জিলহজের প্রথম ১০ দিনের আমল

জিলহজের প্রথম ১০ দিনের আমল

ফাইল ছবি

আরবি ১২ মাসের মধ্যে জিলহজ অত্যন্ত গুরুত্ব ও ফজিলতপূর্ণ একটি মাস। বিশেষ করে এ মাসের প্রথম ১০ দিন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এ মাসের প্রথম ১০ রাতের কসম খেয়েছেন। ‘শপথ ফজর-কালের এবং ১০ রাতের’। (আল ফাজর : ১-২) মুফাসসিরিনদের মতে, ওই ১০ রাত বলতে জিলহজের প্রথম ১০ দিন উদ্দেশ্য।
তাছাড়া এ মাসের প্রথম ১০ দিন গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, এ মাসে মুসলিম উম্মাহর বিশেষ দু’টি ইবাদত রয়েছে। কোরবানি ও হজ।

৮ জিলহজ থেকে হজের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু। ৮ তারিখে মিনা গমন দিয়ে ৯ তারিখে আরাফার প্রান্তরে অবস্থান, সূর্যাস্তের পর মাগরিব-ইশা একসাথে আদায় করতঃ মুজদালিফায় রাত্রি যাপন। ১০ তারিখ সকাল হওয়ার পর মিনায় গিয়ে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে কোরবানি, হলক ও তাওয়াফ। এরপর ১১, ১২ ও সম্ভব হলে ১৩ তারিখ শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করার মাধ্যমে হজের কাজ সম্পন্ন হয়।

অন্যদিকে এই মাসের ১০-১২ তারিখ পুরো মুসলিম উম্মাহ পবিত্র ঈদুল আজহা ও কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর সান্নিধ্য লাভ করে থাকে। এসব কারণে এ মাসের প্রথম দশক অতি গুরুত্বপূর্ণ।

তাই এ মাসের প্রথম দশকের আমল বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় আল্লাহ তায়ালার কাছে অধিক পছন্দনীয় ও ফজিলতপূর্ণ। এক হাদিসে রাসূল সা:-এ ১০ দিনের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে জিহাদের চেয়েও এ দিনগুলোর আমলকে ফজিলতপূর্ণ বলেছেন।
ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত নবী সা: বলেছেন, ‘জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমলই উত্তম নয়।’ তারা জিজ্ঞেস করলেন, জিহাদও কি (উত্তম) নয়? নবী সা: বললেন, ‘জিহাদও নয়। তবে সে ব্যক্তির কথা ছাড়া যে নিজের জান ও মালের ঝুঁকি নিয়েও জিহাদে যায় ও কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না।’ (সহিহ বুখারি-৯৬৯)
এই দিনগুলোর বিশেষ কিছু আমল-

এক. তাকবির ও তাসবিহ পড়া : এই দিনগুলোতে তাকবির (আল্লাহু আকবার), তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাসবিহ (সুবহান আল্লাহ) পড়া সুন্নত। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘এ ১০ দিনের নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোনো আমল নেই। তাই তোমরা এ সময়ে তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লøাল্লøাহ), তাকবির (আল্লাহু আকবার) ও তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পাঠ করো।’ (মুসনাদে আহমদ-৫৪৪৬)

দুই. দিনে সিয়াম পালন ও রাতে নফল ইবাদত : এই দিনগুলোর বিশেষ একটি আমল হলো দিনের বেলায় সিয়াম পালন করা ও রাতের বেলায় যথাসম্ভব নফল ইবাদতে মশগুল থাকা। হাদিস শরিফে রাসূল সা: এই দিনগুলোর প্রতিটি রোজাকে পুরো বছরের রোজা এবং এ রাতের ইবাদতকে শবেকদরের ইবাদতের সমতুল্য বলেছেন। আবু বকর ইবনে নাফি আল বাসরি রাহ. ... আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেন, ‘এমন কোনো দিন নেই যে দিনসমূহের ইবাদত আল্লাহর কাছে জিলহজ মাসের ১০ দিনের ইবাদত অপেক্ষা অধিক প্রিয়। এর প্রতিটি দিনের রোজা এক বছরের রোজার সমতুল্য। এর প্রতিটি রাতের ইবাদত লায়লাতুল কদরের ইবাদতের সমতুল্য।’ (তিরমিজি-৭৫৮, ইবনে মাজাহ-১৭২৮) তাই রাসূল সা: এই দিনগুলোতে রোজা রাখতেন। মুসাদ্দাদ ... হুনায়দা ইবনে খালিদ তার স্ত্রী হতে এবং তিনি নবী করিম সা:-এর কোনো এক স্ত্রী থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লøাহ সা: জিলহজের প্রথম ৯ দিন ও আশুরার দিন রোজা রাখতেন। আর তিনি প্রতি মাসে তিন দিন, মাসের সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখতেন।’ (আবু দাউদ-২৪২৯)

তিন. আরাফার দিনের রোজা : এই দশক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার বড় একটি কারণ হলো এই দশকে ইয়াওমে আরাফাহ রয়েছে। যা বছরের গুরুত্ব ও ফজিলতপূর্ণ দিন। এই দিনের ব্যাপারে হাদিস শরিফে পৃথক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।

হজরত কাতাদাহ রা: বলেন, রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘আরাফার দিনের একটি রোজার দ্বারা পূর্বের ও পরের এক বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যায় এবং আশুরার রোজার দ্বারাও পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যায়।’ (তিরমিজি-১৫৭, মুসনাদে আহমদ-২২৫৩৫)

তবে আরাফায় অবস্থানকারী হাজীদের জন্য রোজা রাখা মুস্তাহাব নয়। কেননা, মহানবী সা: আরাফায় অবস্থান করেছিলেন রোজাবিহীন অবস্থায়। এ ছাড়া ভিন্ন এক বর্ণনায় এসেছে, আরাফা তথা ৯ জিলহজ আল্লøাহ তায়ালা বছরের অন্যদিনের তুলনায় অধিক সংখ্যক জাহান্নামিকে মুক্তি দেন।

সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব রহ. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আয়িশা রা: বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আরাফাহ দিবসের তুলনায় এমন কোনো দিন নেই যেদিন আল্লাহ তায়ালা সর্বাধিক লোককে দোজখের আগুন থেকে মুক্তি দান করেন। আল্লাহ তায়ালা নিকটবর্তী হন, অতঃপর বান্দাদের সম্পর্কে মালায়িকার সামনে গৌরব করেন ও বলেন, তারা কী উদ্দেশে সমবেত হয়েছে (বা তারা কী চায়)?’ (সহিহ মুসলিম-৩১৭৯)

চার. বিশেষ আমল : এ ছাড়াও এ মাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কোরবানির পশু জবাই করা পর্যন্ত কোরবানি আদায়কারীর জন্য বিশেষ একটি আমল রয়েছে। তা হলো, উপরোক্ত সময়সীমার মধ্যে নখ, চুল ও শরীরের অবাঞ্ছিত লোম না কাটা। এটি মুস্তাহাব। যে ব্যক্তি এ নিয়ম পালন করবে, হাজীদের সাথে এটুকু সাদৃশ্য গ্রহণ করায় সে সওয়াবের অধিকারী হবে।

উবাইদুল্লাহ ইবনে মুআজ আম্বারি রাহ. ... নবী এর সহধর্মিণী উম্মে সালামা রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির কাছে কোরবানির পশু আছে সে যেন জিলহজের নতুন চাঁদ দেখার পর থেকে কোরবানি করা পর্যন্ত তার চুল ও নখ না কাটে।’ (মুসলিম-৪৯৫৯, আবু দাউদ-২৭৮২) এ আমলটি উপরোক্ত হাদিসে কোরবানি আদায়কারীর জন্য বলা হলেও অনেকের মতে, কোরবানি অনাদায়ীরাও এ আমল করতে পারে। আশা করা যায় তারাও সাওয়াবের অধিকারী হবে।
পাঁচ. তাকবিরে তাশরিক : ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আছর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক বলা। তাকবিরে তাশরিক নিয়ে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করো’। (সূরা আল-বাকারা-২০৩)

ইবনে আব্বাস রা: বলেন, এখানে নির্দিষ্ট দিনগুলো দ্বারা উদ্দেশ্য-তাকবিরে তাশরিক পাঠের দিনসমূহ। (বুখারি-১০৮৭২)
ছয়. হজ ও ওমরাহ সম্পাদন করা : হজ ও ওমরাহ এ দু’টি হলো এ দশকের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘এক ওমরাহ থেকে আরেক ওমরাহ মধ্যবর্তী গুনাহের কাফফারাস্বরূপ আর কবুল হজের প্রতিদান কেবলই জান্নাত।’ (বুখারি-১৭৭৩, মুসলিম-৩৩৫৫)

সাত. সামর্থ্যবান হলে কোরবানি করা : কোরবানির ফজিলত সম্পর্কে হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, হজরত জায়েদ বিন আরকাম রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সা:-কে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! কোরবানি, ইহা কী? তিনি বললেন ‘তোমাদেন পিতা ইবরাহিম আ:-এর সুন্নত’। সাহাবায়ে কেরাম পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এতে আমাদের জন্য কী রয়েছে? রাসূল সা: বললেন, ‘প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি পাওয়া যাবে’। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ভেড়ার পশমের বিনিময়ে? রাসূল সা: বললেন, ‘ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে নেকি পাওয়া যাবে। (ইবনে মাজাহ-৩১২৭)

অতএব মুসলিম উম্মাহর উচিত জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনে হাদিসে বর্ণিত আমগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করা।

লেখক : মুফতি ইমামুদ্দীন সুলতান

মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইমদাদিয়া আরাবিয়া শেখেরচর,নরসিংদী