ভারতে বিক্ষোভ দমাতে ড্রোন

ভারতে বিক্ষোভ দমাতে ড্রোন

ছবি: সংগৃহীত

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) বাতিলের দাবিতে ভারতজুড়ে চলমান বিক্ষোভ তৃতীয় সপ্তাহে গড়িয়েছে। হতাহতের ঘটনা তুলনামূলক কমে এলেও শুক্রবার দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা, চেন্নাইসহ দেশটির বড় বড় শহরে বিক্ষোভ দেখিয়েছে ছাত্র-জনতা। উত্তরপ্রদেশের ২১টি জেলায় ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

অস্ত্রধারী পুলিশ, আধাসামরিক বাহিনীর পাশাপাশি নজরদারিতে ব্যবহৃত হচ্ছে ড্রোন (মানুষবিহীন উড়োযান)। দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম বড় ধরনের চ্যালেঞ্জর মুখে পড়েছে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার। এরপরও জনদাবি উপেক্ষা করে কঠোর হাতে দমনের পথেই এগোচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দলটি।

এনডিটিভি ও টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, শুক্রবার জুমার নামাজকে ঘিরে দিল্লির জামা মসজিদসহ বিভিন্ন এলাকায় সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রশাসন। দিল্লি ছাড়াও মুম্বাই, চেন্নাই এবং উত্তরপ্রদেশের বেশির ভাগ এলাকায় সকাল থেকেই মোতায়েন ছিল অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য।

পুলিশি বাধা উপেক্ষা করেই দিল্লির জামা মসজিদ ও মুম্বাইয়ের আজাদ ময়দানে বিক্ষোভে শামিল হয় হাজার হাজার শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সাধারণ জনগণও।

জুমার নামাজের পর জামা মসজিদের বাইরে বিক্ষোভে উপস্থিত ছিলেন কংগ্রেস নেত্রী অলকা লাম্বা ও দিল্লির সাবেক বিধায়ক শোয়েব ইকবাল। এদিন উত্তর-পূর্ব দিল্লির উত্তরপ্রদেশ ভবন, শীলামপুর ও জাফরাবাদে বিক্ষোভ ঠেকাতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন ছিল। এতে সংঘর্ষ এড়ালেও ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি পুলিশ।

পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসের পর এবার বিক্ষোভে নেমেছে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট। প্রথমবারের মতো শুক্রবার কলকাতায় মিছিল করে দুই দলের নেতাকর্মীরা।

৮ জানুয়ারি দেশজুড়ে শিল্প ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে বাম শ্রমিক সংগঠনগুলো। এতে সমর্থন দিয়েছে কংগ্রেস।

সিএএ’র বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে সমর্থন জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক, ছাত্র ও সাবেক ছাত্রসহ ১৩৫ জন বৃহস্পতিবার এক বিবৃতি দিয়ে এ সংহতি প্রকাশ করেন।

আনন্দবাজার পত্রিকা বলছে, উত্তরপ্রদেশ পুলিশের ডিজি ওপি সিংহ জানিয়েছেন, রাজ্যটির ৭৫ জেলার মধ্যে ২১টিতে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে। রাজ্যজুড়ে নজরদারিতে ব্যবহার করা হচ্ছে ড্রোন, নামানো হয়েছে আধাসামরিক বাহিনী। সংবেদনশীল জায়গাগুলোতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

সংবাদমাধ্যমটি বলছে, বিক্ষোভ দমনে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপরও নজরদারি চালাচ্ছে উত্তরপ্রদেশের পুলিশ। ইতিমধ্যে সাড়ে ১৯ হাজার সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। গত সপ্তাহে ১২৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সরকারি সম্পত্তি ধ্বংসের অভিযোগে ৪৯৮ জনকে চিহ্নিত করেছে রাজ্য প্রশাসন।

মিরাটেই ৭৯টি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ, গ্রেফতার করা হয়েছে ৩১৭ জনকে। গত কয়েকদিনে বিক্ষোভকালে ভারতে নিহত হওয়া ২৫ জনের মধ্যে ১৯ জনই এই রাজ্যের। বিক্ষোভকালে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে পুলিশ।

দেশের এই পরিস্থিতি নিয়ে শুক্রবারও বক্তব্য দিয়েছেন ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী। ছত্তিশগড়ে এক সমাবেশে তিনি বলেন, এনআরসি (জাতীয় নাগরিক তালিকা) ও এনপিআর (জাতীয় আদমশুমারি) দরিদ্রদের কাছে ট্যাক্সের মতো; ব্যাংকে গিয়ে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে না পারার মতো। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে তালিকায় নাম উঠাতে হচ্ছে। এতে ফতুর হচ্ছে জনগণ, আর ধনী হচ্ছে মোদি ঘনিষ্ঠ কয়েকজন। ভারতের অর্থনৈতিক মন্দা, নিরাপত্তাহীনতা, যৌন সহিংসতা- বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী মোদি জনগণের সমস্যা বুঝতে পারছেন না বলে উল্লেখ করেন।

প্রায় একই ভাষায় বিজেপি সরকারের সমালোচনা করেন রাহুলের বোন ও কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। তিনি বলেন, মোদি-অমিত শাহরা সময়ের চাহিদা বুঝতে পারছেন না। অপরদিকে বিজেপি প্রধান ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের দাবি, সিএএ ও এনআরসি নিয়ে গুজব ছড়াচ্ছে বিরোধী দলগুলো। কংগ্রেস আমলে পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার ‘আলিয়া-মালিয়া-জামালিয়া’ অনুপ্রবেশ করেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

বড় চ্যালেঞ্জের মুখে মোদি : টানা দ্বিতীয় মেয়াদের ক্ষমতায় আসার পর দেশের অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে চাপে ছিল মোদি সরকার। এখন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে লাগাতার বিক্ষোভ-আন্দোলন।

পরিস্থিতির জন্য বিক্ষোভকারীদেরই দুষছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিক্ষোভকালে পুলিশি বর্বরতা নিয়ে কোনো কথা বলেননি, উল্টো কঠোরতার নির্দেশনা দিচ্ছে তার সরকার। এ অবস্থায় হিন্দুত্ববাদী বিজেপির জোটসঙ্গীরাও বিতর্কিত আইন নিয়ে ভিন্ন সুরে কথা বলছে। প্রায় সব দলই দাঁড়িয়েছে জনদাবির পক্ষে।

রয়টার্স বলছে, নাগরিকত্ব আইন পাসের পর দেশজুড়ে এমন আন্দোলন হতে পারে, তা আগে থেকে আঁচ করতে পারেনি বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। প্রশ্নের মুখে পড়েছে মোদি-অমিত শাহের দূরদর্শিতাও। বিজেপির নেতা ও মন্ত্রীদের একাংশ বলছে, ক্ষমতার টানা সাড়ে পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দল। দলীয় ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে ‘মাস্টারমাইন্ডরা’ ছক কষতে শুরু করেছেন।

এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন, বিল পাস করার আগে এর রাজনৈতিক সমীকরণ বিশ্লেষণ করে দেখা হয়নি।

এক সংসদ সদস্য বলেন, মনে করা হয়েছিল, সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে দু-একটা ছোটখাটো বিক্ষোভ হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটা আসলে গত সাড়ে ৫ বছরে বিভিন্ন জনবিরোধী সিদ্ধান্ত, আর্থিক মন্দা, মুসলিম বিদ্বেষ, হিন্দুত্ববাদীদের বর্বরতাসহ একাধিক ইস্যুতে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। মহারাষ্ট্রের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী পৃথ্বীরাজ চৌহান বলেন, ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি করা আইন শাসক দলের হিন্দুত্বের রাজনীতির জন্যই আত্মঘাতী হয়েছে।

১১ ডিসেম্বর পাস হওয়া নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ২০১৫ সালের আগে ভারতে আসা হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, পার্সি ও জৈন শরণার্থীরা ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। সমালোচকদের আশঙ্কা, এই আইন ও এনআরসির যৌথ প্রয়োগে মুসলিমদের ভারত থেকে তাড়ানোর চেষ্টা হতে পারে।