কিডনি রোগজনিত মানবিক সঙ্কট : আমাদের করণীয়

কিডনি রোগজনিত মানবিক সঙ্কট : আমাদের করণীয়

প্রতীকী ছবি

সরকারি হিসেবেই বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি লোক কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে ক্রনিক কিডনি ডিজিজের (সিকেডি) শেষ পরিণতি যে ‘এন্ড স্টেজ রেনাল ডিজিজ (ইএসআরডি)’ হয় তার সংখ্যা প্রতি বছর ৩৫-৪০ হাজার। এর মধ্যে মাত্র ৯-১০ হাজার রোগী সপ্তাহে দুইবার ডায়ালাইসিস চালিয়ে যেতে সচেষ্ট হয়। যে কারণে এই সিকেডি রোগটি হচ্ছে, তা যেন না হতে পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা জানি, সিকেডি রোগটি একদিনে হয় না। সাধারণত একনাগাড়ে অন্তত পাঁচ বছর অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ৩০-৪০ শতাংশ এবং অন্তত দশ বছর অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ১৫-২০ শতাংশ সিকেডি রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

দু’টি কিডনিই ৯০ শতাংশের বেশি বিকল হলে এর চিকিৎসা হয় ডায়ালাইসিস নতুবা ট্রান্সপ্লান্টেশন। ইএসআরডি রোগীদের জন্য কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন অপেক্ষাকৃত স্থায়ী এবং সঠিক চিকিৎসা হলেও ডোনার সঙ্কট, ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন, নেফ্রলজিস্ট, নার্স এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সঙ্কটের কারণে আমাদের দেশে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে। রেনাল রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি বা আরআরটি হলো- দুটো কিডনিই যখন ৯০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি বিকল হয়ে যায়, তখন এর চিকিৎসা হয় কিডনি বদল বা ট্রান্সপ্লান্টেশন অথবা ডায়ালাইসিস। ডায়ালাইসিস আবার বর্তমানে মূলত দুই রকম, হিমোডায়ালাইসিস ও কন্টিনিউয়াস অ্যাম্বুলেটরি পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস (সিএপিডি)।

মূলত দুইভাবে কিডনি ডায়ালাইসিস হয়। হাতে ফিসচুলা করে সপ্তাহে দুই অথবা তিন দিন আধুনিক যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ হাসপাতালে ডায়ালাইসিস মেশিনের সাহায্যে রক্ত পরিশোধনের মাধ্যমে যে ডায়ালাইসিস করা হয় তাকে বলে হিমোডায়ালাইসিস।

পেটের মধ্যে একটি বিশেষ ক্যাথেটার ঢুকিয়ে পেরিটোনিয়াল মেমব্রেনকে কাজে লাগিয়ে বিশেষ ফ্লুইড ব্যবহার করে দিনে দু-তিনবার যে ডায়ালাইসিস করা হয় তাকে বলে কন্টিনিউয়াস অ্যাম্বুলেটরি পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস বা (সিএপিডি)।

কন্টিনিউয়াস এম্বুলেটরি পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস (সিএপিডি) পদ্ধতি অনেক সহজ হলেও চিকিৎসক এবং ব্যবসায়ীদের এর প্রতি রয়েছে নেতিবাচক মনোভাব, পিডি ফ্লুইডের উচ্চ মূল্য এবং দক্ষ নার্স ও তত্ত্বাবধায়কের অভাবে এটিও দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে না। এমন কিছু রোগী যেমন হার্ট ডিজিজ, শিশু এবং বেশি বয়স্ক রোগীদের জন্য সিএপিডির বিকল্প নাই। সিএপিডি পদ্ধতিতে ডায়ালাইসিসের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এটি যেকোনো জায়গায় এমনকি বাসায় বসে নিজে নিজেই ডায়ালাইসিস চালিয়ে নিতে পারে। শুধু ডায়ালাইসিসের শুরুতে হাসপাতালে দিন পনের ভর্তি থেকে পেটের মধ্যে একটা স্থায়ী ক্যাথেটার ঢুকিয়ে দিয়ে তার মাধ্যমেই বছরের পর বছর বাসায় বসেই ডায়ালাইসিস চালিয়ে নিতে পারে।

ইএসআরডি বা সিকেডি স্টেজ-৫ এর চিকিৎসা বাংলাদেশে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। নিম্ন বিত্ত তো দূরে থাকুক মধ্যবিত্ত লোকদের পক্ষেও এর চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে দেশে ষোলো লাখ ডায়ালাইসিস যোগ্য রোগী আছে। দেশের হাসপাতালগুলোতে ডায়ালাইসিস সক্ষমতা এর মাত্র ১০% যা ১৫-২০ হাজার। ছয় মাসের মধ্যে টাকার অভাবে ডায়ালাইসিস বন্ধ করে দেয় শতকরা ৭৫ শতাংশ লোক।

বাংলাদেশে প্রতি বছর ডায়ালাইসিস জাতীয় কিডনি জটিলতায় মারা যায় ৪০ হাজার। সে হিসাবে প্রতি দিন মারা যায় ১১০ জন এবং প্রতি ঘণ্টায় চারজন। শুরুতে একজন সিকেডি-৫ স্টেজ রোগীর জরুরিভাবে ডায়ালাইসিস দরকার হয়ে পড়লে ঊরুতে অথবা ঘাড়ে ১০-১৩ হাজার টাকা খরচ করে ইমার্জেন্সি ক্যাথেটার পরিয়ে ডায়ালাইসিস করতে হয়। হিমোডায়ালাইসিস যোগ্য করার জন্য ২৫-৩০ হাজার টাকা খরচ করে বাম হাতে ফিসচুলা করিয়ে নিতে হয়। তারপর কমপক্ষে ছয় সপ্তাহ অপেক্ষার প্রহর গুণে একজন হিমোডায়ালাইসিস যোগ্য রোগী সপ্তাহে দু-তিন দিন ডায়ালাইসিস সেন্টারে এসে ৪-৫ ঘণ্টা করে সময় নিয়ে ডায়ালাইসিস করতে হয়। যাতায়াত খরচ, ওষুধ খরচ এবং ডায়ালাইসিস খরচ সব মিলিয়ে এ ধরনের একজন হতভাগা রোগীকে মাসে কমপক্ষে ৪০-৫০ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। সে হিসেবে বছরে পাঁচ-ছয় লাখ টাকার কমে কোনোভাবেই হয় না।

এই ডায়ালাইসিস চালিয়ে যেতে জমি-জমা ভিটা-মাটি বিক্রি করে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে একদম নিঃস্ব হয়ে যায়। ফলে নিজেও শেষ হয়ে যায় এবং একটা পুরো পরিবারও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। অপর্যাপ্ত ডায়ালাইসিসের কারণেই কোনো কোনো রোগীর অবস্থা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেলে আইসিইউতে নিতে হয়। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে রোগীকে লাখ লাখ টাকা বেশি গুনতে হয়। অথচ ঠিকমতো ডায়ালাইসিস চালিয়ে যেতে পারলে রোগীও কম-বেশি কর্মক্ষম।

এখন বেসরকারি পর্যায়ে অনেক বেশি ডায়ালাইসিস হচ্ছে। এর মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি পুরোপুরি ব্যবসানির্ভর। বাকি ২০ ভাগ স্বল্পমূল্যে (১৫০০-২০০০ টাকা) সার্ভিস দেয়ার চেষ্টা করছে।

সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডায়ালাইসিস স্বল্পমূল্যে হওয়ার কারণে কিছুটা সুবিধা গরিবরা পাচ্ছে। কিন্তু সব গরিব রোগীর জন্য ওষুধসহ একদম ফ্রি কোনো ডায়ালাইসিস কিংবা ট্রান্সপ্লান্টেশন কালচার বা পদ্ধতি এখনো দেশে সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো পর্যায়েই গড়ে ওঠেনি। আমরা কি কোনোভাবে টাকা না থাকার ‘অপরাধে’ এভাবে অবহেলার মৃত্যু জাস্টিফাই করতে পারি! ৫০ কোটি খরচ করলে ১০০০টি দরিদ্র অসহায় রোগীর জীবন বেঁচে যায়। আমি মনে করি বছরে এই পরিমাণ টাকা দেয়ার মতো শত সহস্র ভাগ্যবান লোক বাংলাদেশে আছে যাদের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেই সানন্দচিত্তে খরচ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত আছে।

একজন মানুষ চাইলে অনেকভাবে অন্য মানুষের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে।

প্রথমত, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে অর্থ সহযোগিতার মাধ্যমে।

দ্বিতীয়ত, স্থায়ী বা অস্থায়ী সম্পদ দানের মাধ্যমে।

তৃতীয়ত, কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থাৎ গায়ে-গতরে খেটে।

চতুর্থত, সময় এবং সঙ্গদানের মাধ্যমে।

পঞ্চমত, জ্ঞান-গরিমা, বুদ্ধি-পরামর্শ, মেধা ও লেখনীর মাধ্যমে। ষষ্ঠত, নানাভাবে সমর্থন সুলভ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এগিয়ে আসার মাধ্যমে।

সপ্তমত, কোনো ধরনের সহযোগিতার সুযোগ না থাকলেও ভালো আচরণ এবং তার কল্যাণ কামনা করে সুন্দর বাচনে বিদায়ের মাধ্যমে।

অষ্টমত, উপরোক্ত সব ধরনের সাহায্যের জন্য উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে।

নবমত, এ ধরনের মানবতাবাদী কাজে যারা এগিয়ে আসে তাদের উৎসাহ প্রদান এবং প্রচারের প্রদানের মাধ্যমে।

অর্থের মাধ্যমে সহযোগিতা মূলত চারভাবে করা যায়। প্রথমত, রাষ্ট্র মানবিক খাতে বাজেট বাড়িয়ে এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসা ওষুধসহ পুরোপুরি ফ্রি করে বিপন্ন জীবন জীবন্ত করে তুলতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিত্তশালীরা ব্যক্তিগতভাবে তাদের আয়ের একটি অংশ এসব রোগীকে বাঁচাতে কাজে লাগাতে পারে। তৃতীয়ত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের লভ্যাংশের ৫-১০ শতাংশ দান করে। চতুর্থত, ব্যক্তি বা মানবিক প্রতিষ্ঠানের অন্যের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করে।

মানুষের জন্য খরচ করতে হবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং উত্তরাধিকারীদের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ রেখে বাকিটা মানুষের জন্য খরচ করা যায়। কিন্তু আমরা অধিকাংশই এ ত্যাগ স্বীকার তো করছিই না বরং প্রয়োজনের নামে এবং অপ্রয়োজনে অঢেল বৈধ-অবৈধ সম্পদ জমা করে প্রচুর অপচয় করে থাকি। জীবনে চলার জন্য খুব বেশি টাকার দরকার যে নেই, এ কথা সবাই জানে কিন্তু অনেকেই বাস্তবে তা মানতে চায় না।

কেন আমি গরিব-অসহায়দের জন্য সময়-সম্পদ ও মেধা ব্যয় করব?

প্রথমত, এটা আল্লাহর দেয়া এই প্রকৃতিরই শিক্ষা যে, সবলরা দুর্বলদের সবল ও সক্ষম করে তুলবে। প্রকৃতিতে যত প্রাণী-শিশু আছে, সম্ভবত মানব শিশুই সবচেয়ে অসহায়। একজন মায়ের কাছে তার শিশুটি সবচেয়ে দুর্বল হওয়ার কারণে আবার সবচেয়ে শক্তিশালীও বটে। দেড় হাজার কোটি টাকার মালিকের চেয়ে যার কথায় ও ভয়ে দেড় হাজার কোটি টাকা স্বত্ব ত্যাগ করে অন্যকে দান করে দিতে পারে, তিনিই বেশি শক্তিশালী। আপনার যত প্রয়োজনই থাকুক একজন শিশু কান্না ছাড়া কিছু বলতে না পারলেও তার অভাবই সবার আগে পূরণ করেন। যেকোনো ত্যাগের বিনিময়ে তার কান্না থামাতে একটুও দ্বিধা করেন না। তেমনিভাবে সমাজের সবচেয়ে দুর্বল মানুষটিই আমাদের কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী হওয়া উচিত। শিশুর কান্না থামাতে না পারা পর্যন্ত একজন মা যেমন স্বস্তিতে থাকতে পারে না, তেমনিভাবে সমাজে ও রাষ্ট্রে যারা সবল তাদেরও অসহায়দের কান্না না থামা পর্যন্ত স্বস্তিতে থাকা উচিত নয়।

দ্বিতীয়ত, এটা তাদের প্রতি দয়া বা অনুগ্রহ নয়, বরং তাদের অধিকার। দুস্থ মানবতা, নিঃস্ব-গরিবের স্বার্থ সংরক্ষণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার বা হকগুলো সব সমাজেই স্বীকৃত। সর্বপ্রকার ধন-সম্পদ বণ্টনের মূলনীতি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘ধন-সম্পদ যেন শুধু তোমাদের ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়।’ আল-হাশর : ৭ । ধনীদের অর্থ-সম্পদের ওপর গরিবের যে হক রয়েছে, পবিত্র কুরআনে তা বারবারই উচ্চারিত হয়েছে, ‘আর তাদের (ধনী লোকদের) সম্পদে অবশ্যই রয়েছে প্রার্থী (দরিদ্র) ও বঞ্চিতদের অধিকার।’ আয-যারিআত : ১৯।

তৃতীয়ত, ‘গরিবরা আরো গরিব আর ধনীরা আরো ধনী’র সমাজে কখনো সুখ ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় থাকে না। সমাজে পারস্পরিক ভালোবাসার পরিবর্তে হিংসাবিদ্বেষ আর হানাহানিতে রূপ নেয়। মা ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে খাবার তুলে দিয়ে যেমন স্বস্তি পায়, তেমনি আমাদেরও অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে পেরে স্বস্তি পাওয়া উচিত।

চতুর্থত, সমাজে ধনী-গরিবের ব্যবধান আল্লাহর দেয়া এক বিরাট পরীক্ষা। গরিবদের গরিব হওয়ার কারণ তার পাপের শাস্তি নয় বরং রহমতও হতে পারে। আবার ধনীদের ধনী হওয়ার কারণ তার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে ভালো কাজের স্বীকৃতি বা পুরস্কার নয়, বরং এটি একটি কঠিন পরীক্ষা। ধনী লোকের ঘরে কারো জন্ম তার যোগ্যতা বা ইচ্ছাকৃত নয় বরং তার ভাগ্য, আবার পরীক্ষাও বটে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তিনি সেই মহান সত্ত্বা, যিনি তোমাদেরকে জমিনের খলিফা বানিয়েছেন এবং তোমাদের কতককে কতকের ওপর মর্যাদা দিয়েছেন, যাতে তিনি তোমাদের যাকে যা প্রদান করা হয়েছে, তা দিয়েই পরীক্ষা করে নিতে পারেন। নিশ্চয় তোমার রব দ্রুত শাস্তিদানকারী এবং নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ আল-আনআম : ১৬৫।

পঞ্চমত, সমাজ সচল থাকার জন্য শুধু গরিব অথবা শুধু ধনী মানুষ দিয়ে চলবে না। সব শ্রেণীপেশার মানুষের পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতায় একটি সচল ও সুন্দর সমাজ গড়ে ওঠে। পরিবারে শিশুরা যেমন আপনার বোঝা নয় বরং মূল্যবান সম্পদ, তেমনি সংখ্যায় সমাজের অধিকাংশ স্থান দখলকারী নিঃস্বরাও বোঝা হতে পারে না বরং মূল্যবান সম্পদে পরিণত হতে পারে আপনার সহযোগিতায়।

ষষ্ঠত,‘মানুষ মানুষের জন্য’ কথাটি নিছক নীতি কথা নয়। বরং অত্যন্ত বাস্তবধর্মী একটি স্লোগান। মানুষের জন্যই ঢাকা শহরের যে মাটির এক শতাংশের দাম পাঁচ কোটি টাকা, পল্লীর অজপাড়াগাঁয়ের একই মাটির এক শতাংশের দাম পাঁচ হাজার টাকাও নেই। কোনো সরকারও যদি বলে, পুরো ঢাকা শহর আপনাকে লিখে দেবে, আপনি তো খুশিতে জ্ঞান হারাবেন, আবার পরক্ষণেই যদি এই একই সরকার শর্ত দিয়ে বলে যে, আপনি একাই ঢাকা শহরে থাকবেন, আপনার সাথে অন্য কোনো মানুষ থাকবে না, তাহলে এই আপনিই দ্বিতীয়বার জ্ঞান হারাবেন ভয়ে।

সপ্তমত, এই ধরাধামের সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষটিকেও তার দৃষ্টিতে সবচেয়ে দুর্বল একজন শ্রমিকের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তৈরি করা অট্টালিকায় বসবাস করতে হয়।

অষ্টমত, ভোগ-বিলাসে নয়, উত্তম ত্যাগেই শান্তি। একজন আদর্শ পিতা-মাতা তার সন্তানের জন্য নিজের পছন্দের ভালো খাবারটাই বাছাই করে রেখে দেয়। আপনার আয়ের উত্তম অংশ অপরকে দান করা ছাড়া আপনার যেমন শান্তি পাওয়া উচিত নয়, তেমনি আপনি আল্লাহর প্রিয়পাত্রও হতে পারবেন না। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা কখনো প্রকৃত কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না সেই জিনিস আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবে যাকে তোমরা খুব ভালোবাস। আর যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।’ আলে ইমরান : ৯২।

উন্নত বিশ্বে সরকার সবচেয়ে ব্যয়বহুল চিকিৎসা বিনামূল্যে গরিব ও নিঃস্বদের দিয়ে থাকে। আর ধনীরা সাধ্যমতো নিজেদের টাকার বিনিময়ে ব্যয়বহুল চিকিৎসা করে থাকে। ফলে ব্যয়বহুল চিকিৎসায় বরং গরিবরা সেখানে ধনীদের চেয়ে ভালো অবস্থানে থাকে। আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো চিত্র। বছর কয়েক আগে একটি রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে, টাকার অভাবে বাংলাদেশের শতকরা ৭০-৮০ ভাগ মানুষ সঠিক চিকিৎসাসেবা নিতে পারছে না। ৫০-৬০ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা করতে গিয়ে গরিব হয়ে যাচ্ছে। নেহায়েত গরিবরা কোনোরকম চিকিৎসা খরচ চালাতে না পেরে অকালেই মৃত্যুবরণ করছে। এজন্য সব ধরনের ব্যয়বহুল চিকিৎসাই বরং সরকারের তরফ থেকে পুরোপুরি ফ্রি করতে পারলে খুবই ভালো।

সরকার মানবসেবা যেমন বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ইত্যাদি অনেক খাতেই হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করছে। স্বাস্থ্য খাতে মাত্র ৫০০-১০০০ কোটি বাড়ালেই হয়তোবা গরিবরাও বেঁচে যেত আর আমরাও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে দায়মুক্ত থাকতে পারতাম।

অনেক বেসরকারি হাসপাতাল ব্যয়বহুল চিকিৎসা সবার জন্য ডিসকাউন্ট মূল্যে করে থাকে। সেটার পাশাপাশি কিংবা সেটা না করে যদি লাভের ৫-১০% শুধু গরিবদের ডায়ালাইসিস, কেমোথেরাপি, হার্ট অপারেশন ইত্যাদি ব্যয়বহুল চিকিৎসা, টেস্ট ও ওষুধ শতভাগ ফ্রি করতে পারত। পৃথিবীতে এমন একটি ধর্ম কিংবা সমাজব্যবস্থাও নেই যেখানে দুস্থ মানবতার পাশে দাঁড়াতে বলেনি।

আমাদের জানা মতে, একজন চিকিৎসকের সামান্য উদ্যোগী ভূমিকার কারণে এ পর্যন্ত হতদরিদ্র ৮৫ জন কিডনি ডায়ালাইসিসযোগ্য রোগী আদদ্বীন, ইবনে সিনা, গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল এবং আলমানার হাসপাতালে ফ্রি ডায়ালাইসিস নিয়ে বেঁচে আছেন। মিরপুরের কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল, আকিজ গ্রুপ ও বারাকাহ জেনারেল হাসপাতালসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ডায়ালাইসিসযোগ্য ও ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের সাধ্যমতো সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এসব রোগীর মানবিক দিক বিবেচনায় এনে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ‘সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট’ (সিজেডএম)-এর আর্থিক অনুদানে সম্পূর্ণ ফ্রি ডায়ালাইসিস হচ্ছে। মগবাজারের আদদ্বীন হাসপাতাল মাত্র ২৫০ টাকার বিনিময়ে ডায়ালাইসিস সুবিধা চলমান রেখেছে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বনামধন্য মানবিক প্রতিষ্ঠান ‘সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট’ (সিজেডএম) ঢাকার মিরপুরে এবং কেরানীগঞ্জের শ্যামল বাংলা রিসোর্টে সীমিত পরিসরে পাইলট প্রকল্প হিসেবে প্রাথমিকভাবে ১৫০ জন রোগীকে ফ্রি হিমোডায়ালাইসিস এবং বেশ কিছু রোগীর ফ্রি সিএপিডি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। আরো উৎসাহব্যঞ্জক খবর হলো, সিজেডএম ও আরো কিছু মানবিক সার্ভিস দাতা সবার সহযোগিতা নিয়ে কেরানীগঞ্জে এক একর জায়গার ওপর ফ্রি ডায়ালাইসিস এবং ট্রান্সপ্লান্টেশন হাসপাতাল শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করা যায়, বিত্তবানরা আর্তমানবতার সেবায় যার যতটুকু সামর্থ্য আছে তা নিয়ে এগিয়ে আসবেন। আমরা সবাই আশায় বুক বাঁধতে চাই এই ভরসায় যে, এ ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগে সবাই কার্যকরভাবে এগিয়ে আসবে।

লেখক : ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন

 সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ডিপার্টমেন্ট অব হিস্টোপ্যাথলজি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা।
towhid.drhossain@gmail.com