তিন শতাধিক আমদানি পণ্যে কেন শুল্ক বাড়াতে চাইছে বাংলাদেশের সরকার?

তিন শতাধিক আমদানি পণ্যে কেন শুল্ক বাড়াতে চাইছে বাংলাদেশের সরকার?

তিন শতাধিক আমদানি পণ্যে কেন শুল্ক বাড়াতে চাইছে বাংলাদেশের সরকার?

বাংলাদেশে গত কয়েকমাস ধরে ডলার সংকট এবং আমদানিতে কড়াকড়ির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাজারের ওপরে। যেসব পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, জুলাই মাসের তুলনায় নভেম্বর মাসে এসে সেগুলোর দাম প্রায় দেড়গুণ বেড়ে গেছে।

আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে মে মাসে শতাধিক পণ্যের শুল্ক বাড়িয়েছিল বাংলাদেশের সরকার। এখন আরও তিন শতাধিক পণ্যের শুল্ক বাড়ানোর আলোচনা চলছে। সেই সঙ্গে ডলার সংকটের কারণে অনেক পণ্য আমদানি করার জন্য ঋণপত্র খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা।ফলে আমদানি নির্ভর বাংলাদেশের বাজারে ফল থেকে শুরু করে গাড়ির যন্ত্রাংশ- অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে।

৩৩০ আমদানি পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব

আমদানি নিরুৎসাহিত করতে গত মে মাসে ১৩৫টি পণ্যে শুল্ক বাড়িয়েছিল  বাংলাদেশের সরকার।কিন্তু তারপরেও বাণিজ্য ঘাটতি খুব একটা কমেনি। ফলে আর কোন কোন পণ্যে শুল্ক বাড়ানো যেতে পারে, সেটা যাচাই করতে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনকে অনুরোধ জানিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

সেই অনুরোধের প্রেক্ষিতে কমিশন ৩৩০টি পণ্যের একটি তালিকা তৈরি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সেটি পাঠানো হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর)।মূলত বিলাসী এবং কম গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় পণ্য এই তালিকায় প্রাধান্য পেয়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে আসবাবপত্র, ফল ও ফুল, ইলেকট্রনিক্স, গৃহস্থালি সরঞ্জাম, ধাতু,  চামড়াজাত পণ্য, পোশাক, সিরামিক পণ্য, টিনজাত খাদ্য, চকলেট, কোমল পানীয়, অ্যালকোহল জাতীয় পণ্য, তামাক, চকলেট, বিস্কুট, টিনজাত খাদ্য-ইত্যাদি পণ্য এই তালিকায় রয়েছে। ট্যারিফ কমিশন সুপারিশ করেছে, এসব পণ্যে শুল্ক বাড়ানো হলে একশো কোটি ডলার সাশ্রয় হতে পারে।বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘’তালিকাটি নিয়ে এনবিআর কাজ করছে। যত দ্রুত সম্ভব করার জন্য আমি তাদের অনুরোধ করেছি।‘’

ঋণপত্র খোলা ও আমদানি নিয়ন্ত্রণে যেসব প্রভাব পড়ছে বাজারে

ঢাকার বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদেশ থেকে আমদানি করা ফল থেকে শুরু করে গাড়ির যন্ত্রাংশ, সব কিছুর দাম গত কয়েক মাসে অন্তত দেড়গুণ বেড়েছে।ঢাকার গ্রিন রোডে গাড়ির টায়ার এবং যন্ত্রাংশের ব্যবহার করেন ইব্রাহিম আহমেদ। তিনি বলছিলেন, জুলাই মাসে প্রাইভেট কারের যে টায়ার বিক্রি করেছি ৬ হাজার ৮০০ টাকা দামে, সেটাই এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ১০ হাজার ৯০০ টাকা দরে। এর মতো সব জিনিসের দাম দেড় গুণ, দ্বিগুণ বেড়েছে।

শাহজাহানপুরে ফলের দোকান রয়েছে মনোয়ার হোসেনের। তিনি বলছিলেন, যে আপেল বিক্রি করতাম দেড়শ টাকা দামে, সেটাই এখন দুইশ ৪০ টাকা। যে মাল্টা জুলাই মাসেও বিক্রি করেছিলাম ১৪০ টাকা দরে, সেটা ২৬০ টাকা করে বিক্রি করতে হচ্ছে।দাম বেড়েছে আমদানি করা পোশাক, চামড়ার পণ্য, চকলেটের।তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এসব পণ্যের দাম বাড়লেও তার প্রভাব পড়বে মূলত উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের ওপরে। কম গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় সাধারণ মানুষের ওপর এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা কম। 

কেন আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার

বাংলাদেশে এই বছরের মাঝামাঝি থেকে বৈদেশিক মুদ্রার যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা আরও প্রকট হয়েছে।  বর্তমানে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৪ বিলিয়ন ডলার। তবে নেট রিজার্ভ আছে মাত্র ২৬ বিলিয়ন ডলার।

কিন্তু আমদানি বাড়লেও বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়েনি। ফলে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, তার তুলনায় আমদানিতে অনেক বেশি ডলার চলে যাচ্ছে।তবে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, এখন ডলার সংকটের কারণে বেশিরভাগ ব্যাংক এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না।

লালবাগের খেলনা আমদানিকারক মফিজউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘’চারটা ব্যাংক ঘুরে এলসি খুলতে পারি নাই। আমার যে ব্যাংক, ওদের কাছে ডলার নেই। শুধু অপেক্ষা করতে বলতেছে।‘’বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, চলতি বছরের মার্চ মাসে ৯৮০ কোটি ডলারের এলসি খোলা হলেও সেপ্টেম্বর মাসে সেটি নেমে দাঁড়িয়েছে ৫৭০ কোটিতে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেছেন, ‘’আমাদের বেশিরভাগ বৈদেশিক মুদ্রা আস রেমিট্যান্স থেকে। কিন্তু সম্প্রতি রেমিট্যান্স প্রবাহ অস্বাভাবিক হারে কমেছে। এ কারণে আমদানির এলসি খুলতেও বাড়তি সতর্কতা নেয়া হয়েছে।‘’কিন্তু এসব উদ্যোগ বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সক্ষম হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে (জুলাই, অগাস্ট ও সেপ্টেম্বর) বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি রয়েছে ৩৬১ কোটি ডলার বা প্রায় তিন দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই সময় যে পরিমাণ পণ্য রপ্তানি হয়েছে, তার তুলনায় ৩৬১ কোটি ডলারের পণ্য বেশি আমদানি হয়েছে।কিন্তু সার্বিক বাণিজ্যের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার।

অর্থাৎ  এই সময় বাংলাদেশ রপ্তানি আয় রেমিট্যান্স মিলিয়ে আয় করেছে করেছে এক হাজার ১৮০ কোটি ডলার, কিন্তু আমদানি ব্যয়, বিদেশে চলে যাওয়া অর্থ মিলে পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৯৩৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ সার্বিক ঘাটতি বেড়েই চলেছে। যেভাবে বাংলাদেশের ঘাটতি বেড়ে চলেছে, তাতে সেটি সহসা পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা। ফলে এই ঘাটতি কমাতে এখন আমদানি পণ্যে কড়াকড়ি আরোপ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।  

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রিজার্ভের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এমন একটি পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে, অতি জরুরি ক্ষেত্র ছাড়া এই মুহূর্তে অন্য কোথাও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করার মতো সুযোগ নেই। অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, "এটা এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, অনেক বেশি সুচিন্তিত হওয়া, অনেক বেশি কাটছাঁট করা দরকার।‘’ ‘’গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য পণ্য ছাড়া কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য, বিলাসবহুল পণ্য আমদানি সীমিত করে দেয়ার সময় এসেছে। সরকারের এক্ষেত্রে কড়া পদক্ষেপ নেয়া দরকার’’ তিনি বলছেন। 

যদিও শুল্ক আরোপের ফলে কিছু পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। কিন্তু তাতে উচ্চবিত্ত বা ধনী শ্রেণির ওপর চাপ পড়লেও বেশিরভাগ মানুষের জন্য কোন সমস্যা হবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ।  তিনি বলছেন, ‘’সব আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানো হলে সেটা জনগণের ওপর চাপ তৈরি করতো, জিনিসপত্রের দাম আরও বাড়িয়ে দিতো। কিন্তু যদি বিলাসী এবং কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়ানো হয়, তাহলে ধনী শ্রেণির ওপর হয়তো চাপ বাড়বে, কিন্তু সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে। কারণ এসব পণ্য আমদানি কমলে সেই অর্থ অন্যত্র কাজে আসবে।‘’

সূত্র : বিবিসি