মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতায় হাতছাড়া হচ্ছে সুযোগ

মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতায় হাতছাড়া হচ্ছে সুযোগ

কাওসার রহমান

অদৃশ্য কারণে সময়মতো জ্বালানি তেল পরিশোধনের দ্বিতীয় ইউনিট করতে না পারায় দায়ভার বহন করতে হচ্ছে পুরো জাতিকে। উচ্চ মূল্যে জ্বালানি তেল কিনতে গিয়ে উচ্চ মুল্যস্ফীতির যাতাকলে পিষ্ঠ হচ্ছে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণ পেতে এক লাফে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে গিয়ে ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ শতাংশ পর্যন্ত জ্বালানি তেলের মুল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। আর এই মুল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এক উচ্চ মুল্যের যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। যা নিদারুন কষ্টের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষকে। অথচ দুরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে পরিশোধন সক্ষমতা বাড়িয়ে এখন বিশ্বের জ্বালানি মানচিত্রে প্রতিবেশি দেশ ভারত এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কঠোর বিধি-নিষেদের মধ্যেও দেশটি রাশিয়া থেকে স্বল্পমূল্যে অপরিশোধিত তেল কিনে পরিশোধনের পর তা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল মুনাফা অর্জন করছে। বাংলাদেশকেও এখন মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষায় করতে হচ্ছে পাইপলাইনের মাধ্যমে ওই পরিশোধিত তেল পাওয়ার জন্য।

অথচ ২০১০ সালে নেয়া এই দ্বিতীয় ইউনিটের প্রকল্পটি তিন বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে পারলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এই অস্থিরতার মধ্যে খুব বেশি পড়তে হতোনা বাংলাদেশকে। অহেতুক বিলম্ব করে প্রকল্পটিকে দীর্ঘায়িত করে এর অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধি করা না হলে ফ্রান্সের কোম্পানিটিও পাততাড়ি গুটিয়ে বাংলাদেশ থেকে চলে যেতো না। 

মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের খবর অনুসারে, ৫ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ওপর ইউরোপের নতুন জ্বালানি নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের পর এখন বৈশ্বিক তেল মানচিত্রের আরও কেন্দ্রে চলে আসবে ভারত। দেশটি রাশিয়া থেকে কম দামে আরও বেশি তেল কিনে পরিশোধনের পর তা রপ্তানি করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে। মস্কোর অর্থ উপার্জনের ক্ষতি করা এবং একই সঙ্গে নিজেদের জ্বালানি সরবরাহ অবিঘ্নিত রাখার জন্য ভারতে শোধিত এই তেল কিনতে আপত্তি করছে না পশ্চিমারা।

ডেটা ইন্টেলিজেন্স ফার্ম কেপলারের তথ্যমতে, গত মাসে নিউইয়র্কে প্রতিদিন প্রায় ৮৯ হাজার ব্যারেল পেট্রল ও ডিজেল পাঠিয়েছে ভারত, যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর জানুয়ারিতে ইউরোপে দৈনিক কম সালফারযুক্ত ডিজেল পাঠানোর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭২ হাজার ব্যারেল, যা ২০২১ সালের অক্টোবরের পর থেকে সর্বোচ্চ।

৫ ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়ার পেট্রালিয়াম রপ্তানির ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। ফলে তেলবাজারে দক্ষিণ এশীয় দেশটির গুরুত্ব আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্ববাজার বিপুল পরিমাণ ডিজেল হারাবে এবং ক্রেতা আরও বেড়ে যাবে, বিশেষ করে ইউরোপে। তেল সরবরাহ ব্যবস্থায় রাশিয়ার এই শূন্যতা এশীয় দেশগুলোর জন্য বড় সুযোগ হয়ে উঠতে পারে।

এর কারণে কম দামি রুশ তেলও ভারতের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। দেশটি তার অপরিশোধিত তেলের চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশই আমদানির মাধ্যমে পূরণ করে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া দামের সুযোগ নিয়ে অধিক লাভের আশায় ভারতীয় পরিশোধনকারীরা এরই মধ্যে তেল রপ্তানি বাড়িয়েছে।

কিন্তু এই সুযোগটি বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে গেছে শুধুমাত্র জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের আগ্রহের অভাবে। শুধু বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির এই উচ্চমুল্যের সময়েই নয়, কোভিড চলাকালে বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম শূন্য ডলারের নীচে নেমে গিয়েছিল। বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবে জ্বালানি  তেলের চাহিদা কমে যাওয়ায় ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল ইতিহাসে প্রথমবারের মত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম শূন্যেরও নিচে  নেমে যায়। ওই সময় বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, ২০ এপ্রিল (২০২০) ফিউচার মার্কেটে যুক্তরাষ্ট্রের অপরিশোধিত তেলের শীর্ষ ব্র্যান্ড ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের প্রতি ব্যারেলের দাম ছিল মাইনাস ৩৭ দশমিক ৬৩ ডলার। এর মানে হল, তখন তেল নিলে  ক্রেতাকে উল্টো টাকা দিতেও রাজি উৎপাদকরা, কারণ চাহিদা না থাকায় এবং উৎপাদন অব্যাহত থাকায় মে মাসেই তেল মজুদের আর জায়গা থাকবে না বলে তারা আশঙ্কা করছেন। কিন্তু সেই সময়কার সস্তা তেলের সুযোগও বাংলাদেশ নিতে পারেনি। কিন্তু প্রতিবেশি ভারতসহ অনেক দেশই এই সুবিধা নিয়েছে শুধুমাত্র নিজেদের উৎপাদন সক্ষমতা পর্যাপ্ত থাকার কারণে।

কিন্তু বাংলাদেশে হিসাবে হলো উল্টো। দেশে পরিশোধনের চেয়ে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পরিশোধিত তেল কিনে এনে ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে বাংলাদেশ। কারণ পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম সব সময় আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি থাকে। আর বেশি দামের পণ্য কিনলে বেশি ‘সুবিধা’ পাওয়া যায়। তাহলে কেন দেশকে জ্বালানি তেল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে? অথচ বাংলাদেশে লক্ষ কোটি টাকারও মেগা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, কিন্তু দেশে ১২ বছরেই ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপন করা গেল না। আর সবচেয়ে লজ্জ্যাজনক বিষয় হলো, গত ৫৩ বছরে দেশে একটি জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার (রিফাইনারি) নির্মাণ করা যায়নি। বর্তমানে যে রিফনারিটি রয়েছে, যা ইস্টার্ন রিফাইনারি নামে পরিচিত সেটিও এদেশে ১৯৬৮ সালে নিমাণ করা হয়। একটি রিফাইনারি করতে লাগে তিন বছর সময়। এই সময়ে দেশে একটির স্থলে দেশে অন্তত তিনটি রিফাইনারি নির্মাণ করা যেতো। এতে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা যেতো।

এখন নতুন করে আবার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সেই প্রকল্পের ব্যয় বাড়তে বাড়তে এখন দাড়িয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকায়। প্রকল্পের নথিপত্রেই উল্লেখ করা হয়েছে, ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল পরিশোধন ও মজুতের ক্ষমতাসম্পন্ন প্রকল্পটি যথাসময়ে শুরু করা গেলে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যেই এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হতো। আর প্রতিবছরে সরকারের সাশ্রয় হতো অন্তত ২ হাজার কোটি টাকা। আর বর্তমান মজুত সক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে বেড়ে হতো ৪৫ লাখ টন। অথচ এ সুযোগ কাজে না লাগিয়ে সময়ক্ষেপণ করে প্রকল্পটিকে হিমঘরে রাখা হয়। এখন জ্বালানি তেলের দাম লাগামহীন হওয়ায় টনক নড়েছে ইস্টার্ন রিফাইনারির। অথচ করোনার শুরুর দিকে জ্বালানি তেলের দাম তলানিতে এসে ঠেকেছিল। তখন এ রকম একটি শোধনাগার করা থাকলে, জ্বালানি তেলের বিশাল মজুত রাখার পাশাপাশি এর পেছনে খরচও অনেকাংশে কমানো সম্ভব ছিল। বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক লাভবান হতো।  

অপরিশোধিত তেল পরিশোধনে ২০১২ সালে দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় এ ইউনিট নির্মাণের প্রকল্প নেয় সরকার। এরপর দেশে বড় বড় মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। বিদ্যুত ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ও দেশের বিদ্যুত ও জ্বালানি খাত নিয়ে বড় বড় পরিকল্পনা মহাপরিকল্পনা করে। কিন্তু ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট করতে গরিমসি করা হয়। এতে সময় গড়িয়ে যায়। গাড়িমসি করতে করতে ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল প্রকল্পটির জন্য ভারতীয় একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করে বিপিসি। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর উপস্থিতিতে চুক্তিসই অনুষ্ঠান হয়। ওইদিন প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, পরবর্তী বছরের মধ্যেই ইআরএল-২ প্রকল্পের ভৌত কাজ শুরু হবে। পরবর্তী বছর কাজ শুরু না হলেও ২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি দ্বিতীয় ইউনিটের ডিজাইন বা নকশা তৈরির জন্য ফ্রান্সের টেকনিপ নামের একটি কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চুক্তি হয়। দ্বিতীয় ইউনিটের নকশা তৈরিতে ৩২২ কোটি টাকা দিতে হতো ফ্রান্সের কোম্পানিটিকে। আর ১১ মাসের মধ্যে টেকনিপের এই ডিজাইন তৈরি করে দেবার কথা ছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল। যদিও শুরুতে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা প্রকল্প ব্যয় ধরা হলেও ওই সময়েই সংশোধিত হয়ে ব্যয় বেড়ে দাড়ায় ১৬ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। ওই সময় কুয়েত এই প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণে দফায় দফায় প্রকল্পের প্রস্তাবিত খরচ বেড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়ানোর পর এ কাজে আর আগ্রহী না হওয়ার কথা জানায় টেকনিপ।

২০১৮ সালের ৭ মে চট্টগ্রামে ইস্টার্ন রিফাইনারির সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু দুই মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শুরুর তাগিদ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রকল্পের কাজ আরও শুরু না হওয়ায় হওয়ায় মন্ত্রীর আশ্বাস নিয়েও সমালোচনা শুরু হয়। অভিযোগ উঠে, ওই সময়ে ব্যক্তিখাতে পেট্রোলিয়াম রিফাইনারি করতে বেসরকারি কয়েকটি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। ইআরএল-২ দ্রুত ও নির্ধারিত সময়ে নির্মিত হলে ব্যক্তিখাতের রিফাইনারির যেমন প্রয়োজনীয়তা তৈরি হবে না, তেমনি বিপিসিকে দীর্ঘদিন ধরে জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হারাবে। তাই ইআরএল-২ প্রকল্প শুরু হওয়ার আগেই ব্যক্তিখাতের রিফাইনারি অনুমোদন নিতেই প্রকল্পটির ডিপিপি অনুমোদনসহ নানা প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত না সরকারি, না বেসরকারি নতুন কোন  তেল শোধনাগারই গত এক যুগে দেশে নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেছিলেন, একটি গোষ্ঠী অতীতে এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। এ খাতে সরকারের সক্ষমতা যাতে না বাড়ে, তা নিশ্চিত করার জন্য তারা প্রভাব বিস্তার করে থাকতে পারে।’

তবে গত এক যুগে দেশে কোন রিফাইনারি স্থাপন করা না গেলেও দেশের জ্বালানির চাহিদাও ৫৫ লাখ মেট্রিক টন থেকে ৬৫ লাখ মেট্রিক টনে এসে দাড়িয়েছে। আর গত এক যুগে এ প্রকল্পের প্রস্তাব কমপক্ষে ১০ বার সংশোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৫৯ কোটি টাকা। দফায় দফায় প্রকল্প ব্যয় প্রস্তাব সংশোধন করে অঙ্ক বাড়ানো হলেও কেন তা অনুমোদন হলো না, কেন এক যুগেও বাস্তবায়ন শুরু করা গেল না সেটি এখনও বড় প্রশ্ন হয়ে আছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে সামনে চলে আসে ইস্টার্ণ রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট। জ্বালানি তেলের বাড়তি দামের আগুন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকে পোড়াতে শুরু করে। এ নিয়ে গণমাধ্যমে তীব্র সমালোচনা হয়। তখনই ঘুম ভাঙে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। নানা অসংগতির এই প্রকল্পটি তখন তড়িঘড়ি করে অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে আগের পরিকল্পনা বাদ নিয়ে নতুন করে ইন্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিটের পরিকল্পনা করা হয়। এসময় এর ব্যয় বেড়ে দাড়ায় সাড়ে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকায়। ওই প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে জমা দিলে কমিশন প্রকল্প প্রস্তাবের নানা অসঙ্গতি চিহ্নিত করে। বিদেশভ্রমণ, বিলাসী গাড়ি কেনাকাটাসহ বিচিত্র সব ব্যয়ের প্রস্তাব করা প্রকল্প প্রস্তাবনায়। প্রকল্পে বিশাল বহরের বিদেশে প্রশিক্ষণ, সভা করার জন্য বিদেশে ভ্রমণ সুযোগ রাখা হয়। দামি আসবাব, অপ্রয়োজনীয় ভবন নির্মাণ ও গাড়ি ক্রয়, কম গুরুত্বপূর্ণ কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে ধারণাভিত্তিক বেশি ব্যয়ের কথাও বলা হয়েছে। এ শোধনাগারের আয়ুষ্কাল ২০ বছর হলেও জমি লিজ নেওয়া কথা বলা হয় ৯০ বছরের জন্য। এ ছাড়া ১ হাজার ১২২ স্কয়ার মিটারের খাবারের ক্যানটিন, আবাসিক এরিয়ায় দুটি মসজিদ, মসজিদ কোয়ার্টার, ৬ তলা ব্যাচেলর অফিসার্স হোস্টেল, অফিসার্স ক্লাব, স্টাফ ক্লাবসহ নানা স্থাপনা নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনা আপত্তি জানায়, প্রশাসনিক ভবন ছাড়া অন্যান্য স্থাপনা প্রকল্পের সঙ্গে যায় না। তা ছাড়া নতুন করে যেসব স্থাপনার কথা বলা হয়েছে, তা ইআরএল-১ ইউনিটের আওতায় আগেই  তৈরি করা হয়েছে। তাই খুবই জরুরি ভবন ছাড়া অন্যান্য স্থাপনা বাদ দিতে হবে। আবার দুই তলা অনেকগুলো ভবনের পরিবর্তে জমি সাশ্রয়ে বহুতল ভবনে জোর দিতে হবে। কমিশনের আপত্তি আমলে নিয়ে কিছু সংশোধনীসহ বিপিসি ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিটের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) পুনরায় পরিকল্পনা কমিশনে জমা দিয়েছে। বর্তমানে এটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

শুরুর দিকে কুয়েত এই প্রকল্পে এগিয়ে এলেও সরকার এখন কুয়েতের কাছে অর্থায়নের প্রস্তাব করেছে। ২০২২ সালের জুনে প্রস্তাবিত বিনিয়োগ নিয়ে কুয়েত পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (কেপিসি) সঙ্গেও আলোচনা করেছে বিপিসি। কিন্তু ওই কুয়েতি কোম্পানি থেকে এখন পর্যন্ত কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি। অর্থাৎ কুয়েত এখন আর অর্থায়নে সাড়া দিচ্ছে না। ফলে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নেই ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট করতে হচ্ছে। এজন্য বিপিসি সরকারের কাছে ২০০ কোটি ডলার চেয়েছে। 

ফলে মোট ২৩ হাজার ৫৯ কোটি টাকার ওই প্রকল্পের সরকার তথা অর্থ বিভাগ ১৬ হাজার ১৪২ কোটি টাকা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে (বিপিসি) ঋণ হিসেবে দিতে সম্মত হয়েছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পাঁচ বছর মেয়াদের প্রকল্পটি ২০২৭ সালের জুন মাসে শেষ হবে। তবে ঋণের জন্য ৫ শতাংশ হিসেবে ২০ বছরে বিপিসিকে সুদ হিসেবে দিতে হবে আরও ১৬ হাজার ১৪২ কোটি টাকা। আর বাকী টাকা বিপিসি নিজস্ব তহবিল থেকে প্রদান করবে।

গত ৩০ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের বাজেট-১৫ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব ফয়সল জহুর স্বাক্ষরিত পত্রে উল্লেখ করা হয়, বিপিসির অধীন ইআরএল কর্তৃক বাস্তবায়িতব্য ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২’ প্রকল্পে জিওবি অংশের প্রাক্কলিত ১৬ হাজার ১৪২ কোটি টাকা ‘১০০ শতাংশ উন্নয়ন ঋণ’ হিসেবে অর্থায়নে অর্থ বিভাগ সম্মতি প্রদান করছে। পত্রে ঋণের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়, জিওবি ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার ৫ শতাংশ, ঋণ পরিশোধে সময়সীমা পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছর (ত্রৈ-মাসিক কিস্তিতে)।

ইপিসি (ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন) ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ পেতে ফ্রান্সের টেকনিপ চার বছরের বেশি সময় ধরে প্রস্তাবনা নিয়ে কাজ করলেও শেষে বিরক্ত হয়ে সরে দাঁড়িয়েছে। আর ভারতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারস ইন্ডিয়া লিমিটেডের মেয়াদ ৪ বছর বাড়িয়ে সাত বছর চলে গেলেও বিপিসি এই রিফাইনারি নির্মাণ করতে পারেনি। ফলে ফলে বিনা কাজে বসিয়ে রেখে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটিকে দ্বিগুণ অর্থ ২৫৬ কোটি টাকা দিতে হয়েছে।

বিপিসি বলছে, ফরাসি কোম্পানি টেকনিপ আগ্রহ হাড়ানোর আগে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ২২৩ কোটি মার্কিন ডলার চেয়েছিল। তখন ভারতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এই ব্যয় প্রস্তাব পর্যালোচনা করে জানায়, টেকনিপের এই ব্যয় প্রস্তাব অত্যধিক বেশি। উম্মুক্ত দরপত্র আহবান করে এই প্রকল্প বাস্তাবায়ন করলে খরচ অনেক কম পড়বে। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি এই রিফাইনারি নির্মাণে ১৮০ কোটি ডলার খরচ পড়বে বলে হিসাব দেয়। এ কারণে নতুন প্রকল্পটি উন্মুক্ত আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

উল্লেখ্য, দেশের পুরানো ইস্টার্ন রিফাইনারিটি ফরাসি কোম্পানি টেকনিপ নির্মাণ করেছিল। ফলে এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি সরকারের একটি সহমর্মিতা ছিল। এ কারণে তাকে দিয়েই দরপত্র ছাড়া দ্বিতীয় ইউনিট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। তাছাড়া ওই কোম্পানি ফরাসি ঋণে এই প্রকল্প করে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। বর্তমানে এই কোম্পানিটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। 

ইআরএল-২ প্রকল্পটি চালু হলে ইআরএলের ক্রুড অয়েল পরিশোধন ক্ষমতা প্রতি বছর ৪৫ লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়াবে। এতে মোট চাহিদার ৭৫ ভাগ চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। ইআরএল-২ এর মাধ্যমে ফিনিশড প্রডাক্ট হিসেবে এলপিজি, গ্যাসোলিন ইউরো-৫, জেট এ-১, ডিজেল ইউরো-৫, গ্রুপ-৩ বেজ অয়েল, ফুয়েল অয়েল, বিটুমিন ও সালফার পাওয়া যাবে। এতে বছরে বিপিসির সাশ্রয় হবে ২২ কোটি ডলার।

লেখক: কাওসার রহমান, প্রধান প্রতিবেদক, দৈনিক জনকণ্ঠ।