতিবাচক কিছু না হয়।"

সাবিত রায়হান কাজ করছেন সাব্বির রহমান আর তাসকিন আহমেদের মতো ক্রিকেটারদের নিয়ে। তবে কেবল তারাই নন, বাংলাদেশের বেশ ক'জন ক্রিকেটার সম্প্রতি এই মাইন্ড ট্রেনারের শরণাপন্ন হয়েছেন।জানা গেছে, তাসকিন আহমেদ অনেক দিন ধরেই এই মাইন্ড ট্রেনারের কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এখন সাব্বির রহমান, এনামুল হক বিজয়, নুরুল হাসান সোহান ও সৌম্য সরকারও সাবিত রায়হানের সাথে কাজ করছেন।

এই বিশেষজ্ঞের মতে, শরীর আর মন একই সাথে কাজ করে। এই দুটোর সমন্বয় হলেই মানুষ নিজের মধ্য থেকে সেরা কাজটা বের করে আনতে পারে।সাবিত রায়হান বলেন যে ফলাফলই মুখ্য নয় এখানে।

"একদিন একজন পেশাদার মানুষ সফল হবেন আরেকদিন যাবে এভারেজ। এটা দিয়ে আমার কাজের পুরোপুরি মূল্যায়নটা হবে না। এটা শুধু খেলার মাঠে প্রভাব ফেলে তা নয়, এটা একটা মানুষকে ভাবতে সহায়তা করে। অনেক সময়ই দেখা যায় আমরা স্থির থাকতে পারি না কোনও একটা বিষয়ে চিন্তা করতে গিয়ে।"সাবিত রায়হানের মতে, এই চিন্তার অস্থিরতা দক্ষতা আর কার্যকারিতার মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি করে।

এই দূরত্ব মেটানোই তার কাজ বলে জানান তিনি।সাব্বির রহমান দীর্ঘদিন ধরে ছিলেন অফ ফর্মে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ থেকে শুরু করে ঘরোয়া ক্রিকেটের নানা পর্যায়ে কোনও ভাবেই ব্যাটে রান পাচ্ছিলেন না এই ডান হাতি ব্যাটসম্যান।

এবারে তিনি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে পেয়েছেন সেঞ্চুরি। এই একটি সেঞ্চুরি খুব বেশি কিছু প্রমাণ না করলেও সাব্বিরের মতে, 'তিনি ফোকাসটা রাখতে পারছেন'।সাবিত রায়হান মূলত এই মনোযোগ ধরে রাখার কাজটা করতেই তাদের সাহায্য করছেন।

তাসকিন আহমেদের পিতা আব্দুর রশীদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "তাসকিন কী পরিমাণ কষ্ট করেছে সেটা শুধু আমরা দেখেছি। বাবা হিসেবে বলছি না, সে আসলেই ভিন্ন একটা ফরম্যাটে ট্রেনিং করেছে।"

মানসিক ট্রেনিং

তাসকিন বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সরব। ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টিকটকে তার নিয়মিত উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।যখন তিনি ব্যর্থ হতেন, তখন অনেকেই এসব সোশাল মিডিয়ায় তীর্যক মন্তব্য করতেন। তাসকিনের বাবা মনে করেন, তার ছেলে জন্য এই খারাপ সময়টা পেরিয়ে আসাই ছিল বড় ব্যাপার।

তাসকিন নিজেকে সামলেছেন মানসিক ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে।দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই দেশের মাটিতেই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জয়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেন তাসকিন আহমেদ।

"তাসকিন যে শুধু একা কষ্ট করে তা না, কিন্তু তাসকিনেরটা আপনারা দেখতে পান কারণ ও ভিডিও আপলোড দেয়," ওই সিরিজ শেষ হওয়ার পর তামিম ইকবাল অনেকটা মজা করেই বলেছিলেন একটি সংবাদ সম্মেলনে।সাবিত রায়হান বলেন, এটা মাথায় রাখা দরকার যে কষ্ট সবাই করে। ক্রিকেট পরিশ্রমের খেলা, মাঠে যে কোনও খেলাই পরিশ্রমের। এই পরিশ্রমটা যাতে খুব ঠাণ্ডা মাথায় সফলতায় রূপ দেয়া যায়, সেটাই আসলে আমাদের চেষ্টা থাকে।

তাসকিন আহমেদও মনে করেন ক্রিকেট খেলায় যারা আসেন তারা সবাই নির্দিষ্ট কিছু কাজে দক্ষ। "বোলিং, ব্যাটিং বা ফিল্ডিংটা সবাই কম বেশি পারেন। কিন্তু আমার চেষ্টা ছিল নিজের লক্ষ্যটা ঠিক রাখা। তবে অনেক সময় মন স্থির রাখা কঠিন হয়ে যায়।"তাসকিন নিজের সাম্প্রতিক সাফল্যের পেছনে বাংলাদেশের ফিটনেস ট্রেনারদের ভূমিকা দেখছেন - বিসিবির ফিটনেস ট্রেনার দেবাশীষ চৌধুরী এবং সাবিত রায়হানের কথা তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।

"সাবিত ভাইয়ের সাথে আমার অনেক দিনের যোগাযোগ। উনি আমার ব্যাপারগুলো বোঝেন। আমারও মনে হয় যে উনার সাথে বসলে, কথা বললে হালকা লাগে আমার।"তাসকিন আহমেদ সম্প্রতি চোটের কারণে মাঠের বাইরে আছেন। আজ জানিয়েছেন চিকিৎসার জন্য শীঘ্রই তিনি যুক্তরাজ্য যাবেন।

সৌম্য সরকার

সাবিত রায়হানের সাথে কাজ করছেন জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া ব্যাটসম্যান সৌম্য সরকারও।এক সময় তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেটে অন্যতম উদীয়মান তারকা হিসেবে বিবেচিত ছিলেন।সেই গোড়ার দিকে ২০১৪-১৫ সালে যখন তিনি কেবল পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেন, তখন অনেকেই মনে করছিলেন যে তিনি আগামী দিনের তারকা হতে যাচ্ছেন। পাকিস্তান আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তার ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্লেষক ও ক্রিকেট সমর্থকেরা।

কিন্তু সামর্থ্য আর বাস্তবতার মধ্যকার ফাটল ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, ফলে সৌম্য সরকার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ চলাকালীন মোহামেডানের একাদশ থেকেও বাদ পড়েন।সাত ম্যাচে একশো'র মতো রান করে তিনি অনেক ক্রিকেটারের মেন্টর নাজমুল আবেদীন ফাহিমের কাছে গিয়েছিলেন।

বিসিবির সাবেক এই ন্যাশনাল কোচ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "ব্যর্থ হতে হতে সৌম্য অনেক ক্ষেত্রে একটু বাড়তি চেষ্টা করেছেন, যা তার জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। কিছু ছোট ছোট কাজ করলেই হয়তো তার জন্য ভালো হতো।"বাংলাদেশের সাবেক কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের প্রিয় শিষ্য ছিলেন সৌম্য সরকার, তার সময়ে সফলতাও পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সৌম্যর ব্যাটে রান দেখা যায় কদাচিৎ।

খেলা ও মানসিক চাপ

নাজমুল আবেদীন ফাহিম মনে করেন, কোনও ক্রিকেটার যখন ব্যর্থ হতে থাকেন, তখন তার মধ্যে মানসিক চাপও তৈরি হতে থাকে।

"খেলার সময় আসল ফোকাস রাখাটা কঠিন হয়ে যায়। ব্যাটসম্যানদের পুরো মনোযোগ বলের ওপর দেয়া দরকার হলেও মিডিয়া, ক্রাউড, খারাপ সময়, ঠিক আগের বলে ব্যর্থ হওয়া, সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ হলে কী হবে - এসব ইস্যুও মনে ঘুরতে থাকে।"এসব চিন্তা থেকে দূরে থাকার জন্য মাইন্ড ট্রেনার সাহায্য করতে পারেন বলে মনে করেন মি. ফাহিম।সৌম্য সরকার তার পাশাপাশি মাইন্ড ট্রেনার সাবিত রায়হানেরও পরামর্শ নিচ্ছেন।

একে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন তিনি। "একটা জিনিস পরিষ্কার, ক্রিকেটাররা চাইছে ভালো পারফর্ম করতে আর তা করতে তারা সহায়তাও নিচ্ছে। এটা ভালো ব্যাপার।"বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের একজন মুখপাত্র বিবিসি বাংলাকে বলেন যে ক্রিকেটাররা যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজেদেরকে ডেভেলপ করার চেষ্টা করছেন এটি একটি ভালো দিক।

"বিসিবি প্রতিষ্ঠান হিসেবে খেলোয়াড়দের মানসিক দিকটা খেয়াল রাখার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু দিনশেষে একজন ক্রিকেটারের ব্যক্তিগত চিন্তা ও খেলা থেকে তিনি কী চান সেটাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তার খেলায়।"তাসকিন আহমেদকেই এখানে বড় উদাহরণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

সূত্র : বিবিসি