জনপ্রতিনিধিদের ছত্রছায়ায় বালু উত্তোলনের মহোৎসব, হুমকির মুখে নদী রক্ষা বাধ

জনপ্রতিনিধিদের ছত্রছায়ায় বালু উত্তোলনের মহোৎসব, হুমকির মুখে নদী রক্ষা বাধ

জনপ্রতিনিধিদের ছত্রছায়ায় বালু উত্তোলনের মহোৎসব, হুমকির মুখে নদী রক্ষা বাধ

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ছত্রছায়ায় বালু উত্তোলনের মহোৎসবের কারনে হুমকির মুখে নদী রক্ষা বাধ। পাবনার সুজানগরে পদ্মা নদীর অন্তত দশটি পয়েন্টে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের এ মহোৎসব চলছে। এতে হুমকির মুখে রয়েছে নদী রক্ষা বাধ। সামনের বর্ষা মৌসুমে পদ্মা নদীর পাড় রক্ষায় জনকল্যাণে নেয়া সরকারের জিও ব্যাগ প্রকল্পও  ভেস্তে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সচেতন মহল।

অভিযোগ উঠেছে, সুজানগর উপজেলা চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের সদস্য ও সাবেক পৌর মেয়রের ছত্রছায়ায় দিনের পর দিন পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলন চলছে। তারা মোটা অংকের কমিশন নিয়ে এই বালুর ব্যবসা করার সুযোগ করে দিচ্ছেন। কিন্তু এতে অনেকটাই নির্বিকার প্রশাসন। নামমাত্র অভিযান চালিয়ে কিছু শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের জেল জরিমানা করা হলেও, মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া, গুপিনপুর, ভাটপাড়ায়, নাজিরগঞ্জ, বরখাপুর এলাকায় দিনে এবং রাতে একদিকে এসকেভেটর মেশিনে বালু কাটা ও উত্তোলন করে নদীর পাড়ে খামাল করে রাখা হচ্ছে। যেন নদীর পাড়ে বালুর পাহাড়। অন্যদিকে অর্ধশতাধিক নানারকম যানবাহনে বিপনন করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। বরাবরই বালু মহোৎসবের এই ঘটনাটি রহস্যজনক কারণে স্থানীয় প্রশাসন দেখেও যেন দেখছে না বলে দাবি স্থানীয়দের।

স্থানীয় কয়েকজন জমির মালিক কৃষকের সাথে আলাপকালে তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জেগে উঠা চর বা জমি ব্যক্তি মালিকানা হলেও, প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট নদীগর্ভে চলে যাওয়া এ সকল জমির মালিকদের কোন ক্ষতিপূরণ না দিয়ে উল্টো হুমকি ধামকি দিয়ে জোরপূর্বক বালু উত্তোলন করছেন। জমির মালিকরা এ নিয়ে একাধিকবার প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেও কোন সুফল পাননি।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি আসার সাথে সাথে তীরবর্তী এলাকাগুলোতে দেখা দেয় তীব্র ভাঙ্গন। এতে প্রতি বছর বিলীন হয় ফসলি জমি, বসতভিটা, ঘরবাড়ি, মসজিদ-মন্দির, সড়ক, স্কুলসহ নানা স্থাপনা। সেসময় ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড সরকারের কোটি কোটি টাকার জিও ব্যাগ ফেললেও ভাঙন রোধ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলে বালু উত্তোলনের কারণে হুমকির মুখে থেকে যায় নদী রক্ষা বাঁধ।

স্থানীয়ভাবে একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র ও বালু কাটার সাথে শ্রমিক-ব্যবসায়ীরা জানায়, সুজানগর উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীনুজ্জামান শাহীন উপজেলার অধিকাংশ বালু কাটা, উত্তোলন ও বিক্রির সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। কিন্তু তিনি ও তার লোকজনের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। এমনকি প্রশাসনকে এ নিয়ে নানাভাবে জানিয়েও অজ্ঞাত কারণে কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না।

এমন অভিযোগ রয়েছে উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র আব্দুল ওহাবের বিরুদ্ধে। তিনিও এই বালু কাটা ও বালু বিক্রির সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। একইসাথে জেলা পরিষদ সদস্য আহমেদ ফররুখ কবিরের বিরুদ্ধে। তিনিও প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম ভাঙ্গিয়ে ও ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে এই বালু সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত বলে তথ্য মিলেছে।

এ বিষয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীনুজ্জামান শাহীন বালু উত্তোলনের সাথে তার সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে বলেন, প্রতিপক্ষের লোকজন ঈর্র্ষান্বিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা রটাচ্ছে।

উপজেলার অধিকাংশ বালু কাটা ও উত্তোলন পয়েন্ট থেকে তিনি সিংহভাগ কমিশনে ব্যবসা করেন এমন অভিযোগে তিনি বলেন, রাজনীতি করি। অনেক কর্মি নিয়ে চলতে হয়। তাদের অর্থনৈতিক কোন সহায়তা করতে পারি না। কিন্তু তারা আমার কর্মি হয়ে যদি কোথাও একটু সুবিধা আমার নাম ভাঙিয়ে নেয় তাহলে সেখানে কিছু করার থাকে না। কিছু বিষয় ছাড় দিয়েই আমাদের রাজনীতি করতে হয় ও কর্মি ধরে রাখতে হয়।

একই বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আব্দুল ওহাব নিজে বালু ব্যবসার সাথে জড়িত নন দাবি করে বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই শুনে আসছি এই উপজেলার বেশ কিছু পয়েন্টে বালু কাটা, উত্তোলন ও বিপণন করা হয়। আমার নাম জড়িয়ে একটা শ্রেণি খুব মজা নেয়ার চেষ্টা করে। আমি সব সময় পরিষ্কার রাজনীতি করি। কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি আমার কাজ নয়। বালু কেটে জমির মালিকদের সর্বশান্ত করা, নদীতে ভাঙ্গন সৃষ্টি করা আর সরকারের জনগুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো বিনষ্ট করার পক্ষে আমি নই। তিনি গণমাধ্যমকে বিষয়টি তুলে ধরে সরকার প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণে নেয়ার দাবী জানান।

প্রভাবশালী নেতার পরিচয়ে প্রভাব বিস্তার ও বালু মহালে আধিপত্য বিস্তারের বিষয়ে জেলা পরিষদের সদস্য আহমেদ ফররুখ কবির নিজের দায় এড়িয়ে একটি পক্ষকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তারা যখন আমাদের কাছে বলে বালুর ব্যবসা করার জন্য, তখন আমরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে না করতে পারি না। আমাদের কাছে বলে তারা গিয়ে বালু কাটা ও ব্যবসা করে খায়। আমি এর সাথে কোনোভাবেই জড়িত না।

সুজানগর সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম বলেন, বালু উত্তোলন কর্মকান্ডের সাথে পুলিশ জড়িত এমন কথাটি মোটেও সঠিক নয়। পুলিশ প্রশাসন বেশ তৎপর। সমস্যা হলো পুলিশ ওই সব পয়েন্টে অভিযোগে গেলেই বালু কাটার সাথে সম্পৃক্তরা ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়ে। তিনি বলেন, পুলিশ যাওয়ার আগেই পয়েন্টের বিভিন্ন স্থানে বালু দস্যুদের সোর্সরা আগেই খবর পাচার করে দেয়। যে কারণে আমরা মূল হোতা বা সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনতে পারি না। তবে বালু বিরোধী অভিযোগ আমাদের অব্যাহত রয়েছে।

সুজানগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তরিকুল ইসলাম বলেন, বালু দস্যুদের দমনে প্রশাসনের পদক্ষেপের কোন কমতি নেই। প্রশাসনের নজরদারি নেই এ কথাটি সঠিক নয়।  অভিযান চলছে এবং চলবে। মাঝেমধ্যেই অভিযান চালিয়ে জেল জরিমানাসহ আইনের মুখোমুখি করা হচ্ছে।