ইসলামে আত্মহত্যা হারাম

ইসলামে আত্মহত্যা হারাম

ইসলামে আত্মহত্যা হারাম

আত্মহত্যা বা আত্মহনন হচ্ছে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়াবিশেষ। চিকিৎসকরা আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে মানসিক অবসাদজনিত গুরুতর উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। ইতোমধ্যেই বিশ্বের অনেক দেশেই আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে অপরাধরূপে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রত্যেক ধর্মেই আত্মহত্যাকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ইসলামী দৃষ্টিকোণে আত্মহত্যা একটি জঘন্যতম মহাপাপ। আল্লাহ মানুষকে মরণশীল করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে একমাত্র আল্লাহই জন্ম দেন এবং একমাত্র তিনিই মৃত্যু ঘটান। কিন্তু আত্মহত্যার ক্ষেত্রে বান্দা স্বাভাবিক মৃত্যুকে উপেক্ষা করে মৃত্যুকে নিজের হাতে নিয়ে নিজেই নিজকে হত্যা করে ফেলে। এ কারণে এটি একটি গর্হিত কাজ; কবিরা গুনাহ। পবিত্র কুরআনে আত্মহত্যা করতে নিষেধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: নিজে কখনো আত্মহত্যাকারীর জানাজা পড়াননি, সাহাবিদের দ্বারা পড়িয়েছেন।

মানুষ কেন আত্মহত্যা করে : আত্মহত্যার বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। যেমন- ১. সাংসারিক কলহ-দ্বন্দ্ব; ২. অতিরিক্ত রাগ; ৩. কাক্সিক্ষত কোনো কিছু লাভ করতে না পারা; ৪. নিরাশ বা বঞ্চিত হওয়া; ৫. লজ্জা ও মানহানিকর কোনো কিছু ঘটে যাওয়া বা অপ্রত্যাশিতভাবে প্রকাশ হওয়া; ৬. অভাব ও দরিদ্রতার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার অসুখ-বিসুখে জর্জরিত হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

এ ছাড়া আরো যেসব কারণে এই কাজটি ঘটে- ১. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য; ২. যৌতুকের কারণে ঝগড়া বিবাদ; ৩. পিতা-মাতা ও ছেলে-মেয়ের মধ্যে মনোমালিন্য; ৪. পরীক্ষায় ব্যর্থতা; ৫. প্রেম-বিরহ; ৬. মিথ্যা অভিনয়ের ফাঁদ; ৭. ব্যবসায়ে ব্যর্থ হওয়া ইত্যাদি। যখন মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি, উপলব্ধি-অনুধাবনশক্তি লোপ পায়, নিজকে অসহায়-ভরসাহীন মনে হয়, তখনই মানুষ আত্মহত্যা করে বসে।

আল-কুরআনে যা বলা হয়েছে : আত্মহত্যার শাস্তি জাহান্নাম। সব ফিকাহবিদ এবং চার মাজহাবেই আত্মহত্যা হারাম। কারণ, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে মরণশীল হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন। ধনী-গরিব, বিদ্বান-মূর্খ, রাজা-প্রজা সবাইকে মরতেই হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে, তারপর আমার কাছেই তোমরা সবাই প্রত্যাবর্তিত হবে’।(সূরা আনকাবুত-৫৭)। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই মৃত্যু দান করেন। তিনি ছাড়া কেউ কাউকে মৃত্যু দিতে পারে না। ‘তিনিই জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান আর তাঁর কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন হবে’ (সূরা ইউনুস-৫৬)

মানুষের মৃত্যু ঘটানোর কাজটি একমাত্র আল্লাহরই। অতএব কেউ যদি কাজটি নিজের হাতে তুলে নেয়, সে অনধিকার চর্চাই করবে।আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা আত্মহত্যা করো না, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াশীল’ (সূরা আন-নিসা-২৯)।
‘তোমরা তোমাদের নিজেদের ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না’ (সূরা আল-বাকারা-১৯৫)।

‘তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ যাবতীয় অপরাধ মার্জনা করেন’ (সূরা জুমার-৫৩)।
হাদিসে যা বলা হয়েছে : জাবির বিন সামুরাহ রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা:-এর এক সাহাবি আহত হন। এর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তিনি তার তীরের ফলা দিয়ে আত্মহত্যা করেন। রাসূলুল্লাহ সা: তার জানাজার সালাত পড়াননি (তিরমিজি-১০৬৮, নাসায়ি-১৯৬৪)।

আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে অনুরূপভাবে আত্মহত্যা করতেই থাকবে এবং এটিই হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, বিষ তার হাতে থাকবে, জাহান্নামে সে সর্বক্ষণ বিষপান করে আত্মহত্যা করতে থাকবে। আর এটা হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। আর যে ব্যক্তি লৌহাস্ত্র দিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে লৌহাস্ত্রই তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সে তা নিজ পেটে ঢুকাতে থাকবে, আর সেখানে সে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে’ (বুখারি-৫৭৭৮ ও মুসলিম-২০০)।

সাবিত বিন যাহহাক রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো বস্তু দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, কিয়ামতের দিন তাকে সে বস্তু দিয়েই শাস্তি প্রদান করা হবে’ (বুখারি-১৩৬৩, মুসলিম-২০২, তিরমিজি-২৬৩৬ )।
মৃত্যু কামনাও বৈধ নয় : আত্মহত্যা তো দূরের কথা ইসলামী শরিয়তে মৃত্যু কামনা করতে পর্যন্ত বারণ করা হয়েছে। আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন কোনো বিপদে পতিত হয়ে মৃত্যু কামনা না করে। মৃত্যু যদি তাকে প্রত্যাশা করতেই হয় তবে সে যেন বলে, হে আল্লাহ আমাকে সে অবধি জীবিত রাখুন, যতক্ষণ আমার জীবনটা হয় আমার জন্য কল্যাণকর। আর আমাকে তখনই মৃত্যু দিন যখন মৃত্যুই হয় আমার জন্য শ্রেয়’ (বুখারি-৫৬৭১)।

আত্মহত্যাকারী কি চিরস্থায়ী জাহান্নামি : কেউ যখন নিজেকে হত্যা করে তখন সে নিজেকে মূলত আল্লাহর গজব ও ক্রোধের শিকারে পরিণত করে। তবে তার বিষয়টি আল্লাহর ইচ্ছাধীন। কারণ, তা কোনো শিরকি কাজ নয়। একমাত্র শিরকই এমন গুনাহ আল্লাহ যা ক্ষমা না করার ঘোষণা দিয়েছেন। ‘নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমা করেন না তাঁর সাথে শরিক করাকে এবং এ ছাড়া যাকে চান ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরিক করে সে তো ঘোর পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হলো’ (সূরা আন-নিসা-৪৮)।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে, সে চির জাহান্নামি হবে না। কোনো গুনাহগারই অনন্তকাল জাহান্নামে থাকবে না। খুনি, মদ্যপ কিংবা অন্য কোনো অপরাধীও নয়।

আত্মহত্যা একটি ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি। ইসলামে আত্মহত্যা মহাপাপ জেনেশুনেও যাদের পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষমতা দুর্বল, তারাই ধ্বংসাত্মক ও মর্মান্তিক ভ্রান্ত পথে পা বাড়ায়। মূলত ধৈর্যের অভাবেই মানুষের মাঝে এমন একটি মহাপাপের বিস্তার ঘটছে। এ ছাড়া শয়তানের কুপ্ররোচনা তো আছেই। সব বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে শয়তানের ধোঁকা থেকে বেঁচে ইসলামের আইন ও অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমেই শুধু এই মহাব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

লেখক : সহকারী শিক্ষক, মাস্টার তালেব উল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার।