কেন বিশেষ ব্যবস্থায় টাকা ধার করতে হচ্ছে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে?

কেন বিশেষ ব্যবস্থায় টাকা ধার করতে হচ্ছে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে?

কেন বিশেষ ব্যবস্থায় টাকা ধার করতে হচ্ছে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে?

তারল্য সংকট মেটাতে বিশেষ তহবিল থেকে বছরের শেষ কর্মদিবসে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েছে দেশের পাঁচটি ইসলামী ধারার ব্যাংক।এদের মধ্যে রয়েছে আট হাজার কোটি টাকা নিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক মিলে নিয়েছে ৬৭৯০ কোটি টাকা।

সাধারণত শরীয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলো সুদের হিসাবে নয়, মুনাফা-লোকসানের হিসাবে টাকা ধার করে থাকে। কিন্তু তারল্য সংকটে থাকা এসব ব্যাংকগুলো নির্দিষ্ট অংকের সুদের হারের ভিত্তিতে এই টাকা ধার করতে বাধ্য হয়েছে।এজন্য প্রায় আট দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ গুনতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। 

তবে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে বিশেষ ব্যবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একদিনের জন্য টাকা ধার নিতে হয়েছিল।  শরীয়াভিত্তিক ব্যাংকিং রীতি অনুযায়ী মুনাফার ভিত্তিতে সেটা নেয়া হয়েছে, সুদে নয়।''

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক জানিয়েছেন, সাধারণত কোন ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়লে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সহায়তা দিয়ে থাকে। এই ব্যাংকগুলোও সেরকম সহায়তা নিয়েছে।''ডিমান্ড প্রমিজরি নোট অনুযায়ী, একদিনের মধ্যেই সুদসমেত টাকা ফেরত দেয়ার কথা। সেই হিসাবে পহেলা জানুয়ারি ব্যাংকগুলো আবার টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছে।

কেন বিশেষ ব্যবস্থায় টাকা ধার নিতে হয়েছে ইসলামী ব্যাংককে?

ইসলামী শরীয়া মেনে যে ব্যাংকগুলো পরিচালিত হয়, তাদের তারল্য সংকট তৈরি হলে ইসলামিক বিনিয়োগ বন্ড এবং সুকুক বন্ড জমা দিয়ে টাকা ধার করে থাকে।সম্প্রতি ইসলামী ব্যাংকে ঋণ বিতরণে অনিয়মের একাধিক অভিযোগ প্রকাশ হওয়ার পর ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেয়ার হিড়িক শুরু হয়।অক্টোবর মাসের শেষে ইসলামী ব্যাংকে আমানত ছিল এক লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা, যখন এখন এসে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকায়।

ফলে ইসলামী ব্যাংকে বড় ধরনের তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। কয়েক দফায় বন্ড দিয়ে টাকা ধার নিয়েছে এসব ব্যাংক।ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে ইসলামিক ব্যাংকস লিকুইডিটি ফ্যাসিলিটি নামে একটি বিশেষ তহবিলও গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যেই তহবিলের আওতায় এসব ব্যাংকে ১৪ দিন মেয়াদি তারল্য সুবিধা দেয়া হয়। সুবিধা চালুর দিন থেকেই ইসলামী ব্যাংকগুলো টাকা ধার নিয়েছে, কিন্তু তাতেও তাদের সংকটের সমাধান হয়নি।

ব্যাংকের আমানত ও দায়ের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যে নগদ অর্থ জমা রাখতে হয়, তাতেও ব্যর্থ হয়েছে ইসলামী ব্যাংক, যেজন্য প্রতিদিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকদের জরিমানা গুনতে হচ্ছে।এর মধ্যেই বন্ড ব্যবহার করে কয়েক দফা টাকা ধার নিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। কিন্তু ব্যবহারযোগ্য বন্ড শেষ হয়ে এসেছে।  কিন্তু সাধারণ ব্যবহারকারী ও কর্পোরেট ব্যবহারকারী- উভয়েই ব্যাংকটি থেকে তাদের আমানত অন্য ব্যাংকে সরিয়ে নেয়া অব্যাহত রেখেছে।

এমন প্রেক্ষাপটে গ্রাহক চাহিদা মেটাতে বিশেষ তারল্য সহায়তার জন্য আবেদন করে ইসলামী ব্যাংকগুলো।বিশেষ করে বছর শেষে ব্যালেন্স শিট সমন্বয় করতে এই অর্থ নিয়েছে ব্যাংকগুলো।বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ব্যাংকের যেসব আইনকানুন রয়েছে, তাতে প্রচলিত সুদের আওতায় ইসলামী ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দেয়া যায় না।

ফলে জরুরি চাহিদার প্রেক্ষাপটে একদিনের জন্য স্পেশাল নির্ধারিত রেটে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সেখানে শরীয়াভিত্তিক ব্যবস্থায় মুনাফা দেয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

সেখানে 'ডিমান্ড প্রমিজরি নোট' এর বিপরীতে ৮.৭৫ শতাংশ সুদে এই অর্থ নিয়েছিল ইসলামী ব্যাংক, যাতে বাংলাদেশ ব্যাংক 'লেন্ডার অব দি লাস্ট রিসোর্ট' হিসাবে টাকা ধার দিয়েছে।

২৯শে ডিসেম্বর ইসলাম ব্যাংক নিয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৩,১২৫ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ১৫০০ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক ১,৪৬৫ কোটি টাকা, এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ৭০০ কোটি টাকা।

'ডিমান্ড প্রমিজরি নোট' অনুযায়ী, একদিনের জন্য ৮.৭৫ শতাংশ সুদে বা মুনাফার নির্দিষ্ট হারে এই তহবিল নিয়েছে ব্যাংকগুলো।সাবেক ব্যাংকার মোঃ নুরুল আমিন বলছেন, ''ইসলামী ব্যাংকগুলো ফিক্সড রেটে লেনদেন করতে পারে না, কারণ মুনাফা তো ফিক্সড হতে পারে না। এক্ষেত্রে কিন্তু ফিক্সড রেট বেঁধে দেয়া হয়েছে। ফলে বুঝতে পারা যায়, এসব ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংক- উভয়েই বেশ বাধ্য হয়ে এই পথ বেছে নিয়েছে।''

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেছেন, তারল্য সংকটের কারণে ইসলামী ব্যাংকগুলোকে ধার হিসাবে দেয়া হয়েছিল, পরদিনই যা তারা ফেরত দিয়েছে। এরপরে অবশ্য ব্যাংকটি আর টাকা ধার নেয়নি।এর আগে পদ্মা ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংককেও একই ধরনের সুবিধা দেয়া হয়েছিল।

ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তারল্য সংকট মেটাতে এখন উচ্চ হারে মুনাফার কথা জানিয়েছে এবং আমানত সংগ্রহের চেষ্টা করছে ইসলামী ব্যাংক।বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে, যাতে কোন গ্রাহককে টাকা তুলতে এসে ফিরে যেতে না হয়। এ কারণে চড়া সুদে ধার নিয়ে হলেও গ্রাহক সেবা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছে ইসলামী ব্যাংক।

কবে মিটবে ইসলামী ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট?

ব্যাংকিং খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইসলামী ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আস্থার সংকট তৈরি হয়ে যাওয়া। সেই কারণেই সাধারণ গ্রাহকরা এসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে নিয়ে যাচ্ছেন।

তারল্য ঘাটতির কারণে ডিসেম্বর মাসের কয়েকদিন আমানত ও দায়ের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে পারেনি ইসলামী ব্যাংকসহ একাধিক ব্যাংক। ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংকেও তারল্য ঘাটতি রয়েছে। 

সাবেক ব্যাংকার মোঃ নুরুল আমিন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘’ঋণ অনিয়ম নিয়ে নানা ধরনের খবর প্রকাশের কারণে সাধারণ গ্রাহকদের আস্থা কমে গেছে। ফলে তারা অনেকেই টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে নিয়ে গেছেন। একসাথে অনেক গ্রাহক টাকা তোলার চেষ্টা করায় এই তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে।‘’

তিনি মনে করেন, এখানে আসলে পাবলিকের স্বার্থ রক্ষায় পাবলিকের টাকা ব্যবহার করা হচ্ছে। হয়তো এভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে চায়।কিন্তু টাকা ধার করে এই সংকট সাময়িকভাবে সামাল দেয়া যেতে পারে, কিন্তু সেটা অনেকদিন অব্যাহত থাকলে ব্যাংকের জন্য সমস্যা তৈরি করবে। ফলে কীভাবে দ্রুত আস্থার সংকট কাটানো যায়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে ব্যাংকটিকে বলে তিনি মনে করেন।

মি. আমিন বলছেন, ''আস্থার জায়গায় যে চিড় ধরেছে, সেটা কীভাবে আর কতটা মেরামত করবে, সেদিকে সবার মনোযোগী হওয়া দরকার।''ঋণ বিতরণ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর ইসলামী ব্যাংক এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’বছর শেষে অনেক গ্রাহক টাকা তোলার কারণে কিছুটা তারল্য ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এখন  সেটা কমে গেছে, পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আমরা নতুন আমানত সংগ্রহের চেষ্টাও করে যাচ্ছি। আশা করছি, আগামী এক দুই সপ্তাহের মধ্যেই তারল্যের এই সমস্যা পুরোপুরি সমাধান হয়ে যাবে।‘’

সূত্র : বিবিসি