ঢাকার বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি হয় মধ্যরাতের পর

ঢাকার বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি হয় মধ্যরাতের পর

ফাইল ছবি

প্রচলিত আছে, ঢাকার মানুষ রাতে ঘুমালেও শহরটি ঘুমায় না। বর্তমান সময়ে এ শহরের বাতাসের গুণমানের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। দেখা যায়, দিনের বেলার থেকে মধ্যরাতে বা ভোর রাতে ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা থাকে অনেক বেশি।

ঢাকার মানুষ যেন নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে পারছে না। দীর্ঘদিন ধরে বায়ুদূষণে ভুগছে শরহটি। বর্ষাকালে কিছুটা উন্নতি হলেও, সাধারণত শীতকালেই বেশি অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়ে ঢাকার বাতাসের গুণমান। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২৪ দিনই ঢাকার বাতাস ছিল বিপজ্জনক, যা ফেব্রুয়ারিতেও চলমান।

বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) বিশ্বের দূষিত বাতাসের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছয় নম্বরে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান একিউআই অনুযায়ী সকাল ৬ টায় দেয়া সবশেষ আপডেটে দেখা যায়, ঢাকার স্কোর ১৭০, যা অস্বাস্থ্যকর হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।

পরিবেশ অধিদফতরের বায়ুমান সূচক অনুসারে, স্কোর শূন্য থেকে ৫০ পর্যন্ত ‘ভালো’। ৫১ থেকে ১০০ ‘মোটামুটি’, ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত ‘সতর্কতামূলক’, ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’, ৩০১ থেকে ওপরে ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’ বা ‘দুর্যোগপূর্ণ’।

বুধবার প্রথম প্রহরে (রাত ১২টা) একিউআই বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওই সময় ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা ছিল ১৯৯। অর্থাৎ, মধ্যরাতেও ঢাকার বাতাস ছিল অস্বাস্থ্যকর। আর রাত তিনটার সময় সাভারের হেমায়েতপুরে একিউআই স্কোর ছিল ২০৬ (খুব অস্বাস্থ্যকর), যদিও ওই সময় ঢাকার গড় স্কোর কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১৬৮। ভোর ৬টার সময় ঢাকায় বায়ুমান সূচক ছিল ১৭০।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা অনুসারে, এক বছরে বাতাসে দূষিত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫) প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত অনুমোদিত। পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম-২.৫) হলো বাতাসে থাকা সব ধরনের কঠিন এবং তরল কণার সমষ্টি, যার বেশিরভাগই বিপজ্জনক। মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক বিভিন্ন ধরনের রোগ যেমন— প্রাণঘাতী ক্যান্সার এবং হৃদযন্ত্রের সমস্যা তৈরি করে পিএম-২.৫।

এদিন রাত ১২টায় ঢাকার বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে পিএম-২.৫-এর গড় উপস্থিতি ছিল ১৪৯.১ (অস্বাস্থ্যকর), রাত ৩টায় সেটি আবার কমে যায় (৮৪.৬)। যদিও ঠিক একই সময় সাভারের হেমায়েতপুরে বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে পিএম-২.৫-এর গড় উপস্থিতি ছিল ১৫৬ (অস্বাস্থ্যকর)। আগের রাত ২টায় পিএম-২.৫-এর গড় ছিল ২৫৪.১ (বিপজ্জনক) এবং ৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টায় পিএম-২.৫-এর গড় উপস্থিতি ছিল ২১৩ (অস্বাস্থ্যকর)।

এদিকে, ৭ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২ টা থেকে বিকেল ৫টা মধ্যে একিউআই বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই সময় ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা ছিল ১৬৯ থেকে ১৭১-এর মধ্যে। আবার ওইদিন সকাল ৭টার সময় বায়ুমানের সূচক ছিল ২২৫, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। আবার রাত ২টায় দূষণের মাত্রা সবকিছু ছাপিয়ে ৩০৫-এ গিয়ে দাঁড়ায়। সূচক অনুসারে ৩০১ থেকে ওপরে ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’ বা ‘দুর্যোগপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচিত।

একইভাবে ৬ ফেব্রুয়ারির তথ্য বিশ্লেষণ করলেও প্রায় একই তথ্য পাওয়া যায়। দিনের তুলনায় শেষ রাতে ঢাকায় বায়ু দূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। ভোর ৪টায় বায়ুমান সূচক ছিল ২০৬, সকাল ৭টায় সেই সূচক গিয়ে দাঁড়ায় ২৬২। সকাল ৯টা থেকে আবার সেটি কমতে থাকে, সন্ধ্যা ৬টায় সেই সূচক ১৫৮তে নেমে আসে।

এর আগে, ৪ ফেব্রুয়ারি রাত রাত ২টার সময় একিউআই তথ্যে ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা ছিল ১৭৭, ভোর ৪টার সময় দূষণের মাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৪ এবং সকাল ৭টায় সূচক ছিল ১৮৯।

তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, দৈনিক গড় বায়ুমান সূচকে ঢাকার বাসাতে দূষণ সবচেয়ে কম থাকে দুপুর ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত, যেখানে সূচক ১৫০-এর ওপরে, যা ‘অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচিত। অর্থাৎ সর্বনিম্ন দূষণের সময়টাতেও বিশুদ্ধ বায়ু গ্রহণের সুযোগ নেই ঢাকাবাসীর। এরপর ধীরে ধীরে আবার বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে মধ্যরাতের পর দূষণের মাত্রা সবকিছু ছাড়িয়ে যায়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের বায়ুদূষণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি সময় সংবাদকে বলেন, বিকেল ৪টা থেকে অফিস ছুটি হয়। এ সময় মানুষের চলাচলের বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে গাড়িও বেড়ে যায়। ফলে গাড়ির ধোয়ায় দূষণ বাড়তে থাকে।

এ ছাড়া রাত থেকে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সড়কে ঝাড়ু দেয়া শুরু করে যা সকাল পর্যন্ত চলে। এ সময় পুরো শহরে ধুলা উড়তে থাকে। রাত ৮টার পর নির্মাণসামগ্রী উন্মুক্ত অবস্থায় নিয়ে ট্রাক চলাচল করে, পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যবাহী ভারী যান চলাচল করে। আর রাতের ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতিতে গাড়িগুলো চলায় সড়ক বিভাজকের পাশে জমে থাকা ধুলা চাকার সঙ্গে উড়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ইটভাটাও দিনের তুলনায় রাতে বেশি চলে। ফলে রাতের শহরে দূষণের মাত্রা বেশি হয়।

রাতে ঢাকাসহ চারপাশের এলাকায় পলিথিনসহ প্লাস্টিক পোড়ানো হয় জানিয়ে এই পরিবেশ বিজ্ঞানী বলেন, ‘আমিনবাজার ও হেমায়েতপুরের মাঝখানে যে ময়লার ভাগাড় আছে তার আশপাশে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত যাওয়া যায় না। শুকনো মৌসুমে যখন ভাগাড়ে ময়লা ও প্লাস্টিক পোড়ানো হয়, তখন দম বন্ধ হয়ে আসে। এই দূষণ ঢাকা ও আশপাশের এলাকার মানুষের দেহে প্রভাব ফেলছে।’

তার কথার সত্যতা পাওয়া যায় উপাত্ত বিশ্লেষণ করলেই। ৮ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টার সময় সাভারের হেমায়েতপুরে একিউআই স্কোর ছিল ২৮৫। এরপর কিছুটা কমে রাত ২টায় ১৯৮ এ নামলেও রাত ৩টার দিকে আবার বাড়তে থাকে ২০৬ (খুব অস্বাস্থ্যকর), যদিও ওই সময় ঢাকার গড় স্কোর ছিল ১৬৮। একইভাবে ৭ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় হেমায়েতপুরের একিউআই স্কোর ছিল ২৩৩; যা ওই দিনের সর্বোচ্চ।

এছাড়া রাজধানীর মাতুয়াইল ময়লার ভাগার থেকে বিপুল পরিমাণ মিথেন নির্গমন নিয়ে ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। হিসাব অনুযায়ী, মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল থেকে প্রতি ঘণ্টায় চার টন মিথেন নির্গত হয়।

এর আগে ২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে বায়ুদূষণ নিয়ে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সেখানে বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করতে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। এছাড়াও বায়ুমানের তারতম্য নির্ধারণে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

সভায় বলা হয়, অবৈধ ইটভাটা, গাড়ির কালো ধোঁয়াসহ নির্মাণ কার্যক্রম থেকে সৃষ্ট বায়ুদূষণ, বিশেষ করে বড় বড় নির্মাণ কার্যক্রমের দূষণের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান জোরদার করা হবে। এছাড়াও রাস্তায় পানি ছিটানোসহ ধুলোবালি পরিষ্কারের জন্য পদক্ষেপ এবং পৌরবর্জ্য পোড়ানোর বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশন নিয়মিত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

কিন্তু সরকারের এমন পদক্ষেপ নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। তার মতে, এমন উদ্যোগ এর আগেও বহু নেয়া হয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয় না। সকালে আর বিকেলে একবার করে পানি ছিটিয়েই ক্ষান্ত দেয়া হয়। তাও সব সড়কে ছিটানো হয় না।

তিনি বলেন, ‘শুষ্ক মওসুমে শুধু বাংলাদেশ না, বিশ্বের বড় বড় শহরে দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। কিন্তু তারা সড়কে পানি ছিটেয়ে, ধুলা যতোটা সম্ভব না উড়িয়ে পরিষ্কারের চেষ্টা করে। কিন্তু ঢাকায় সেই পুরনো পদ্ধতিতেই রাস্তা পরিষ্কার করা হয়, ট্রাকগুলোকে অবাধে চলাচল করতে দেয়া হয়, অবৈধ ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ করা হয় না।’ এসবের পাশাপাশি তিনি গাছ ও বন ধ্বংসকেও অনেকাংশে দায়ী করেন।

গত বছরের শেষ দিকে বিশ্ব ব্যাংক এক প্রতিবেদনে বলছে, বাতাসে অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণ (পিএম ২.৫) এক শতাংশ বাড়লে তা মানুষের বিষণ্নতার সম্ভাব্য ঝুঁকি ২০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়।  প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার যেসব এলাকায় অনেক বেশি নির্মাণ কাজ ও যানবাহন চলাচল করে, সেখানে বাতাসে অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণ (পিএম ২.৫) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে ১৫০ শতাংশ বেশি। আর ঢাকার আশপাশে ইটভাটা সংলগ্ন এলাকায় তা গড়ে ১৩৬ শতাংশ বেশি।

দেশে বায়ু দূষণের প্রভাবে ২০১৯ সালে অন্তত ৭৮ হাজার ১৪৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং জিডিপির ৩ দশমিক ৯ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে বলেও জানায় বিশ্ব ব্যাংক।

প্রতিবেদনে বায়ু দূষণের প্রভাব কমানোর জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেয়া, জনস্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নয়ন, বায়ু দূষণ ডেটা পর্যবেক্ষণ, পূর্ব সতর্কতা এবং আরও গবেষণার সুপারিশ করা হয়েছে।

সূত্র: সময় টিভি