জীবিকা উপার্জনে কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা

জীবিকা উপার্জনে কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা

ফাইল ছবি

জীবিকা অন্বেষণ ও উপার্জন মানব জীবনের জন্য একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মানুষকে নিজের জীবিকা নিজের হাতে পরিশ্রম করে উপার্জন করতে হবে। কেননা, স্থবিরতা ও হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার জীবন মৃত্যুর নামান্তর। এরূপ জীবনকে জীবন বলাই অর্থহীন। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের কারো পক্ষে এক বোঝা লাকড়ি সংগ্রহ করে পিঠে বহন করে নেয়া কারো কাছে চাওয়ার চেয়ে উত্তম। কেউ দিতেও পারে, নাও দিতে পারে’ (সহিহ বুখারি হাদিস নং-২০৭৪)। রাসূলুল্লাহ সা: অন্যত্র বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাকে দুনিয়া ও আখিরাতের কাজ থেকে মুক্ত থাকা অপছন্দ করেন’ (মিশকাত)। মহানবী সা: আরো বলেছেন, ‘ইসলামে কোনো বৈরাগ্যবাদ নেই’ (মুসনাদ আহমদ, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২২৬)। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর সন্ন্যাসবাদ তো তারা নিজেরাই প্রবর্তন করেছে’ (সূরা হাদিদ-২৭)। সুতরাং নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী জীবিকার জন্য পরিশ্রম ও চেষ্টা করা প্রতিটি মানুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য।

এই পৃথিবী হলো কর্মক্ষেত্র। আল্লাহ তায়ালা এই বিশ্বে খাদ্যোপকরণের ভাণ্ডার রেখে দিয়েছেন। তবে তা লাভ করতে হলে চেষ্টা-তদবির ও অনুসন্ধান-অন্বেষণ আবশ্যক। হজরত ওমর রা: একাধারে চার দিন মসজিদের কোণে বসে জিকির ও ইবাদতকারী একটি দলকে প্রশ্ন করেছিলেন, তোমরা এখানে বসে কী করছ? তারা প্রত্যুত্তরে বলে, আমরা আল্লাহর ইবাদত করছি। হজরত ওমর রা: প্রশ্ন করেন, তোমাদের স্ত্রী ও পুত্র সন্তানদের দেখাশোনা কে করে? তারা বলে আল্লাহর হেফাজতে দিয়েছি। তখন হজরত ওমর রা: তাদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দেন এবং বলেন, তোমাদের ওপর আল্লাহর ইবাদত করা যেমন ফরজ, তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং তাদের জন্য জীবিকা অন্বেষণ করাও ফরজ। হজরত ঈসা আ: এক ব্যক্তিকে মসজিদে সদা বসে থাকতে দেখে বলেন, তুমি এখানে কী করছ? সে প্রত্যুত্তরে বলে, আমি আল্লাহর ইবাদত করছি। হজরত ঈসা আ: তাকে প্রশ্ন করেন, তোমার আহারের ব্যবস্থা কে করে? লোকটি বলল, আমার একজন ভাই আছে সে আমার আহারের ব্যবস্থা করে। তখন হজরত ঈসা আ: বলেন, সে তোমার থেকে উত্তম (হেদায়াতুল মুরশিদিন)।

জীবিকা অর্জনে কুরআন মাজিদের নির্দেশনা : পবিত্র কুরআন মাজিদ জীবিকা অর্জনের ব্যাপারে জোর তাগিদ দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যখন তোমাদের নামাজ শেষ হয়, তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি (আল্লাহ প্রদত্ত জীবিকা) অন্বেষণ করো’ (সূরা জুমআ-১০)।

আরো ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদত করো তারা তোমাদের জীবনোপকরণের মালিক নয়। সুতরাং তোমরা জীবনোপকরণ কামনা করো আল্লাহর কাছে’ (সূরা আনকাবুত-১৭)। অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করো না। কিন্তু ব্যবসায়-বাণিজ্যে যা পরস্পরের সম্মতিক্রমে হয়, তা বৈধ’ (সূরা নিসা-২৯)। হে মানবজাতি! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা থেকে তোমরা আহার করো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (সূরা আল বাকারা-১৬৮)। ‘তিনিই পৃথিবীর সব কিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন’ (সূরা আল বাকারা-২৯)। ‘কিছু লোক আছে, যারা পৃথিবীতে ভ্রমণ করে আল্লাহর ফজল (রিজিক) অন্বেষণ করে বেড়ায়’ (সূরা মুজ্জাম্মিল-২০)।

জীবিকা অর্জনে সুন্নাহর নির্দেশনা : মহানবী সা: অসংখ্য হাদিসে স্বীয় প্রচেষ্টায় জীবিকা অর্জনের তাগিদ করেছেন। হজরত রাফে ইবন খাদিজ রা: থেকে বর্ণিত আছে- একদা জনৈক সাহাবি মহানবী সা:-কে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল! কোন উপার্জন উত্তম? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘ব্যক্তির নিজ হাতের উপার্জন ও সৎ ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জন’ (মিশকাত)। হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: থেকে বর্ণিত, মহানবী সা: বলেছেন, ‘সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী পরকালে নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সাথে থাকবে’ (তিরমিজি, দারেমি, ইবনে মাজাহ, মিশকাত-২৪৩)। হজরত খালিদ ইবনে ওয়ালিদ বলেন, রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, মানুষের জন্য জীবনোপায়ের কোন পন্থা উত্তম? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘হস্তশিল্প’ (ইবনে মাজাহ)।


রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেন, ‘হালাল রুজির সন্ধান করা ফরজের পর আরেকটি ফরজ’ (বায়হাকি, মিশকাত, পৃষ্ঠা-১৪২)। আরো ইরশাদ করেন, ‘যার অতিরিক্ত জমি রয়েছে সে হয়তো নিজে চাষ করবে নতুবা তার কোনো ভাইয়ের দ্বারা চাষ করাবে’ (ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা-১৭৯)। আরো ইরশাদ করেন, ‘কোনো কোনো গুনাহের মধ্যে এমন গুনাহও রয়েছে যেগুলোর কাফফারা শুধু জীবিকা অন্বেষণ ও পরিশ্রমের মাধ্যমেই হয়ে যায়’ (তিবরানি)। হজরত ওমর রা: বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের জীবিকা মাটিতে লুকায়িত খনিগুলোতে অনুসন্ধান করো। তোমাদের কেউ যেন জীবিকার অন্বেষণ ছেড়ে অলসভাবে বসে না থাকে’ (কানজুন উম্মাল, দ্বিতীয় খণ্ড)। হজরত মিকদাম বলেন, মহানবী সা: বলেছেন, ‘নিজ হাতে উপার্জিত খাবারের চেয়ে উত্তম কোনো খাবার নেই এবং আল্লাহর নবী দাউদ আ: নিজের হাতের উপার্জন ভক্ষণ করতেন’ (বুখারি ক্রয়-বিক্রয় অধ্যায়, হাদিস নং-২০৭২)।

জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম : জীবিকা উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম হলো শ্রম। তাই মহানবী সা: শ্রম বিনিয়োগের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। হজরত আনাস রা: বলেন, একদা জনৈক আনসারি সাহাবি মহানবী সা:-এর কাছে কিছু খাদ্যের জন্য প্রার্থনা করেন। তিনি তখন তাকে বলেন, ‘তোমার ঘরে কি কোনো কিছু নেই? প্রত্যুত্তরে সাহাবি বলেন, হ্যাঁ আছে। একখানা কম্বল আছে, যার একাংশ আমি পরিধান করি ও অপর অংশ শয্যারূপে ব্যবহার করি। এ ছাড়া পানি পান করার জন্য একটি পানপাত্রও আছে।

এ কথা শুনে রাসূলুল্লøাহ সা: বলেন, ‘তাহলে ওই দুটো জিনিসই আমার কাছে নিয়ে আসো। সাহাবি তার ওই দুটো জিনিস নিয়ে এলে মহানবী সা: তা হাতে নিয়ে উপস্থিত সাহাবিদের মধ্যে নিলাম ডাকলেন এবং বললেন, ‘এগুলো কে কত দিরহাম দিয়ে ক্রয় করবে?’ একজন সাহাবি বললেন, আমি এগুলো এক দিরহাম দিয়ে নিতে রাজি আছি। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘এক দিরহামের বেশি দিয়ে নেয়ার জন্য কি কেউ আছ?’ তিনি এ কথাটি দু’বার বা তিনবার বলেন, তখন অন্য একজন সাহাবি বলেন, আমি দুই দিরহাম দিয়ে নিতে রাজি আছি। তখন রাসূলুল্লাহ সা: তাকে বস্তুদ্বয় দিয়ে তার থেকে দুই দিরহাম গ্রহণ করলেন। তারপর তিনি এ দিরহাম দু’টি আনসারি সাহাবিকে দিয়ে বললেন, ‘এক দিরহাম দিয়ে তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য খাদ্য ক্রয় করবে, আর অপর দিরহাম দিয়ে একটি কুড়াল কিনে আমার কাছে নিয়ে আসবে।’ সাহাবি কুড়াল ক্রয় করে এলে মহানবী সা:-এর কাছে দিলে তিনি নিজ হাতে তাতে হাতল লাগিয়ে সাহাবিকে বললেন, ‘যাও জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কেটে তা বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে থাকো। আর আমি যেন তোমাকে ১৫ দিনের মধ্যে না দেখি।’ মহানবী সা:-এর নির্দেশ মতো সাহাবি জঙ্গলে গিয়ে কাঠ সংগ্রহ করে তা বাজারে বিক্রি করতে লাগলেন। তারপর ১০ দিরহাম উপার্জন করে তিনি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে এলেন এবং এর কিছু দিরহাম দিয়ে কাপড় ক্রয় করলেন, অবশিষ্ট দিরহাম দিয়ে খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করলেন। তা দেখে রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘অপরের কাছে ভিক্ষার হাত সম্প্রসারিত করার চেয়ে জীবিকা অর্জনের পন্থা অনেক উত্তম।’ নবীর শিক্ষা করো না ভিক্ষা, মেহনত করো সবে।

ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল কাজে ও হালাল পথে শ্রম বিনিয়োগ বিন্দুমাত্রও লজ্জার ব্যাপার নয়। বরং তা হলো নবী-রাসূলদের সুন্নত। প্রত্যেক নবী-রাসূলই পরিশ্রম করে উপার্জন করেছেন। মুসতাদরাকে হাকিম গ্রন্থে হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত আছে- হজরত দাউদ আ: বর্ম তৈরি করতেন। হজরত আদম আ: কৃষিকাজ করতেন। হজরত নূহ আ: কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন। হজরত ইদরিস আ: সেলাই কাজ করতেন এবং হজরত মূসা আ: রাখালের কাজ করতেন (ফতহুল বারি চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩০৬)।
লেখক : মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম

 প্রধান ফকিহ, আল-জামিয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী