রাশিয়া অধিকৃত ক্রিমিয়ায় বিস্ফোরণে গুরুত্বপূর্ণ সেতু বিধ্বস্ত : নিহত ৩

রাশিয়া অধিকৃত ক্রিমিয়ায় বিস্ফোরণে গুরুত্বপূর্ণ সেতু বিধ্বস্ত : নিহত ৩

সংগৃহীত

রুশ-অধিকৃত ক্রিমিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি রেল ও সড়ক সংযোগ সেতু বিশাল এক বিস্ফোরণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিস্ফোরণে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বলে রুশ তদন্তকারীরা জানিয়েছেন।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, সেতুটির সড়কপথের একটি অংশ সমুদ্রে ভেঙ্গে পড়েছে।

রাশিয়ার জাতীয় সন্ত্রাস দমন কমিটি বলেছে, সেতুটির সড়কপথে একটি লরি বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে, যার থেকে জ্বালানিবাহী একটি ট্রেনে আগুন ধরে সেতুটি বিধ্বস্ত হয়েছে।

তবে রাশিয়া বলছে, সেতুর রেলপথের অংশটি আজ শনিবার সন্ধ্যাতেই তারা আবার চালু করে দেবে।

এই সংযোগ সেতুতে রাস্তার পাশপাশি যে রেললাইন রয়েছে, ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ওই রেললাইনের ওপর একটি তেলবাহী ট্রেন দাউ দাউ করে জ্বলছে।

ঘটনার তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, যে লরিটিতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে তার কাছ দিয়ে যাওয়া একটি গাড়ির তিনজন আরোহী মারা গেছেন।

রাশিয়া ও রুশ অধিকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপের মধ্যে সংযোগের এটাই একমাত্র সেতু - যেটি ক্রিমিয়াকে নিজেদের এলাকায় অন্তর্ভুক্ত করার চার বছর পর ২০১৮ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চালু করেন।

দক্ষিণ ইউক্রেনে যে রুশ বাহিনী লড়াই করছে, কার্চ ব্রিজ নামের এই সেতু তাদের সামরিক রসদ ও সরঞ্জাম সরবরাহ করার গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ। ফলে ইউক্রেন বাহিনীর এটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটা সামরিক টার্গেট।

রুশ কর্মকর্তারা বলেছেন, যেভাবে একটি লরিতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেতুটি ধ্বংস করা হয়েছে, সেটি একটি সন্ত্রাসী তৎপরতা। তারা বলেন, লরির বিস্ফোরণ থেকেই তেলবাহী ট্রেনে আগুন ধরেছে এবং সেতুর সড়কপথ সমুদ্রে ভেঙ্গে পড়েছে।

ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পডোলিয়াক সরাসরি এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার না করলেও সরকারের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে ঘটনার পর এক টুইটবার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘ক্রিমিয়ার সেতু দিয়ে শুরু।’

টুইটবার্তায় তিনি আরো লিখেন, ‘অবৈধ যা কিছু ধ্বংস করা হবে, চুরি করা সব জিনিস ইউক্রেনকে ফিরিয়ে দিতে হবে, রাশিয়ার অধিকৃত সব কিছু প্রত্যাখ্যান করা হবে।’

ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কার্চ সেতুর বিস্ফোরণের সাথে এপ্রিল মাসে কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার মিসাইল বহনকারী ক্রুজ রণতরীর বহর মস্কোভার ডুবে যাবার সাথে তুলনা করেছে।

তারা টুইট করেছে, ‘ইউক্রেনে রুশ শক্তিমত্তার দুটি কুখ্যাত প্রতীক ধ্বংস হয়েছে।’

রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, ইউক্রেনের এই প্রতিক্রিয়াই প্রমাণ করে এটি ইউক্রেনের চালানো সন্ত্রাসী হামলা।

‘বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংস হবার পর কিয়েভ প্রশাসনের এই প্রতিক্রিয়া তাদের সন্ত্রাসী মনোভাবেরই প্রমাণ দেয়,’ বলেন তিনি।

রাশিয়ানরা কী বলছে?
রাশিয়ার জাতীয় সন্ত্রাস দমন কমিটি জানিয়েছে, শনিবার মস্কোর সময় সকাল ৬টা ৭ মিনিটে তামান উপদ্বীপের দিকে ক্রিমিয়া সেতুর ওপর মালবাহী একটি যান থেকে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

এর ফলে ক্রিমিয়া উপদ্বীপে যাওয়া তেলবাহী একটি ট্রেনের সাতটি তেলের ট্যাংকে আগুন ধরে যায়। সেতুর ওপর মোটরওয়ের দুটি অংশ আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে।

ক্রিমিয়ার সংসদীয় স্পিকার ভ্লাদিমির কনস্তানিনফ ‘ইউক্রেনের নাশকতাকারীদের’ এই বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করে বলেছেন, ‘তারা অবশেষে ক্রিমিয়া সেতুর ওপর তাদের রক্তাক্ত ছোবল বসিয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সেতুটির ক্ষতি দ্রুত সারিয়ে ফেলা হবে, যেহেতু ক্ষতি খুব মারাত্মক ধরনের নয়।’

রাশিয়া বলেছে, সেতুর রেলপথের অংশটি আজ সন্ধ্যাতেই আবার চালু করে দেয়া হবে।

প্রেসিডেন্ট পুতিনকে সেতুটির ‘জরুরি অবস্থা’ সম্পর্কে ব্রিফ করা হয়েছে। তিনি ঘটনাটি অনুসন্ধানে সরকারি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। ইন্টারফ্যাক্স সংবাদ সংস্থা ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভকে উদ্ধৃত করে এই খবর দিয়েছে। এ ঘটনার ফৌজদারি তদন্তও চলছে।

ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার নিযুক্ত প্রধান সের্গেই আকসিওনফ সেখানকার বাসিন্দাদের শান্ত থাকার আবেদন জানিয়ে বলেছেন, ক্রিমিয়া উপদ্বীপে পর্যাপ্ত খাদ্য ও জ্বালানির মজুত রয়েছে।

কার্চ সেতু
রাশিয়ার জন্য বিভিন্ন কারণে এই সেতুর গুরুত্ব অপরিসীম। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে নিজের এলাকাভুক্ত করার পর ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট পুতিন এই সেতু উদ্বোধন করেছিলেন - ‘ক্রাইমিয়া যে রাশিয়ারই’ তার একটি প্রতীক হিসেবে।

দক্ষিণ ইউক্রেনের রণাঙ্গনে লড়াইয়ের জন্য এই সেতু পথেই রাশিয়া সামরিক সরঞ্জাম, গোলাবারুদ ও সৈন্য পাঠাচ্ছে।

ক্রিমিয়াতে রুশ সেনাবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। এবং ইউক্রেন এই উপদ্বীপটি পুনর্দখলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ফলে এই উপদ্বীপের দখল ধরে রাখা রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সেতুর ওপর দিয়ে সড়ক ও রেলপথ সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে। ক্রিমিয়ার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বলছে, রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড ও উপদ্বীপটির মধ্যে তারা ফেরি চলাচলের ব্যবস্থা করবে।

রুশ কর্তৃপক্ষ আশা করছে আজ রাতের মধ্যেই তারা সেতুর রেলপথ আবার চালু করার ব্যবস্থা করতে পারবে।

কার্চ প্রণালীর ওপর দিয়ে ১৯ মিটার (১২ মাইল) লম্বা এই সেতুটি নির্মাণে খরচ হয়েছিল ২৭ কোটি ডলার।

কিভাবে এই বিস্ফোরণ?
ইউক্রেন অধিকৃত অঞ্চল থেকে এই সেতু ১০০ মাইলেরও বেশি দূরে।

একজন বিস্ফোরণ বিশেষজ্ঞ বিবিসিকে বলেছেন, কোনো ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে এই বিস্ফোরণ ঘটেনি বলেই তাদের অনুমান।

‘বিস্ফোরণ থেকে রাস্তার ওপর ছিটকে পড়া কোনোরকম ভগ্নাংশ বা টুকরো যেহেতু নেই, তাই আকাশ থেকে ছোড়া কোনো সমরাস্ত্র দিয়ে এই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়নি বলে মনে হচ্ছে,’ বলেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘সেতুর নিচ থেকে চালানো পূর্ব-পরিকল্পিত হামলা সম্ভবত এই বিস্ফোরণের কারণ।’

‘আমার সন্দেহ সেতুর সড়কপথে এবং ট্রেনের ওপরে রাখা বিস্ফোরক ফাটানো হয়েছে রেডিও সংকেত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে।’

এটি ইউরোপের সবচেয়ে দীর্ঘ সেতু এবং নির্মাণের সময় রাশিয়া এটিকে ‘এই শতাব্দীর সেরা নির্মাণ কাজ’ বলে ব্যাখ্যা করেছিল।

সূত্র : বিবিসি