বিএনপি'র সমাবেশের শহরে গণপরিবহন রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে?

বিএনপি'র সমাবেশের শহরে গণপরিবহন রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে?

বিএনপি'র সমাবেশের শহরে গণপরিবহন রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে?

একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের দাবিতে বিরোধীদল বিএনপি বিভাগীয় শহরগুলোর যেখানেই সমাবেশ করছে, সেখানেই পরিবহন ধর্মঘট ডাকা একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভাগীয় শহর ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, বরিশালের পর ফরিদপুরে বিএনপির সমাবেশের আগের দিন অর্থাৎ ১১ই নভেম্বর ভোর থেকে দুই দিনের পরিবহন ধর্মঘটের ঘোষণা দেয়া হয়।

সর্বশেষ সিলেট শহরে আগামী শনিবার বিএনপির সমাবেশের দিনই সেখানে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। তবে শহরটিতে এর আগের দুই দিন একটি ধর্মীয় সমাবেশ থাকায় পরিবহন ধর্মঘট পালন করা হবে একদিন।বিএনপি অভিযোগ করেছে যে তাদের সমাবেশগুলোতে লোকসমাগম ঠেকাতেই সরকারের ইঙ্গিতে গণপরিবহনের ধর্মঘট ডেকে সমাবেশের জন্য নির্দিষ্ট শহরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হচ্ছে।

কোন কোন শহরে ঘোষণা দিয়ে, আবার কোথাও অঘোষিতভাবে পালিত পরিবহন ঘর্মঘটে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসা-বাণিজ্য মারাত্মক বিড়ম্বনা ও সংকটে পড়েন।বিরোধীদলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গণপরিবহনকে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠছে।আর গণপরিবহনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার কতটা যৌক্তিক- এমন প্রশ্নও অনেকে তুলছেন।তবে পরিবহনখাতে এ ধরনের ধর্মঘটের দায় নিতে চাইছে না কেউ।

সমাবেশের শহরে ধর্মঘট

বিএনপি তাদের ধারাবাহিক বিভাগীয় পর্যায়ের সমাবেশের প্রথম কর্মসূচিটি পালন করে চট্টগ্রামে গত ১২ই অক্টোবরে।খানিকটা ব্যতিক্রম হিসেবেই চট্টগ্রামের সমাবেশে বিএনপিকে কোন পরিবহন ধর্মঘটের মুখে পড়তে হয়নি, তবে দলটির স্থানীয় নেতারা অভিযোগ করেছিলেন যে সমাবেশে আসার ক্ষেত্রে কর্মী-সমর্থকেরা বাধার সম্মুখীন হয়েছিলন।চট্টগ্রামের সেই প্রথম সমাবেশে ব্যাপক লোক সমাগমের বিষয়টি আলোচনায় আসে রাজনৈতিক অঙ্গনে।

এরপর ময়মনসিংহে বিএনপির দ্বিতীয় সমাবেশ আয়োজনের সময় থেকেই দলটিকে পরিবহন ধর্মঘটের মুখোমুখি হতে হয়। এবং তখন থেকেই সমাবেশের জন্য নির্দিষ্ট শহরে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হচ্ছে।খুলনা আর রংপুরে বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে একই ঘটনা ঘটেছে।তবে গত ৫ই নভেম্বর বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে বরিশাল অঞ্চলে সড়ক পরিবহনে ধর্মঘট ডাকার পাশাপাশি লঞ্চ-সহ সব ধরনের নৌযানও ধর্মঘট পালন করেছিল।

কেন পরিবহন ধর্মঘট?

দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির সমাবেশের দিন বা আগের দিন পরিবহন ধর্মঘটের ডাকার পেছনে যেসব কারণ দেখানো হচ্ছে, তার মধ্যে মিল দেখা যাচ্ছে।

বাস ধর্মঘটের কারণ হিসাবে স্থানীয় পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতারা মহাসড়কে নসিমন-করিমন এবং তিন চাকার ছোট যানবাহন চলাচল বন্ধের তাদের দাবির কথা বলেছিলেন।ফরিদপুরে ১২ই নভেম্বর বিএনপির সমাবেশের আগের দিন থেকে দুই দিনের বাস ধর্মঘট ডাকার কারণ হিসেবে সেখানকার পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক গোলাম নাসির বিবিসি বাংলাকে বলেন, মহাসড়কে ছোট অবৈধ যানবাহন বন্ধের দাবিতে বাস বন্ধ রাখা হবে।

তবে দেখা গেছে যে বিএনপির সমাবেশ ডাকা এলাকায় যখন নসিমন-করিমন এবং তিন চাকার ছোট যানবাহন বন্ধের দাবিতে বাস মালিক-শ্রমিকেরা ধর্মঘট পালন করেছেন, তখন ওই সব এলাকায় এসব ছোট যানবহন মালিক-শ্রমিকেরাও ধর্মঘট করছেন।বরিশালে বিএনপির সমাবেশের সময় এমন চিত্র দেখা গেছে। সেখানে বাস এবং লঞ্চসহ নৌযান ধর্মঘটের পাশাপাশি বরিশাল শহরের ভেতরেও দুই দিন সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল।

সাধারণ মানুষের ভোগান্তি

রাজনৈতিক দলের সমাবেশকে টার্গেট করে দেওয়া পরিবহন ধর্মঘটের কারণে একের পর এক বিভাগীয় শহর পুরো বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

ওই সব শহরে পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বা বিড়ম্বনার খবরও সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে।যাত্রীদের অধিকার নিয়ে আন্দোলনকারী সংগঠন যাত্রী কল্যাণ সমিতির নেতা মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, পরিবহন ধর্মঘটের কারণে ওই সব শহরে রোগী আনা-নেয়া এবং চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মতো কাজও ব্যাহত হয়েছে।

এছাড়া অনেক মানুষ অসহায় অবস্থায় পড়েছেন এবং সাধারণ যাত্রীদের নানা রকম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন এমন তথ্য তারা পেয়েছেন।গণপরিবহনের এভাবে ধমর্ঘট করে সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকার এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।  মি. চৌধুরীর বক্তব্য হচ্ছে, যানবাহন সচল রাখার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভোগান্তির পরও এই পরিবহন ধর্মঘট নিয়ে সরকারের কোন "বিকার লক্ষ্য" করা যায়নি।

গণপরিবহনও রাজনৈতিক হাতিয়ার?

বিএনপির সমাবেশের শহরে পরিবহন ধর্মঘট পালনের একের পর এক ঘটনার ব্যাপারে দলটি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আসছে।দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তাদের সমাবেশগুলোতে ব্যাপক লোকসমাগম হচ্ছে, আর এই লোকসমাগম ঠেকাতে সরকার গণপরিবহনকেও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে।তবে এসব ধর্মঘটের জন্য ক্ষমতাসীনদেরকে দায়ী করছে। সরকারের নির্দেশেই পরিবহন ধর্মঘট করা হচ্ছে বলে বিএনপির অভিযোগ।তবে সরকারের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতারা এসব পরিবহন ধর্মঘটের দায় অস্বীকার করে আসছেন।আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং  সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে পরিবহন ধর্মঘটের সাথে সরকারের কোন সম্পর্ক নেই এবং বিএনপির সমাবেশ আয়োজনের ক্ষেত্রে তারা কোন বাধাও দিচ্ছেন না।

সরকারের আরও কয়েকজন মন্ত্রী একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন।বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে যে শহরগুলোতে পরিবহন ধর্মঘট হয়েছে, তার মধ্যে বরিশাল এবং খুলনার দু’জন বাস মালিক এবং কয়েকজন শ্রমিকের সাথে কথা হয়।নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেছেন,  সরকারের অনানুষ্ঠানিক নির্দেশে তাদের পরিবহন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়।

তবে দায় কার?

সরকার যেমন এর দায় নিতে রাজি নয়, তেমনই পরিবহন-মালিক শ্রমিকদের কেন্দ্রীয় নেতারাও ধর্মঘটের দায় নিচ্ছেন না। যদিও ধর্মঘটের কারণ সম্পর্কে তাদের কেন্দ্র এবং মাঠ পর্যায়ের নেতাদের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে।

সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামের সদস্য। তিনি সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন, বর্তমানে একজন এমপি। তিনি বলেন যে ভীতি থেকে এসব ধর্মঘট হচ্ছে।বিএনপির কর্মসূচির প্রতি ভীতি আছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের, বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. খান। সেজন্য ওই দলের সমাবেশের কর্মসূচি থাকলে নির্দিষ্ট শহরে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা স্থানীয়ভাবে ধর্মঘট করছে বলে দাবি করেন তিনি।

এ ব্যাপারে শাজাহান খান আরও ব্যাখ্যা দেন এভাবে: “২০১৪ সালের নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে বিএনপি ২০১৩ সাল থেকে তিন বছর বাস চলাচলে পেট্রোল বোমা হামলা করেছে এবং যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করেছে।“ওই তিন বছরে বিএনপি-জামায়াতের কর্মসূচিতে সহিংসতায় অনেক বাস এবং ট্রাক চালক ও হেলপার হতাহত হয়েছে,” বলেন মি. খান।

তিনি আরও বলেন, সে সময়  সারাদেশে এক হাজার বাস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল এবং হামলা ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তিন হাজারের বেশি যানবাহন।আওয়ামী লীগের এই নেতার বক্তব্য হচ্ছে, সহিংসতার ভয়ে বাস মালিক-শ্রমিকেরা বিএনপির কর্মসূচি থাকলে সেই শহরে পরিবহন বন্ধ রাখছেন।এ ব্যাপারে তাদের সমিতি কেন্দ্রীয়ভাবে কোন সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা দেয়নি এবং সরকার পক্ষ থেকেও কোন নির্দেশ নেই বলে দাবি করেন মি. খান।

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙা জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মিত্র দল হিসাবে জাতীয় পার্টি থেকে যারা মন্ত্রী হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাদের একজন।তিনিও অনেকটা শাজাহান খানের মতো কথা বলেছেন।পরিবহন মালিক এবং শ্রমিকদের দুই সংগঠনের শীর্ষ দু’জন নেতা বিএনপির কর্মসূচির সময় সহিংসতার আশঙ্কা এবং মালিক শ্রমিকদের ভয়ের কথা বলেছেন।

কিন্তু বরিশাল, খুলনা, রংপুর বা ময়মনসিংহে বিএনপির সমাবেশের সময় ধর্মঘটের কারণ হিসাবে স্থানীয়ভাবে মহাসড়কে ছোট যানবাহন চলাচল বন্ধের দাবির কথা বলা হয়েছে।ফরিদপুরেও বাস মালিক শ্রমিক নেতারাও ধর্মঘটের কারন হিসাবে মহাসড়কে ছোট যানবাহন বন্ধের একই রকম দাবির কথা বলছেন।তবে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কেন্দ্রীয় নেতারা যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে মূলত নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলছেন।

বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমাবেশের সময় গণপরিবহন বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে এ ধরনের যুক্তি দেয়া হলেও অতীতে দেখা গেছে যে বিভিন্ন সময় হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে গণপরিবহন চালানো হয়েছে।যেহেতু হরতাল অবরোধের মতো কর্মসূচিতেই যানবাহনের নিরাপত্তা ঝুঁকি বেশি থাকে, তাই এখন নিরাপত্তার ইস্যুটিকে সামনে আনাকে একটি অজুহাত বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।

যৌক্তিকতার প্রশ্ন

বিএনপি অভিযোগ করেছে, একটি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে তাদের অধিকারও খর্ব করা হচ্ছে।দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, পরিবহন ধর্মঘট করা হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে, সেজন্য সরকার এর যৌক্তিক কোন কারণ দেখাতে পারছে না।কিন্তু সরকার যেমন এর দায় স্বীকার করছে না, তেমনই ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নিয়ন্ত্রিত পরিবহন খাতের কর্তাব্যক্তিরা ধর্মঘটের দায় চাপাচ্ছেন স্থানীয়পর্যায়ের মালিক-শ্রমিকদের ওপর।ফলে যৌক্তিকতার প্রশ্নে তাদের কাছ থেকেও সঠিক কোন জবাব মিলছে না।

তবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে পরিবহন বন্ধ করা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়।বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন পরিবহন মালিকদের সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব ছিল দলটির প্রভাবশারী কয়েকজন নেতার হাতে।সেই সরকারের আমলেও তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগের আন্দোলন বা সমাবেশ দমাতে পরিবহন বন্ধ করা হয়েছিল।অতীতের সেই প্রসঙ্গও টেনে আনছেন সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতা এবং তাদের পাশাপাশি পরিবহন খাতের এখনকার নেতারা।

পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন নেতা শাজাহান খান বলেছেন, বিএনপি সরকারে থাকাকালে আওয়ামী লীগের সমাবেশ-অবরোধের প্রতিটি কর্মসূচির পরিবহন বন্ধ করে দিতো।ফলে এখন বিএনপির অভিযোগ মানায় না বলে তিনি মন্তব্য করেন।কিন্তু একই ধরনের কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগ সরকারকেও কেন করতে হচ্ছে-এমন প্রশ্নের একটি সন্তোষজনক জবাব কোনভাবেই পাওয়া যাচ্ছে না।তবে ভুক্তভোগীরা অন্তত একমত যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই বিরোধীদলের সমাবেশকে কেন্দ্র করে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হচ্ছে।

সূত্র : বিবিসি