আফ্রিকা যাওয়ার পথে কেন ঢাকায় নামলেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী?

আফ্রিকা যাওয়ার পথে কেন ঢাকায় নামলেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী?

আফ্রিকা যাওয়ার পথে কেন ঢাকায় নামলেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী?

বাংলাদেশে সোমবার মধ্য রাতের পর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের যাত্রাবিরতি করেছেন চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গ্যাং।আফ্রিকা সফরে যাওয়ার সময় বিমানের জ্বালানি নেয়ার কারণে তাকে এই যাত্রাবিরতি করতে হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।এর আগে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে বলা হয় যে, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় সোমবার রাত একটার দিকে দুই ঘণ্টার যাত্রাবিরতি করবেন।

সোমবার রাতের যাত্রাবিরতির মধ্যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ এবং ঘণ্টাখানেকের একটি বৈঠকও করেছেন।তবে এটা আনুষ্ঠানিক কোন সফর ছিল না বলেও জানানো হয়।যদিও আফ্রিকা যেতে হলে বাংলাদেশ হয়ে না গেলেও চলে। অর্থাৎ এটি আসলে আফ্রিকা যাওয়ার রুট নয়।

সাক্ষাতে যা কথা হলো

বিমানবন্দরে বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. মোমেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, চীন বাংলাদেশকে প্রায় আট কোটি ২০ লাখের মতো কোভিডের টিকা দিয়েছে। যার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।বাংলাদেশ প্রায় ৮০ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য চীনে রপ্তানি করে। আর চীন থেকে আমদানি করা হয় ১৩শ কোটি ডলারের পণ্য।

এটা এক পাক্ষিক উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. মোমেন মি. গ্যাংকে বলেন, “আপনারা বলেছিলেন যে ৯৮% যত প্রোডাক্ট আছে সেগুলোতে ডিউটি ফ্রি, কোটা ফ্রি অ্যাক্সেস (শুল্ক ও কোটামুক্ত) সুবিধা দিবেন। এটা ঘোষণা হয়েছিল কিন্তু গেজেটটা হয়নি বলে আমাদের ব্যবসায়ীরা সেই অ্যাক্সেস নিতে পারছে না।”এই সুবিধা চালুর বিষয়ে মি. গ্যাংকে অনুরোধ করা হয়েছে।বিমানবন্দরে বৈঠক শেষে ঢাকার সাংবাদিকদেরকে এই বৈঠক নিয়ে ব্রিফ করেন মি. মোমেন।

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে চীন সাহায্য করছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, পদ্মাসেতু এবং এর রেল লাইনও তারা করছে তার জন্য ধন্যবাদ।চীনের প্রতি সমর্থনের বিষয়ে মি. মোমেন বলেন, বাংলাদেশ এক চীন নীতিতে বিশ্বাস করে। এটাই বাংলাদেশের মূল নীতি। বাংলাদেশ ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্র নীতি বজায় রাখে। সুতরাং আমাদের সবাইকে নিয়ে চলতে হয় বটে।

বাংলাদেশ চীনকে সমর্থন দেবে উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমরা আপনাদেরকে টাইম টু টাইম সাপোর্ট দিবো।”দুই হাজার ষোল সালে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় সই করা অর্থ সহায়তা বিষয়ক কয়েকটি চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মি. মোমেন।

মি. মোমেন জানান চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাদেরকে চীন সফরের দাওয়াত দিয়েছেন। উত্তরে মন্ত্রী জানিয়েছেন, “আমরা তাকে বলেছি যে আপনি এই হঠাৎ করে অল্প সময়ের না, রেগুলার আসেন এবং তখন আমরা আমাদের একাধিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা করবো।”চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন এক সময়ে বাংলাদেশে যাত্রাবিরতি করলেন, যখন বাংলাদেশের নানা ইস্যু নিয়ে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের প্রকাশে বিরোধে জড়ানো নিয়ে নানা খবর আসছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে।

বাংলাদেশ কি চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে?

বাংলাদেশে থাকা চীনের দূতাবাসের মুখপাত্র সোমবার আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চীন এবং আফ্রিকার সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী চিন গ্যাং তার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরেই আফ্রিকা যাচ্ছেন। এটা টানা ৩৩তম বছর যখন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বার্ষিক বিদেশ সফরের প্রথম গন্তব্য আফ্রিকা।   

এতে বলা হয় যে, চীনের আফ্রিকা সফর তাদের ঐতিহ্যের একটি অংশ এবং এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে আফ্রিকার সাথে সম্পর্ককে কতটা গুরুত্ব দেয় বেইজিং।আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন যে, এরকম গুরুত্বপূর্ণ সফরের মধ্যে ঢাকায় যাত্রাবিরতি আসলে চীনের কাছে বাংলাদেশেরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠাকেই বোঝায়।

চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, এই যাত্রাবিরতি আলাদা করে বার্তা দেয় বিষয়টি সেরকম না হলেও একটা প্রশ্ন হতে পারে যে, অন্য পথ দিয়ে না গিয়ে তিনি কেন বাংলাদেশ হয়েই আফ্রিকা যাচ্ছেন।তার মতে, বাংলাদেশের সাথে বিভিন্ন বিষয় আছে যেগুলো তারা গুরুত্ব সহকারে দেখে এটা তারই একটা প্রকাশ।বাংলাদেশকে চীন গুরুত্ব দেয় বলেই একদিনের সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে তারা।

এই পথ দিয়ে গেলে বাংলাদেশের বড় কোন কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা হতে পারে ভেবে সেই সুযোগই তারা নিয়েছেন বলে মনে তিনি।এটাকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন সাবেক এই কুটনীতিক।বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সহযোগি চীন উল্লেখ করে মি. আহমেদ বলেন, তার সাথে সব সময়ই বাংলাদেশের নানা কাজ থাকে এবং সেগুলোকে এগিয়ে নিতে সব ধরণের সুযোগ ব্যবহার করা উচিত এবং চীন সেটাই করেছে।এই যাত্রাবিরতি নিয়ে অন্য কোন পরিস্থিতি বা অন্য কোন দেশের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে জড়িয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই বলেও মনে করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, কিছুদিন আগে সংবাদ মাধ্যমে যেমন বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডা লড়াইয়ের জায়গা, সেরকমই চীনের কাছে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বটা অনেক বেশি। যেটা বাংলাদেশে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছে না।চীনের বাংলাদেশের প্রতি যে গুরুত্ব আছে তা বারবার বিভিন্নভাবেই বোঝাচ্ছে দেশটি।“বিভিন্ন সফর এবং সম্পর্কগুলার মাধ্যমে এটা বোঝা যায়,” বলেন তিনি।

 ড. ইয়াসমিন বলেন, বাংলাদেশের যেসব জায়গায় দরকার সেগুলোতে গুরুত্ব দেয়ার চেষ্টা করছে। তার ভাষায়, চীন বাংলাদেশের ‘নিড’ বা প্রয়োজনগুলোর দিকে খেয়াল রাখছে।সেজন্য তিনি মনে করেন, এই যাত্রাবিরতির একটা কৌশলগত গুরুত্ব আছে এবং এই বার্তাটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় বরং বাকি বিশ্বকেও ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে।“বাকি বিশ্বকেও বোঝাতে চাচ্ছে যে, বাংলাদেশ ইজ ইম্পরট্যান্ট টু চায়না,” বলেন তিনি।

'মোবাইল ডিপলোমেসি'

তবে কোন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশের বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতির ঘটনা এটাই প্রথম নয়।এর আগে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে চীনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই আফ্রিকা সফরের সময় ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক ঘণ্টার যাত্রা বিরতি করেছিলেন।

এছাড়া ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাপান যাওয়ার সময় ঢাকার বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করেছিলেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। সেসময় তাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণও জানানো হয়েছিল। এর আগে ২০১০ সালেও একাধিকবার যাত্রাবিরতি করেছিলেন তিনি।ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতও ঢাকার বিমানবন্দরে একাধিকবার যাত্রাবিরতি করেছেন।এ বিষয়ে মিজ ইয়াসমিন বলেন, কুটনীতি এখন অনেক দ্রুতগতি সম্পন্ন হয়েছে। আর এ কারণেই গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে এ ধরণের সংক্ষিপ্ত সফর করে থাকেন রাষ্ট্রনেতারা।

কোন একটি গন্তব্যে যাত্রা করলে যদি পথিমধ্যে এমন কোন দেশ থাকে যাকে একটি বার্তা দেয়ার দরকার হয় তখন এ ধরণের যাত্রাবিরতি হয়।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, “উনি (চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী) কিন্তু দায়িত্ব নেবার পরেই বাংলাদেশকে এই গুরুত্বটা দিয়েছেন।”

“বোঝা যায়, চীনের সাউথ এশিয়ার ইকুয়েশনে বাংলাদেশের গুরুত্ব কতখানি, এবং এই যাত্রাবিরতি সেটার একটা নজির হিসেবেই দেখা যেতে পারে।”আনুষ্ঠানিক সফরের বাইরে একটা “মোবাইল ডিপলোমেসি” বা দ্রুতগতির কুটনীতি যে সারা বিশ্বে শুরু হয়েছে সেটাতে চীন পারদর্শী উল্লেখ করে মিজ ইয়াসমিন বলেন, কুটনীতির নিয়মতান্ত্রিক ধারণাকে সামনে রেখে এটাকে যে আরো বেশি দ্রুতগতির করা যায় সেটারই একটা প্রয়াস এটি।

সূত্র   : বিবিসি