বাজারে মাংসের দাম কি উৎপাদন খরচের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?

বাজারে মাংসের দাম কি উৎপাদন খরচের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?

বাজারে মাংসের দাম কি উৎপাদন খরচের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?

সম্প্রতি ডিম, মুরগির মাংস, গরু ও খাসির মাংসের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি বেশ আলোচনায় এসেছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে যে, ঢাকা শহরে এক বছরের ব্যবধানে পরিবার প্রতি খাবার খরচ বেড়েছে ২৫ শতাংশ।

নিত্যপণ্যের বাজারে গিয়ে দাম বৃদ্ধি নিয়ে সাধারণ মানুষও হতাশার কথা বলছেন।বিশেষ করে প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস ডিম আর মাংসের দাম বৃদ্ধির কারণে জনস্বাস্থ্যে প্রভাব পড়বে বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।গরু, খাসি ও মুরগীর মাংসের দাম এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে “নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেনু থেকে মাংস এখন উধাও হবার পথে” বলে মনে করেন কনজিউমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ক্যাব এর চেয়ারম্যান গোলাম রহমান।

অন্যদিকে ব্যবসায়ী ও বিক্রেতারা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছেন যে পোল্ট্রি ও গবাদি পশুর খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে তারা মুরগি, ডিম, গরুর মাংস এবং খাসির মাংসের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে।কিন্ত গত এক বছরে দেশে কি উৎপাদন খরচের সাথে সামঞ্জস্য রেখে একই অনুপাতে পশুখাদ্য, ডিম, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুর দাম বেড়েছে?বিক্রেতারা যে দাবি করছে সেটা কতটা যৌক্তিক?

‘মাংসের উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে বাজারের দাম অনেক বেশি’

সম্প্রতি সিপিডি তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে যে, আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় বাংলাদেশে মাংসের দাম বেশি।সংস্থাটি বলেছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় চার সদস্যের পরিবারে প্রতি মাসে খাবার খরচ ছিল ১৮ হাজার ১১৫ টাকা। মাছ-মাংস বাদ দিলে সেই খরচ ছিল ৫ হাজার ৬৮৮ টাকা।২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় চার সদস্যের পরিবারে প্রতি মাসের খাবার খরচ হয়েছে ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা এবং মাছ-মাংস বাদ দিলে সেই খরচ এখন ৭ হাজার ১৩১ টাকা। অর্থাৎ পরিবারপ্রতি খাবার খরচ বেড়েছে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন প্রতিবেদনটি প্রকাশকালে সাংবাদিকদের বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সাথে যদি তুলনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে বাংলাদেশে যে দামগুলো সেটা কিন্তু বরাবরই উপরের দিকে।""ব্যয়গুলো অনেকসময় উৎপাদনমুখী হয় না। সেই ধরনের ব্যয়ের মধ্যে লাগাম টেনে ধরবার একটা বিষয় রয়েছে। বাজার তার মতো কাজ করতে পারে না বাজারে অনেক ধরনের অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়" - বলেন তিনি।

কনজিউমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ক্যাব এর চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলছেন, যেভাবে বাজারে মাংসের দাম বাড়ছে - তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।বিবিসিকে তিনি বলেন, “বাজারে মাংসের অস্বাভাবিক মূল্য। প্রকৃত যে উৎপাদন ব্যয় তার চেয়ে বাজারের দাম অনেক বেশি।

বাংলাদেশ পোলট্রি এসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা রেডি ফিডের দাম বেড়েছে প্রায় তেরোশো'র বেশি।“এক বছর আগে রেডি ফিডের দাম ছিল ২৪০০ টাকা, ৯ই মার্চ দাম বাড়ানোর পরে হয়েছে ৩৭৪০ টাকা। কত উৎপাদন খরচ হচ্ছে, ফিড নিরাপদ আছে কিনা - এদিকে নজর দেয়া দরকার।"

"এক কেজি গরুর মাংস ৪৫০ টাকার উপরে খরচ নাই বাংলাদেশে। কিন্তু কিনে খেতে হচ্ছে মাঝেমধ্যে ৮০০ টাকায়। দুঃখজনক। ব্রয়লার মুরগীর উৎপাদন খরচ ১৯০ টাকায় কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে ১৫০ টাকায় এটাও দুঃখজনক। ” – বলেন বাংলাদেশ পোলট্রি এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সুমন হাওলাদার।এক কেজি মাংস উৎপাদনে কত খরচ হয়?

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন (মার্চ, ২০২৩)

এক কেজি সোনালী মুরগীর উৎপাদন খরচ ২৯০.৮০ টাকা

এক কেজি ব্রয়লার মুরগীর উৎপাদন খরচ ১৬১.৫৫ টাকা

একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০.৮১ টাকা

এক কেজি গরুর মাংসের উৎপাদন খরচ ৬৮৭.৫০ টাকা

এক কেজি খাসির মাংসের উৎপাদন খরচ ৮৭৫ টাকা

প্রতি বছরে বাড়ছে মাংস ও ডিমের দাম

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবি’র বাজার দর অুনযায়ী, ২০২৩ সালে গরুর মাংসের প্রতি কেজি ৭২০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

২০২২ সালে গরুর মাংস প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।

২০২১ সালের একই সময়ে গরুর মাংস কেজিপ্রতি দাম ছিল ৫৬০ থেকে ৬০০ টাকা।

খাসি ও মুরগির মাংসের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে - অর্থাৎ গত তিন বছরে আস্তে আস্তে এগুলোর দাম বেড়েছে।অন্যদিকে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ক্যাব) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে গরুর মাংসের দাম বেড়ে কেজি প্রতি ৬০০ টাকা হয়। ২০২২ সালে এসে গরুর মাংসের গড় দাম ছিল ৬৮৮ টাকা, যা ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৭৫০ টাকায়।উৎপাদন খরচের সাথে বাজার মূল্য সামঞ্জস্যপূর্ণ না হবার কারণকে ‘লোভ’ বলে উল্লেখ করে ক্যাব এর চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ‘সবাই বেশি প্রফিট করতে চায় এজন্য এমন অবস্থা চলছে’।বাংলাদেশ পোলট্রি এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সুমন হাওলাদার মনে করেন, বাজারে নিয়মিত মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় সামঞ্জস্যহীনভাবে এসব পণ্যের দাম বাড়ছে।

মি. রহমান বলছেন “কোনও প্রতিষ্ঠান নিরাপদ ফিড উৎপাদন করে কিনা – এক কেজি ফিডের উৎপাদন খরচ কতো- সে কত প্রফিট করবে কত টাকায় বিক্রি করা যাবে, একটা বাচ্চার উৎপাদন খরচ কতো – সেই বাচ্চাটায় কত টাকা প্রফিট করবে – কত টাকায় বাজারজাত করবে – এবং বাচ্চাটা মানসম্মত কিনা- এদিকে নজর দেয়া দরকার।""মূল কথা হলো কারও তদারকি নাই। কত উৎপাদন খরচ হচ্ছে, ফিড নিরাপদ আছে কিনা, কে কত ব্যবসা করছে - সেদিকে কোনও তদারকি নাই” বলেন তিনি।

চাহিদা যোগানের ভারসাম্যহীনতা?

সংশ্লিষ্টরা বেশি কিছুদিন ধরে বলে আসছেন , কোভিড মহামারির পরপরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি - সব মিলিয়ে পোল্ট্রি ও গবাদিপশুর খাদ্যের দামে যে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বাজার মূল্যে।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, “এখন যে হুট করে দামটা বাড়লো এর কারণ হতে পারে চাহিদা যোগানের ভারসাম্যহীনতা”।

তার মতে, খরচ বেড়ে যাবার কারণে পোল্ট্রি বা গবাদিপশুর খামারি অনেকেই উৎপাদন থেকে পিছু হটেছেন। এতে উৎপাদন কম হয়েছে কিন্তু চাহিদাটা বেড়ে গেছে, ফলে দামটাও বেড়ে গেছে।তবে এখন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে উৎপাদন বাড়ানোর।যদি উৎপাদন বাড়ানো যায় সেক্ষেত্রে উৎপাদন খরচের ভিত্তিতে মাংস বিক্রি করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।

সূত্র : বিবিসি