পাবনায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে শিক্ষার্থীরা

পাবনায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে শিক্ষার্থীরা

পাবনায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে শিক্ষার্থীরা

পাবনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, নেই জরুরী চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা । পাবনা পৌর এলাকায় সরকারি একটি মাত্র স্কুল হেলথ ক্লিনিক থাকলেও তা জানেনা অধিকাংশ শিক্ষার্থী।পাবনায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আছে প্রায় চার লাখ শিক্ষার্থী। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য আছেন মাত্র একজন চিকিৎসক ।জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, জেলায় তাদের তদারকিতে মোট ৬৭৯ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এদের জন্যও  নেই কোনো প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা।

পাবনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মাহফুজা সুলতানা বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য  সেবার মান বাড়ানো দরকার, এক্ষেত্রে স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক ও ওষুধপত্র থাকা প্রয়োজন।জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নিখিল চন্দ্র হালদার বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা বলতে কিছুই  নেই । এটা করা জরুরি।

সাঁথিয়া উপজেলার কাশিনাথপুর শহীদ নূরুল হোসেন ডিগ্রী কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান সুপ্তি ও একই বিভাগের সিনথিয়া আক্তার ইতি জানান, তাদের কলেজে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার কোনো ব্যবস্থাই  নেই। ইসলামীয়া কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী হাসানুর রহমান বলেন, স্বাস্থ্যগত সমস্যা হলে পাবনা সদর হাসপাতালসহ হাতের কাছে যেখানে চিকিৎসা সেবা পাই ভালো হোক বন্ধ হোক সেখানেই যেতে হয়।

পাবনা সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী তানজিন হাসান বাপ্পি বলেন, আমরা নিজ উদ্যোগেই প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিয়ে থাকি।পাবনা জেলা শিক্ষা অফিসার রোস্তম আলী হেলালী বলেন, তাদের ৬৭৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা  থেকে বি ত। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র ও কমিউনিটি হাসপাতালগুলোকে মানোন্নয়ন করে  সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্য সেবা ডেস্ক খুললে শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিধা হবে। তিনি আরও বলেন, পাবনা পৌর শহরে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে স্কুল হেলথ ক্লিনিক সেবা থাকলেও তা জানেন না অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা ।

পাবনা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাতেমা বিনতে শামীম সুপ্রীতি জানান, শহরে বিনা মূল্যে স্কুল হেলথ ক্লিনিক আছে সেটা আমার জানা  নেই। এছাড়া আমাদের স্কুলেও তেমন কোন প্রাথমিক স্বাস্থ্য  সেবার ব্যবস্থা নেই।পাবনা পলিটেকনিক ইনিষ্টিটিউটে ১৫ বছর ধওে মেডিকেল চিকিৎসকের পদ শূন্য থাকায় ৭ হাজার ৪০০ শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র একজন ফার্মাসিষ্ট প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা পরামর্শ দিয়ে আসছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মোঃ আতিকুর রহমান ।

পাবনা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ৫০০ শিক্ষার্থী থাকলেও তাদের জন্য নেই কোন প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা ।সরকারি এডওয়ার্ড কলেজে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার জন্য কোন মেডিকেল অফিসার নেই, জেলা রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বাস্থ্য কর্মীরা এখানে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে থাকে। এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ন কবীর মজুমদার বলেন,‘শিগগিরই এখানে একজন মেডিকেল অফিসার ও একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসকসহ একটি মেডিকেল টিম থাকবে যা বাস্তবায়নের পথে।শহীদ বুলবুল সরকারি কলেজে প্রায় ৮ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য একমাত্র ভরসা জেলা রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বাস্থ্য কর্মী।

সুজানগর উপজেলার দুলাই ইউনিয়নের সরকারি ডা. জহুরুল কামাল ডিগ্রী কলেজে প্রায় ৪ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য কোন প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা নেই। শুধুমাত্র পরীক্ষার সময় প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় বলে জানান কলেজটির অধ্যক্ষ আব্দুল লতিফ।পাবনা জিলা স্কুল, সরকারী মহিলা কলেজ, সরকারি বলিকা বিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও বি ত হচ্ছেন প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা থেকে।

স্কুল হেলথ ক্লিনিক থাকলেও তা জানেনা অনেক শিক্ষার্থীই। পাবনায় ১৮৬২ সাল থেকে স্কুল হেলথ ক্লিনিক শহরের  গোপালপুর পৌর এলাকায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থী বিনামূল্যে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সেবা নেয়। দুই জন মেডিকেল অফিসার সকাল সাড়ে ৮ টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এ সেবা  দেন।

পাবনা স্কুল হেলথ ক্লিনিকের মেডিকেল অফিসার ডা. মোছা. আরমিনা নাজনীন বলেন,‘এ সেবা জেলার প্রতিটি উপজেলায় করা হলে শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা থেকে বি ত হবে না, পাশাপাশি এ সেবা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে ।

 কেন্দ্রটির ফার্মাসিস্ট আহসান হাবিব জানান, তাদের জন্য ২০২১-২০২২ সালে বরাদ্দ ছিল ৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। মাত্র একজন মেডিকেল অফিসার দিয়ে পৌর এলাকার প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা দেয়া সম্ভব নয়। কারণ দুইজনের একজন অস্থায়ীভাবে আছেন। তিনি জানালেন, সেখানে মাসে ৩০০ থেকে সাড়ে ৩শ’ শিক্ষার্থী  সেবা নেয়।

পাবনা পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসিউজজামান জানান, প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে প্রচার-প্রচরণার অভাব রয়েছে। শিক্ষার্থীদের জন্য যে আলাদা সেবার ব্যবস্থা আছে তা প্রচার করা জরুরি।

পাবনা সদর উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার (পাবনা পৌর এলাকা দায়িত্বরত) সাঈদা শবনম বলেন, স্কুল স্বাস্থ্য  সেবা কার্যক্রমের কোন বিষয় আমাদেরকে অবহিত করা হয় না, ফলে এই সেবার কি কার্যক্রম তাও আমাদের কাছে পরিস্কার নয়, যদি তারা আমাদের সঙ্গে সমন্বয় করেন তাহলে আশাকরি এই প্রতিষ্ঠানে সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বাড়বে।

পাবনা সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসার সাইফুল ইসলামও বললেন, স্কুল হেলথ ক্লিনিকের বিষয়ে তাদের অবহিত করা হয় না।

স্কুল হেলথ ক্লিনিকের কাছাকাছি বসবাসকারি রবিউল ইসলাম বলেন, ‘অনেকদিন ধরে হযবরল অবস্থায় দেখছি এটাকে। বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেবা কেন্দ্রটিকে আরও আধুনিক করা দরকার, প্রায়ই এখানে চিকিৎসক থাকে না দেখে শিক্ষার্থীরা এসে ফিরে যায়।

পাবনা সেন্ট্রাল গার্লস হাই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী তৃষা জানায়, এখানে যে আমাদের জন্য আলাদা স্বাস্থ্য  সেবার ব্যবস্থা আছে তা জানতাম না। জানান পর একদিন এখানে এসে কাঙ্খিত সেবা পাইনি।

তবে পাবনার সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী মনে করেন, প্রতিষ্ঠানটি পাবনা পৌর এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ঠ কাজ করছে। যেমন টিকা কার্যক্রম, বিভিন্ন স্কুলের পরীক্ষার সময় জরুরী সেবা প্রদান করে থাকে। এই  সেবাকে আরো বেশি বেগমান করতে হলে আরো বেশি পদ সৃষ্টি করে আরও আধুনিক করা প্রয়োজন।

পাবনার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ শহীদ বুলবুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর বাহেজ উদ্দিন বলেন,“জেলার প্রতিটি হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য সেবা ইউনিট গঠন করা প্রয়োজন। এ ছাড়া চর ও বিল অধ্যুষিত এলাকায় ভ্রাম্যমান মেডিকেল ইউনিট করে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করে প্রাথমিক স্বাস্থ্য  সেবা প্রদান করা দরকার। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জ একটাই সেটা হলো সারাদেশে চিকিৎসকসহ অন্যান্য সরঞ্জামের সংকট রয়েছে । সকল সংকট মোকাবিলা করে শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।