বুক রিভিউ : বাঙালি মুসলমানের মন

বুক রিভিউ  : বাঙালি মুসলমানের মন

বুক রিভিউ : বাঙালি মুসলমানের মন

বাঙালি মুসলমানের মন' ছফা পাঠে এই বই দ্বিতীয়। প্রথম বই ছিল 'যদ্যপি আমার গুরু'। 'বাঙালি মুসলমানের মন' বইটা ছফার ফিলোসোফিকাল চিন্তা, ক্রিটিসিজমের ও তার উত্তরণের উপায়ের নিয়ে। একটা জিনিস সূক্ষ্মভাবে দেখা যায়; ছফা এই বইয়ে সমস্যা আলোচনা করার পাশাপাশি আলোচনা করেছেন সমাধান নিয়েও। কয়েকটা প্রবন্ধে বিভক্ত এই বইয়ের রিভিউ নিচে তুলে ধরা  হলো।

ছফা প্রথমেই উনিশশো বাহাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতি বর্ণনায় লিখেন- গত বিশ বছর ধরে মানুষের ভাষার প্রতি সম্মান, ভাষার জন্য ত্যাগ, শহীদ সালাম, বরকত, রফিকদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে ভাষার গৌরব রক্ষা করা, রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ইতিহাস। ছফা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়টাকে বাংলাদেশিদের জন্য রেনেসাঁসের সময় উল্লেখ কইরা বলেন, ' বাঙালি জাতি নিজেদের মতো করে নিজেদের সাহিত্য, সংস্কৃতি রচনা করতে পারবে। উপনিবেশিক শাসন থেকে বের হয়ে পুরোপুরি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকার গৌরব এ জাতি অর্জন করেছে। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ বাাঙালি জাতির জন্য একেকটা দ্বার উন্মোচন করবে।'। এ জাতির জন্য ভাষা ও স্বাধীনতার গুরুত্ব এই প্রবন্ধে তিনি তুলে ধরেন।

বাঙালির ইতিহাস প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ছফা বলেন, আগের সময়ে ইতিহাস লেখকদের ইতিহাসে স্থান পায়নি সাধারণ মানুষ। পাকিস্তানি বাহিনীর শোষণ ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ধর্ম ও বিভিন্ন পেশার মানুষ যেভাবে একাত্মতার সাথে বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত লড়াই করেছে এবং স্বাধীনতা পেয়েছে এটাই বাঙালির গর্বের ইতিহাস।

ছফা এই বইয়ে চিত্রশিল্পে বাঙালি শিল্পীদের অবদান তুলে ধরেছেন একে একে। ইউরোপীয় অনুকরণ থেকে বেরিয়ে স্বদেশীয়, গ্রামবাংলা, ঐতিহ্য, প্রকৃতি ফুটিয়ে তুলতে একটা দীর্ঘ সময় পার করতে হয়েছে এদেশীয় চিত্রশিল্পীদের। অবনীন্দ্রনাথের চেষ্টা থেকে সুলতান সাধনা, যামিনী রায়ের প্রকৃতি থেকে জয়নুল আবেদীনের সংগ্রাম একে একে ফুটিয়ে উঠেছে এই প্রবন্ধে। ছফা সুলতানকে এঁকেছেন সূর্যের মতো যে বাংলার সমস্ত কুয়াশাচ্ছন্ন অতীতকে পেছনে রেখে ফুটে উঠেছে।

মুক্তিযুদ্ধের মতো ঘটনা সুলতানকে দিয়েছে নতুন উদ্দীপনা। সুলতান বাংলাকে এঁকেছে কিষাণদের গড়া সভ্যতা হিসেবে। এছাড়াও আব্বাসউদ্দীন, জসিমউদদীন, জয়নুল আবেদীন ও বুলবুল একেকজন একেক শিল্পের শিল্পী হয়েও তাদের গন্তব্য ও ক্ষেত্র মূলত এক জায়গা থেকে তা বর্ণনা করেছে ছফা। সুলতান ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনের শেষ ট্রাজিক অবস্থার বর্ণনা দেন।

বাঙালি মুসলমানের মন অনুচ্ছেদে ছফা সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটার সমালোচনা করেছেন তা হলো- বাঙালি মুসলমান সমাজের মনস্তত্ত্ব। বৌদ্ব শাসন, হিন্দু শাসন ও মুসলিম শাসনের এই দীর্ঘ সময়ে যে জিনিসটি পরিবর্তন হয়নি তা হলো- এই জনগোষ্ঠীর মন। যা ছফা তার নিজস্ব যুক্তি দিয়ে ক্রিটিসাইজ করেছেন। তিনি এই প্রবন্ধে একাধারে মঙ্গলকাব্যের যেমন সমালোচনা করেছেন একইভাবে সমালোচনা করেছেন পুথি সাহিত্যের। 

নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে ইসলামকে সীমাবদ্ধ রেখে বিজ্ঞান, দর্শন,  সাহিত্য, চিকিৎসা চর্চায় মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে নিজেদের মধ্যে (বাঙালি মুসলমান) যথাযথভাবে চর্চা না করার গুরুত্বপূর্ণ দিক  এই প্রবন্ধে উঠে এসেছে। বাঙালি মুসলমানের নানা মানবিক দুর্বলতা ও তার পেছনের কারণ ছফা তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, 'বাঙালি মুসলমানদের মন যে এখনো আদিম অবস্থায়, তা বাঙালি হওয়ার জন্যও নয় এবং মুসলমান হওয়ার জন্যও নয়। সুদীর্ঘকালব্যাপী একটি ঐতিহাসিক পদ্ধতির দরুন তার মনের উপর একটি গাঢ় মায়াজাল বিস্তৃত রয়েছে, সজ্ঞানে তার বাইরে সে আসতে পারে না। তাই এক পা যদি এগিয়ে আসে, তিন পা পিছিয়ে যেতে হয়। মানসিক ভীতিই এই সমাজকে চালিয়ে থাকে।'

মূলত মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা গুলো পর্যবেক্ষণ ও সমাধানের প্রচেষ্টায় উত্তরণের পথ হিসেবে ছফা মনে করেন।

এই বইয়ে ছফা বার্ট্রান্ড রাসেলের আলাপ এনেছেন। রাসেলকে বর্ণনা করতে গিয়ে ছফা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। রাসেল ছিলেন খুবই সাধারণের মধ্যে অসাধারণ ব্যক্তি। তার দর্শন মূলত মানুষকে নিয়ে, চিন্তার সংস্কার নিয়ে। তিনি মানুষের ভুল ধরিয়েছেন। ভুল ধরিয়ে দিতে যেমন তিনি কোন আক্রমণ করেননি তেমনি দিয়েছেন খুব সুন্দর ব্যাখ্যাও। ছফা মনে করেন অর্ডসওয়ার্থ আইনস্টাইন নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা একইভাবে বার্ট্রান্ড রাসেলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা হলো Voyazing alone in the Ocean of thought.

ভবিষ্যতের ভাবনা অনুচ্ছেদে ছফা সাম্যের ও সৃজনশীলতার উপরে আলোকপাত করেছেন। তিনি ভবিষ্যতে যে পৃথিবী কামনা করেন, তা সৃষ্টি হবে সৃজনশীল জ্ঞানের উপর। বিজ্ঞানের চর্চা, আকাশ অভিযান, মরু অভিযান, সাগর-সমুদ্র নিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান মানুষকে নিয়ে যাবে অনন্যতায়। এখানে যে সমাজ প্রতিষ্ঠা হবে তা হবে সাম্যের। যুদ্ধের জন্য মানুষ পারমানবিক বোমা তৈরির পরিবর্তে রাষ্ট্রের অভুক্ত নাগরিকের ক্ষুধা মেটাবে। মানুষ পৃথিবী ধ্বংসের (যুদ্ধের) পরিবর্তে পৃথিবীকে সাজানোর জন্য উদ্যোগ৷ গ্রহণ করবে। ছফা বলেন,

'ভবিষ্যতের জন্য আমাদের সৃষ্টিশীলতার উপরই বিশ্বাস রাখতে হবে। সৃষ্টিশীলতাই মুক্তির দিশারী।'

মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের হোসেন মিয়া চরিত্রকে ছফা বর্ণনা করেছেন। মানিক বন্দোপাধ্যায় তার মধ্যে ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের আলো জ্বালিয়ে পুরোপুরি এই সমাজের পোষাকে পরিহিত এক অন্য সমাজের আলোকিত চিন্তা ধারার ব্যক্তিকে তুলে ধরেছেন। ছফার মতে, যন্ত্রবিজ্ঞানে মানুষের দীক্ষা, ভৌগোলিক আবিষ্কারের অভিযাত্রা এবং সামাজিক মানব সম্বন্ধের ক্ষেত্রে ব্যবহারিক প্রয়োজনের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি এই তিনটি বিষয় অত্যন্ত সন্তর্পণে অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে মানিক বন্দোপাধ্যায়  ‘হোসেন মিয়ার’ চরিত্রে চরিয়ে দিয়েছেন। এই তিনটি জিনিসই ইউরোপে ‘এনলাইটেন্টমেন্ট’ আন্দোলনের ফল।

ধর্মীয় পোষাকে গতানুগতিক ধর্মীয় মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারার বাইরে এক চরিত্র দিয়ে তিনি শিল্পকে এঁকেছেন।

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা নিয়ে ছফা নিজের মন্তব্য তুলে ধরেছেন। জীবনের শ্রেয়োবোধের সঙ্গে সৌন্দর্যচেতনার সুনিবিড় মিলন রবীন্দ্র সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আজীবন সুন্দরের সঙ্গে সত্যের সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠার দুর্মর প্রচেষ্টা ছিল রবীন্দ্রনাথের। নিজের সত্যোপলব্ধি বর্ণনা করার জন্য তিনি একাধারে লিখেছেন- কবিতা, উপন্যাস, উপন্যাস ও সঙ্গীত। রামায়ণের ব্যাপকতা , মহাভারতের গাম্ভীর্য, ,  কালিদাসে উপমা, বৈষ্ণব কবির বাণী, ইরানের রসসিক্ত প্রাণারে পেলবতা, লোক সংস্কৃতির সাদামাটা চেতনা, ভারতচন্দ্রের নিপুণতা এবং অগ্রজ কবিদের কোনো কোনো পর্ভূক্তি, বিভিন্ন দেশের সাহিত্য থেকে উৎকৃষ্ট রস বাংলা সাহিত্যে এনে, এই সাহিত্যের ধনভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। 

ইউরোপীয় রেনেসাঁস পূর্ববর্তী সময়ে শিক্ষা দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল 'অতীন্দ্রিয়বাদ'কে ঘিরে। একেক দেশে একেক স্থানে এই অতীন্দ্রিয়বাদ চর্চা হতো একেক রূপে। ক্রমান্বয়ে মানুষ সৃজনশীল হয়ে উঠে, আবিষ্কার করে বিজ্ঞান, কারিগরিবিদ্যা ও সৃজনশীলতা, উন্নত সাহিত্যের বিকাশ শুরু হয়। কিন্তু কারিগরি বিদ্যায় শিক্ষিতরা একপ্রকার অজ্ঞ থেকে যায় মানববিদ্যা নিয়ে। মানববিদ্যায় শিক্ষিতরাও অজ্ঞ থেকে যায় কারিগরি বিদ্যা নিয়ে। শিক্ষার প্রকৃত দর্শন চর্চায় রাষ্ট্র অনেকসময় বাধার কারণ হয়ে যেমন দাঁড়িয়েছে তেমনি অনেকসময় রাষ্ট্রের দর্শনকে শিক্ষার দর্শন হিসেবে চালানো হয়েছে।

ছফা মনে করেন, সৃজনশীল, বিজ্ঞানভিত্তিক, মানববিদ্যা ও কারিগরি শিক্ষার যথাযথ সমন্বয়ে সমস্ত মানুষকে এক জাতিভুক্ত, গোটা পৃথিবীকে একটি রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত, মানুষের সমস্ত প্রবৃত্তিকে কোনো রকমের পূর্বসংস্কার ব্যতিরেকে নির্মোহভাবে অস্তিত্বের প্রয়োজনীয় ধরে নিয়ে, জীবন আরো সুন্দর, মানুষ আরো ভাল এবং স্বাধীনতা আরো কাঙ্ক্ষিত ধন- কোনো রকমের স্বর্গ নরকের ভয়ভীতিহীন জীবনের নব দর্শনের মধ্যেই রয়েছে আগামীর মহীয়ান শিক্ষাদর্শনের ইঙ্গিত।

রুদ্র ইকবাল : লেখক ও শিক্ষার্থী,

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।