বিপদ-সঙ্কটে নবী সা:-এর নীতি

বিপদ-সঙ্কটে নবী সা:-এর নীতি

বিপদ-সঙ্কটে নবী সা:-এর নীতি

আল্লাহর দাসত্বের জন্য প্রেরিত মানুষের এই পার্থিব জীবন একেবারেই নির্ঝঞ্ঝাট নয়। হাজারো সমস্যা, বিপদ-মুসিবত, দুঃখ-কষ্ট, রোগ-শোক তার জীবনের সাথে লেগেই আছে। মানবজীবনে নেমে আসা এসব যাবতীয় দুর্যোগ, সঙ্কট, বিপদ-মুসিবত থেকে উত্তরণের উপায় কুরআন ও হাদিসের বিভিন্ন জায়গায় স্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে। সেটিই নবী সা:-এর নীতি ও আদর্শ। মানবজীবনে বিভিন্ন সময়ে আপতিত হওয়া নানা বিপদ-মুসিবত থেকে উত্তরণে রাসূল সা:-এর নীতি ও আদর্শ কী ছিল-
ইন্না লিল্লাহ পড়া : ছোট-বড় সব সঙ্কট-মুসিবতে রাসূল সা:-এর একটি শিক্ষা হলো- ‘ইসতিরজা’ পড়া। ইসতিরজা মানে হলো ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়া।

একটি হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘যখন তোমাদের কারো জুতার ফিতা ছিঁড়ে যায় তখনো তোমরা ইন্না লিল্লাহ পড়ো। কেননা, এটিও একটি বিপদ।’ (শুয়াবুল ঈমান, বায়হাকি-৯২৪৪) ‘কোনো বান্দার কোনো মুসিবত দেখা দিলে সে যদি বলে- আমরা আল্লাহরই এবং আমরা তাঁরই কাছে ফিরে যাব। হে আল্লাহ! আমাকে এ মুসিবতের দরুন সাওয়াব দান করুন এবং এর উত্তম বিকল্প দান করুন। তাহলে আল্লাহ সে মুসিবতে তাকে সাওয়াব দান করবেন এবং তাকে উত্তম বিকল্প দান করবেন।’ (মুসলিম-৯১৮)

সবর করা : বিপদ-মুসিবতের সময় রাসূলুল্লাহ সা:-এর বড় নীতি ও আদর্শ হলো সবর করা। বিপদে সবর করাকে হাদিসে মুমিনের সৌভাগ্যের নিদর্শন আখ্যা দেয়া হয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ-১৪৪৫) একটি হাদিসে কুদসিতে এসেছে- রোগ-শোকে ভোগা মানুষ যদি সবর অবলম্বন করে আল্লাহ তায়ালা সেই ধৈর্য ধারণকারী ব্যক্তিকে এর বিনিময়ে জান্নাত দান করবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আমি যখন আমার কোনো বান্দাকে তার প্রিয় দু’টি বস্তু তথা দু’চোখ দিয়ে বিপদগ্রস্ত করি ও সে সেই বিপদে ধৈর্য ধারণ করে আমি সে দু’টি প্রিয় বস্তুর বদলায় তাকে জান্নাত দান করি।’ (বুখারি-৫৬৫৩) আরেকটি হাদিসে মহামারীর সময় সবরকারীকে শহীদের সাওয়াব দেয়ার কথা বলা হয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ-১৪৮৭৫)
নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত : রাসূলুল্লাহ সা:-এর অভ্যাস ছিল তিনি যখনই কোনো সঙ্কটে পড়তেন তখনই নামাজ শুরু করতেন। (যাদুল মায়াদ, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৩০৪) আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বিপদের সময় ধৈর্য ও নামাজ এই দু’টি আমল করার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন এবং ঘোষণা দিয়েছেন- ধৈর্য ধারণকারীদের সাহায্যে তিনি থাকবেন।

(সূরা বাকারা-১৫৩) শুধু আল্লাহ তায়ালার সহায়তাই নয়, ধৈর্যশীলদের তিনি বেহিসাব সাওয়াব দিয়ে পুরস্কৃত করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। (সূরা জুুমার-১০) এমনিভাবে বিপদাপদের সময় সবরকারীদের তিনি সত্যাশ্রয়ী ও তাকওয়ার অধিকারী বলে আখ্যা দিয়েছেন। (সূরা বাকারা-১৭৭)

সওয়াবের আশা রাখা : বিপদাপদের সময় বান্দার করণীয় হচ্ছে- আল্লাহ তায়ালা বান্দাদেরকে মুসিবতের বিনিময়ে সাওয়াব দেবেন- এই প্রত্যাশা রাখা। হাদিসে এই আমলের বিনিময়ে জান্নাত প্রাপ্তির কথা ঘোষিত হয়েছে। (বুখারি-৬৪২৪)
রাসূলুল্লাহ সা:-এর প্রিয়তমা কন্যা তাঁর এক পুত্রের মুমূর্ষুতার কথা জানিয়ে খবর পাঠালে তিনি তাঁকে লোক মারফত জানালেন, সে যেন সবর ও বিপদে সাওয়াবের আশা করে।’ (বুখারি-১২৮৪, মুসলিম-৯২৩)

আল্লাহর প্রতি অভিযোগ-অনুযোগ না করা : বিপদাপদে একজন মুমিন কোনোভাবেই আল্লাহর প্রতি অভিযোগ-অনুযোগ করবে না। বরং ওই সময়ও সেই কথাই বলবে যা তার রব পছন্দ করেন। রাসূলুল্লাহ সা:-এর পুত্র হজরত ইবরাহিম রা: যখন প্রাণ ত্যাগ করছিলেন তখন তিনি পুত্রশোকে কাঁদতে কাঁদতে বললেন- ‘চোখ অশ্রু ঝরাচ্ছে, অন্তর ব্যথিত হচ্ছে, এরপরও আমরা কেবল তাই বলছি যা আমাদের প্রতিপালক পছন্দ করেন।’ (বুখারি-১৩০৩, মুসলিম-২৩১৫) এমনিভাবে তিনি জ্বরকে ভর্ৎসনা করতে নিষেধ করেছেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ-২৮১০)

দোয়া করা : বিপদাপদে দোয়া করার কথা অসংখ্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন। বিভিন্ন বিপদে ভিন্ন ভিন্ন, আবার অভিন্ন সে দোয়াগুলো হাদিসগ্রন্থে বর্ণিত আছে।

তাফসিরে নুরুল কুরআনে, তাফসিরে মাজহারির বরাতে উল্লেখ আছে- হজরত সাইদ ইবনে জোবাইর রা: বলেন, মুসিবতের সময় এ উম্মতকে যেসব দোয়া শিক্ষা দেয়া হয়েছে, অন্য কোনো উম্মতকে তা শিক্ষা দেয়া হয়নি। উম্মতে মুহাম্মদি ছাড়া আর কাউকে যদি এ দোয়া শিক্ষা দেয়া হতো, তবে তা হজরত ইয়াকুব আ:-কে শিক্ষা দেয়া হতো। কিন্তু তাঁকেও দোয়া শিক্ষা দেয়া হয়নি যার কারণে তিনি পুত্র ইউসুফ আ:-এর বিচ্ছেদ-বেদনায় বলেছিলেন, ‘ইউসুফের জন্য হায় আফসোস!’ (সূরা ইউসুফ-৮৪) ‘আমি আমার বেদনা ও দুঃখের কথা শুধু আল্লাহর কাছে নিবেদন করছি।’ (সূরা আম্বিয়া-৮৭)

এমনিভাবে হজরত ইউনুস আ: মাছের পেটের অন্ধকারে, আইউব আ: দুরারোগ্য কঠিন পীড়ায় এই ধরনের কথা জপেছিলেন যেখানে সরাসরি কোনো প্রার্থনা ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার মেহেরবানি, তিনি এই উম্মাহকে তাঁর নবীর মাধ্যমে যাবতীয় আপদ-বিপদ, দুঃখ-দুর্দশায় অসংখ্য জাদুকরি শব্দের দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। ‘হে আল্লাহ! আমি আমার দ্বীন ও দুনিয়ার ব্যাপারে আপনার কাছে ক্ষমা ও নিরাপত্তা চাই এবং আমার পরিবার-পরিজন ও অর্থ-সম্পদের ব্যাপারেও। হে আল্লাহ! আমার গোপন বিষয়গুলো ঢেকে রাখুন এবং যেসব বিষয়ে শঙ্কাবোধ করি তা থেকে আমাকে নিরাপদ রাখুন। আমাকে হিফাজত করুন আমার সম্মুখ দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে, বাম দিক থেকে ও উপর থেকে। আর আমি আপনার মহিমার আশ্রয় গ্রহণ করছি যাতে আমি নিচের দিক থেকে বিপন্ন না হই।’ (ইবনে মাজাহ-৩৮৭১, সহিহ ইবনে হিব্বান-৯৬১)
বিপদ-মুসিবতে বাহ্যিক উপায়-উপকরণ অবলম্বন করা : বিপদাপদে উপায়-উপকরণ অবলম্বন না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকা ইসলাম পরিপন্থী বিষয়। রাসূলুল্লাহ সা:-এর শিক্ষা হলো আপতিত মুসিবত থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশে সম্ভাব্য সব ধরনের উপায়-উপকরণ অবলম্বন করা। যেমন- রোগ হলে তিনি চিকিৎসা গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- ‘হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো। কারণ, আল্লাহ যত রোগ সৃষ্টি করেছেন সব রোগেরই ওষুধ সৃষ্টি করেছেন।’ (জামে তিরমিজি-৩৮৩)

তাওয়াক্কুল করা : বিপদ উত্তরণে সম্ভাব্য ব্যবস্থা গ্রহণের সাথে সাথে করণীয় হলো- আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল বা ভরসা করা। কারণ, আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আমাদের ওপর যেসব বিপদ-মুসিবত আসে তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, একমাত্র তিনিই আমাদেরকে এর থেকে উদ্ধার করার জন্য যথেষ্ট। (সূরা তালাক-৩) এটিই তাওয়াক্কুল। বিপদাপদের সময় আল্লাহর ওপর ভরসা আর উপায়-উপকরণ গ্রহণ একটি আরেকটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তবে তাওয়াক্কুল করার আগে করণীয় হলো উপায়-উপকরণ গ্রহণ করা। একটি হাদিসে এসেছে- জনৈক রাখাল সাহাবিকে উটের হিফাজতের জন্য রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘প্রথমে উটের পায়ে রশি লাগাও, তারপর আল্লাহর ওপর ভরসা করো। (জামে তিরমিজি-২৫১৭) এটিই নবীর শিক্ষা, আগে তোমার চেষ্টা শেষ করো, তারপর বল- ‘হে আল্লাহ! আমি আমার চেষ্টা সম্পাদন করেছি, তবে ভরসা তো আপনারই ওপর।’ (জামে তিরমিজি-৩৪১৯)

তওবা-ইসতিগফার করা : বিপদ-মুসিবত আসার জন্য গোনাহ একটি অন্যতম কারণ। এই গোনাহের বিষ দূর করতে পারলেই অবশ্যম্ভাবীভাবে বিপদ-মুসিবত থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব। আর গোনাহের বিষ দূর করার সবচেয়ে উত্তম উপায় হচ্ছে তওবা ও ইসতিগফার করা। এ ব্যাপারে বহু হাদিস রাসূলুল্লাহ সা: থেকে বর্ণিত আছে। (ইবনে মাজাহ-৪২৫০) হাদিসে তিনি ইসতিগফারকে সব সঙ্কট ও দুর্ভাবনা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সর্বদা ইসতিগফার করে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য প্রত্যেক সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেন, প্রত্যেক দুশ্চিন্তার বিষয় থেকে মুক্তি দান করেন আর তাকে এমন স্থান থেকে রিজিক দান করেন যা সে ভাবতেও পারে না।’ (সুনানে আবু দাউদ-১৫১৮)
মানুষের জীবনে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময়ে বিপদাপদ আসে। সেটি কখনো কল্যাণস্বরূপ, কখনো শাস্তিস্বরূপ আবার কখনো শিক্ষাপ্রদ হয়ে থাকে।

ইসলাম যেহেতু পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, সেহেতু ইসলামের নবী মানবসভ্যতার মহাপুরুষ রাসূলুল্লাহ সা: উম্মাহর জন্য এ ব্যাপারে স্পষ্ট আদর্শ রেখে গেছেন। অন্যান্য বিষয়ের মতো এখানেও তার আদর্শই মানবজীবনের যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশা, বালা-মুসিবত ও সঙ্কট উত্তরণের শতভাগ কার্যকরী ও প্রমিত ব্যবস্থাপত্র।

লেখক: শিক্ষাসচিব ও সিনিয়র মুহাদ্দিস, আয়েশা ছিদ্দিকা রা: মহিলা মাদরাসা কমপ্লেক্স, কুমিল্লা।