অঙ্গসমূহ হবে কৃতকর্মের সাক্ষী

অঙ্গসমূহ হবে কৃতকর্মের সাক্ষী

অঙ্গসমূহ হবে কৃতকর্মের সাক্ষী

মানব দেহ বিভিন্ন অঙ্গ দিয়ে গঠিত। যেমন- হাত, পা, চক্ষু, কর্ণ-নাসিকা, কলব, জিহ্বা ইত্যাদি। এ সব অঙ্গ যেমন রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত রাখা আবশ্যক, তেমনি সর্বপ্রকার পাপাচার থেকেও মুক্ত রাখা অপরিহার্য। কারণ রোগ-ব্যাধির কারণে যেমন অঙ্গসমূহ পার্থিব জগতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সমস্ত দেহকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তেমনি পরকালে অঙ্গসমূহ দেহের সব অপকর্মের কথা প্রকাশ করে দেহকে জাহান্নামের উপযোগী করবে।

অঙ্গ বিচারের মুখোমুখি হবে : আল্লাহ তায়ালা বিচার দিবসে দেহের প্রত্যেকটি অঙ্গকে তার কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। যেমন তিনি ইরশাদ করেন- ‘যে ব্যাপারে তোমার জ্ঞান নেই, তার পেছনে পড়ো না। নিশ্চয়, কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সূরা বনি ইসরাইল-৩৬) বিচার দিবসে কানকে প্রশ্ন করা হবে, তুমি সারা জীবন কি কি শুনেছ? চক্ষুকে প্রশ্ন করা হবে- তুমি সারা জীবন কী কী দেখেছ? অন্তঃকরণকে প্রশ্ন করা হবে- তুমি সারা জীবনে মনে মনে কী কী কল্পনা করেছ এবং কী কী বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেছ? যদি কান দিয়ে দ্বীনবিরোধী কথাবার্তা ও হারাম গানবাদ্য শুনে কিংবা চক্ষু দিয়ে বেগানা নারীর প্রতি দৃষ্টি দেয় অথবা অন্তরে কুরআন-সুন্নাহপরিপন্থী বিশ্বাস লালন করে থাকে; তবে অবশ্যই তাকে শাস্তি পেতে হবে।

অঙ্গ হবে কৃতকর্মের সাক্ষী : বিচার দিবসে হিসাব-নিকাশের জন্য উপস্থিতির সময় প্রথমে সব ব্যক্তি যা ইচ্ছা বলার স্বাধীনতাপ্রাপ্ত হবে। পাপিরা যখন তাদের অপকর্মের কথা অস্বীকার করবে, আল্লাহ তায়ালা তখন তাদের মুখে মোহর এঁটে দেবেন, যাতে তারা মুখে কোনো কথা বলতে না পারে। অতঃপর তাদের হাত, পা ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে রাজসাক্ষী করে কথা বলার যোগ্যতা দেয়া হবে। তারা পাপিদের সব অপকর্মের সাক্ষ্য দেবে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আজ আমি তাদের মুখে মোহর এঁটে দেবো; তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে।’ (সূরা ইয়াসিন-৬৫)

পরিচ্ছন্ন অঙ্গের অধিকারী আল্লাহর বন্ধু :বিচার দিবসে যার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিচ্ছন্ন ও পাপমুক্ত হবে না, সে একজন অপিশপ্ত ব্যক্তি বলে গণ্য হবে এবং আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি অসন্তুষ্ট হবেন। এ প্রসঙ্গে হজরত হুজাইফা রা: থেকে বর্ণিত আছে- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা আমার কাছে প্রত্যাদেশ করেছেন, হে ভয় প্রদর্শনকারীদের ভাই, হে রাসূলদের ভাই! আপনি আপনার জাতিকে ভয় প্রদর্শন করুন, যেন তারা সুস্থ অন্তঃকরণ, সত্যবাদী জবান, পরিচ্ছন্ন হস্ত ও পবিত্র যৌনাঙ্গ ছাড়া আমার কোনো মসজিদে প্রবেশ না করে এবং নিজেদের কাছে জুলুমের বদ গুণ নিয়ে আমার কোনো মসজিদে প্রবেশ না করে। হ্যাঁ যদি প্রবেশ করে, তবে আমার সামনে যতক্ষণ থাকে আমি ততক্ষণ অভিশম্পাত করতে থাকি, যতক্ষণ না পাপাচার ও জুলুম পরিত্যাগ করে। যদি জুলুম ও পাপাচার পরিত্যাগ করে, তবে আমি হয়ে যাই তার কান ও চোখ এবং সে হয়ে যায় আমার বন্ধু। সে জান্নাতে আমার প্রতিবেশী হয়ে নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও নেককারদের সাথে বসবাস করবে।’ (কুরতুবি প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৮৮)

পরিচ্ছন্ন অঙ্গের অধিকারী জান্নাতি : যার অঙ্গসমূহ পরিচ্ছন্ন ও পাপমুক্ত সেই জান্নাতি। মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুই চোয়ালের মধ্যস্থল তথা মুখ ও দু’পায়ের মধ্যস্থল তথা যৌনাঙ্গের দায়িত্ব নেবে আমি তার জান্নাতের দায়িত্ব নেবো।’ (সহিহ বুখারি, মিশকাত, পৃষ্ঠা-৪১১) আল্লাহ তায়ালা আরো ইরশাদ করেন- ‘মানুষের মধ্যে এমন লোক আছে যার পার্থিব জীবনের কথাবার্তা তোমাকে চমৎকৃত করে, আর সে নিজে মনের সদিচ্ছার ব্যাপারে আল্লাহকে সাক্ষী রাখে। প্রকৃতপক্ষে সে হলো অতি ঝগড়াটে।’ (সূরা বাকারা-২০৪) মহানবী সা: বলেছেন, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যাদের মুখের ভাষা মধুর চেয়েও মিষ্টি, তাদের অন্তর তিক্ত ফলের চেয়েও তিক্ত, তারা মেষের চামড়ার ন্যায় নরম পোশাক পরিধান করে। এ লোকগুলো দ্বীনের বিনিময়ে দুনিয়া ক্রয় করে।’ (তিরমিজি-২৪০৫)

পরিচ্ছন্নমুখ ও হাতের অধিকারী প্রকৃত মুমিন : মহানবী সা: প্রকৃত ও খাঁটি মুমিনের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, প্রকৃত মুসলমান ওই ব্যক্তি যার জবান ও হাত থেকে অপর মুসলমান নিরাপদে থাকে, অর্থাৎ যে জবান দিয়ে কাউকে কটু কথা বলে না এবং হাত দিয়ে কাউকে কষ্ট দেয় না সেই প্রকৃত মুমিন।

জবান গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ : জবান হলো মনের ভাব প্রকাশের কেন্দ্রবিন্দু। জবান ভালো থাকলে সব দেহ ভালো থাকে আর জবান ক্ষতিগ্রস্ত হলে সব দেহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মহানবী সা: বলেছেন, ‘প্রত্যহ সকালে অঙ্গসমূহ জবানকে বলে, হে জবান তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। কেননা, তুমি সোজা (ভালো) হয়ে গেলে আমরাও সোজা (ভালো) হয়ে যাব, আর তুমি বাঁকা (মন্দ) হয়ে গেলে, আমরাও বাঁকা (মন্দ) হয়ে যাবো।’ (তিরমিজি-২৪০৮, মুসনাদ আহমদ-৩/৯৫)

জবান বা মুখ দিয়ে কখনো সত্য কথা, কখনো মিথ্যা কথা, কখনো গালিগালাজ করা, আবার কখনো ন্যায় কথাও বলা হয়। সত্য কথা বললে সে সিদ্দিক হিসেবে পরিগণিত হয়। আর মিথ্যা কথা বললে সে মিথ্যুক হিসেবে পরিগণিত হয়। সততা অবলম্বন করা তোমাদের কর্তব্য। কেননা, সততা কল্যাণের পথ দেখায়, আর কল্যাণ জান্নাতের পথ দেখায়, ব্যক্তি সদা সততা অবলম্বন করলে, সত্য কথা বললে এবং সততা নিজের মধ্যে লালন করলে তাকে আল্লাহর দরবারে সিদ্দিক হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর যে ব্যক্তি সদা মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যা নিজের মধ্যে লালন করে আল্লাহ তায়ালার দরবারে তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়।

রাসূলুল্লাহ সা: আরো ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা পরিত্যাগ করবে, আর মিথ্যা প্রকৃত পক্ষেই বাতিল ও গর্হিত কাজ- তার জন্য বেহেশতের এক প্রান্তে একটি প্রাসাদ তৈরি করা হবে। যে ব্যক্তি ন্যায়সঙ্গত ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করবে তার জন্য বেহেশতের মাঝখানে একটি প্রাসাদ তৈরি করা হবে। আর যে ব্যক্তি নিজের চরিত্রকে সুন্দর করবে, তার জন্য বেহেশতের উঁচু স্থানে একটি প্রাসাদ তৈরি করা হবে।’ (তিরমিজি, মেশকাত-৪৮৩১) হজরত সুফিয়ান ইবনে আব্দুল্লাহ আস সাকাফি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে আরজ করলাম- হে আল্লাহর রাসূল! যেসব জিনিসকে আমার জন্য আপনি ভয়ের কারণ বলে মনে করেন, তন্মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জিনিস কোনটি? তিনি তখন স্বীয় জিহ্বা ধরলেন এবং বললেন, এটি।’

অঙ্গ কৃতকর্মের কথা প্রকাশ করবে : বিচার দিবসে জিহ্বা, হাত ও পা তাদের ভালো-মন্দের কথা বলে দেবে। আল্লাহর বাণী- ‘সেদিন তাদের জিহ্বা, হাত ও পা প্রকাশ করে দেবে যা কিছু তারা করত।’ (সূরা নূর-২৪) হজরত বুসরা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: আমাদের বলেছেন, ‘তোমাদের কর্তব্য তাসবিহ, তাহলিল পড়া এবং আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করা ও আঙুল দিয়ে গণনা করা। কেননা, এগুলো জিজ্ঞাসিত হবে এবং আল্লাহর সামনে কথা বলবে। আর তোমরা আল্লাহর জিকির থেকে গাফিল হবে না। তাহলে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি-২৩২৬)

ত্বক ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে : ব্যক্তির বিরুদ্ধে শুধু অঙ্গই সাক্ষ্য দেবে না; বরং ত্বকও তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে; অথচ মানুষ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ গাফেল। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘তারা তাদের ত্বককে বলবে, তোমরা আমাদের বিপক্ষে কেন সাক্ষ্য দিলে? ত্বক বলবে, যে আল্লাহ সব কিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন, তিনি আমাদেরও বাকশক্তি দিয়েছেন। তিনিই তোমাদের প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সূরা হা-মিম আস্ সাজদা-২১)

লেখক : প্রধান ফকিহ্, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।