সুন্দরবন : এক অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার

সুন্দরবন : এক অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার

সুন্দরবন : এক অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার

সুন্দরবন। এক অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। কাছ থেকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। নিচে পানি, মাঝে সবুজ এবং তার ওপর আকাশের নীলের ছড়াছড়ি। এ যেন সৃষ্টিকর্তার মায়াবী হাতে নিপুনভাবে সাজানো।  বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সমুদ্র উপকূলবর্তী খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত পৃথিবীর একক বৃহত্তম প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন এটি। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁসে অবস্থান করছে সবুজ এ বনভূমি। বন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত প্রায় ছ’ লাখ এক হাজার সাত শ’ হেক্টর আয়তন সুন্দরবনের। যা দেশের মোট বনভূমির ৩৮ দশমিক ১২ শতাংশ।

সাগর উপকূলের পশুর, শিবসা, বলেশ্বর, রায়মংগল নদী বনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। তাছাড়া অসংখ্য ছোট বড় খাল, জালের মতো ছড়িয়ে আছে বনের মধ্যে। ১৯৯৭ সালে উইনেস্কো সুন্দরবনের ৩টি বন্যপ্রাণী অভয়ারন্য নিয়ে গঠিত এক লাখ ৩৯ হাজার সাত শ’ হেক্টর বনা লকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করেছে।  

খুলনার দাকোপ উপজেলার বানীশান্তা, পশ্চিম ঢাংমারী গ্রামের ইকোট্যুরিজম উদ্যোক্তা শ্রীপতি বাছাড় তার নৌকায় করে আমাদের নিয়ে যান সুন্দরবনের ভেতরে। নদীতে জোয়ারের পানি প্রবাহের সময় আমাদের বহনকরা নৌকা পশ্চিম ঢাংমারী খাল দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশের চেষ্টা করে। প্রথমে একটি সরু খাল দিয়ে বনের ভেতরে নেওয়ার চেষ্টা করেন নৌকার মাঝিরা।

সুন্দরবনের ভেতর এই খালটি সরু এবং এখানে বনের ঘনত্ব বেশি থাকায় নৌকা নিয়ে বেশিদূর সামনে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কিছুক্ষণ পর নদীতে ভাটা শুরু হবে, ফলে জোয়ারের পানি নেমে গেলে খালের কম পানিতে নৌকা নিয়ে ফিরে যাওয়া আরও ঝুকিপূর্ণ হবে। তাই কিছুদূর যাওয়ার পর ফিরে আসতে হয়। পরে আরেকটি খাল দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে নৌকা। কিছুদূর যাওয়ার পর ঘন জঙ্গলে ঢুকে পড়ি আমরা। এসময় বনের মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির সুরেলা কণ্ঠের ডাক ভেসে আসে।নৌকা যতই নির্জন বনের ভেতরে প্রবেশ করছিল সবার গা ছম ছম করছিল। এই বুঝি বাঘ এসে পড়ে কিনা? অবশ্য মাঝিরা অভয় দিচ্ছিলেন।

নৌকায় ফেরার সময় গাছে একটি বানরের দেখা পাই আমরা। তাকে ক্যামেরাবন্দি করার চেষ্টা করি। প্রায় দেড় থেকে ২ কিলোমিটার পর্যন্ত বনের মধ্যে প্রবেশ করে নৌকাটি। সেখানে সুন্দরী গাছ, গেওয়া, বাইন, কেওড়া, পশুর এবং গোলপাতা গাছ দেখা যায়। শত বর্ষী বাইন গাছও চোখে পড়ে। এই খাল গুলোর ওপর গাছ এত নিকটে যে নৌকা থেকেই গাছে ওঠা যায় সহজে। চলার পথে গহিন বনে মৌমাছির চাক চোখে পড়ে। সুন্দরবনের মধুর চাহিদা ব্যাপক। এছাড়া খালের পানির মধ্যে প্রচুর ছোট মাছের নড়াচড়া লক্ষ্য করা যায়। ফেরার পথে একটি স্থানে বনের মধ্যে নৌকা ভেড়ানো হয়। সবাই নেমে বনের মধ্যে হাটাহাটি করি। এসময় গাছের শ্বাস মূল ছুয়ে দেখি। নরম মাটিতে হরিণ, বানর ও শুকরের পায়ের ছাপ চোখে পড়ে। দুপুরের সময় ঘন বনের মধ্যে পরিস্কার দেখা যাচ্ছিল। বনের সবুজ পাতার ফাঁকে ফাকে ঝলমলে রোদের দৃশ্য অন্য রকম শিহরন জাগায় মনে। 

শ্রীপতি বাছাড় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় দীর্ঘদিন যাবত গোল কানন ম্যানগ্রোভ ইকো কটেজ নির্মাণ করে ট্যুরিজম কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। গোল কাননসহ আশ পাশের বাশ কাঠের নির্মিত কটেজগুলোতে পরিবারসহ বা গ্রুপে সুন্দরবন ভ্রমনে রাত্রি যাপন অথবা বিশ্রাম এবং খাওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে। দেশি বিদেশী অসংখ্য পর্যটক আসেন সুন্দরবন ভ্রমনে। তারা প্যাকেজ হিসেবে থাকা খাওয়া এবং সুন্দরবন দেখতে পারেন। ‘শ্রীপতি বাছাড়া এসএসসি পাশ। তাই বিদেশী পর্যটকদের ইংরেজি ভাষা মোটামুটি বোঝেন। যদিও পর্যটকরা গাইড সাথে করে নিয়ে আসেন সুন্দরবন বেড়াতে। অনেকে মাছ ধরার হুইল সাথে নিয়ে আসেন। ভ্রমণের সাথে নদীর নানা বৈচিত্রের সু-স্বাদু মাছ ধরে রান্না করে খাওয়ার মজাই আলাদা’, বলছিলেন শ্রীপতি বাছাড়।

গোটা সুন্দরবনের ৬২ ভাগ বাংলাদেশ অংশে এবং ৩৮ ভাগ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা জুড়ে বিস্তৃত। সিডর, আইলা, আম্ফানসহ নানা সামুদ্রিক ঘুর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি থেকে এই অ লের মানুষের জীবন এবং বনের পশু-পাখি ও জীব-বৈচিত্র রক্ষায় প্রাকৃতিক প্রাচীর হিসেবে বিশেষ ভূমিকা রাখছে সুন্দরবন।