আলেম সমাজের বিচিত্র পেশা

আলেম সমাজের বিচিত্র পেশা

ফাইল ছবি

জীবন ধারণের জন্য জীবিকার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। ইসলাম কখনো এর গুরুত্ব অস্বীকার করেনি; বরং বিভিন্নভাবে জীবিকা অর্জনের প্রতি উৎসাহিত করেছে। যেমন কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহ তায়ালা ব্যবসায়কে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সূরা বাকারা-২৭৫)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- ‘যখন সালাত সমাপ্ত হয় তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো। আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো। যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সূরা জুমুআ-১০)

এই আয়াতের তাফসিরে ইমাম কুরতুবি রহ: লিখেছেন, যখন সালাত শেষ হয়ে যাবে, তখন তোমরা ব্যবসায়িক কাজকর্ম ও অন্যান্য পার্থিব প্রয়োজনাদি পূরণে বেরিয়ে পড়। (আল জামে লিআহকামিল কুরআন)

তাকমিলায়ে ফাতহিল মুলহিম গ্রন্থে আল্লামা তাকি উসমানি লিখেছেন, ইসলাম বরাবরই জীবন ধারণের জন্য উপার্জন করতে উৎসাহিত করেছে। এ কারণেই কুরআনে ব্যবসায়কে আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ সন্ধান এবং সম্পদকে খাইর বা কল্যাণ, খাদ্যকে তয়িবাতে রিজক বা পবিত্র রিজিক শব্দ দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যার জমি আছে, সে নিজেই চাষাবাদ করবে।’ (সহিহ বুখারি-২৩৪০) হজরত রাফে ইবনে খাদিজ রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, সর্বোত্তম উপার্জন কোনটি? জবাবে তিনি বলেন, ‘ব্যক্তির নিজস্ব শ্রমলব্ধ উপার্জন ও সততার ভিত্তিতে ব্যবসায়।’ (মুসনাদে আহমদ)

এ ছাড়াও আমরা জানি, হজরত আবু বকর, উমর রা:সহ প্রায় বেশির ভাগ সাহাবায়ে কেরাম ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন। হজরত উসমান রা:-কে তো গনি বা ধনী উপাধি দেয়া হয়েছিল। হজরত জুবায়ের রা:-এর কাছে মানুষ প্রচুর পরিমাণে আমানত রাখত। আর তিনি সেই টাকা দিয়ে ব্যবসায় করতেন। রাসূলুল্লাহ সা: নিজেও যৌবনে ব্যবসায় করেছেন। জারেক নামক স্থানে তিনি কৃষিকাজও করেছেন। (নবীয়ে রহমত-সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী) সাহাবায়ে কেরামও বিভিন্ন পেশায় জড়িত ছিলেন। পূর্ববর্তী উলামায়ে কেরামের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারাও নিজেদের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রেখেছেন। হালাল উপার্জনের মাধ্যমে তারা স্বাবলম্বিতা অর্জন করেছেন। পাশাপাশি তারা ইলম চর্চায়ও কোনো অংশে পিছিয়ে ছিলেন না। জীবিকা ও ইলমচর্চার মধ্যে তারা বিস্ময়কর ভারসাম্য বজায় রেখেছেন।

ইমাম আবু হানিফা রহ: কাপড়ের ব্যবসায় করতেন। তার রেশমি কাপড়ের ব্যবসায় ইরান থেকে ইরাক, সিরিয়া ও হিজাজ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সেই সুবাদে প্রচুর বিত্তের অধিকারী ছিলেন। সবচেয়ে দামি ও শৌখিন পোশাক পরতেন। উলামায়ে কেরামের মধ্যে সম্ভবত তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি সরকারি সাহায্য ছাড়াই নিজ ছাত্রদের ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা করেছিলেন। তৎকালীন শাসকের উপহারও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ: তার ছাত্র হাসান বিন রবি কুফিকে প্রশ্ন করেছিলেন, তোমার পেশা কী? হাসান বলেন, আমি চাটাইয়ের ব্যবসা করি। কয়েকজন কর্মচারী আছে। তারা চাটাই বানায় ও বিক্রি করে। আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক বলেন, তোমার এই ব্যবসায় না থাকলে আমার এখানে থাকা তোমার জন্য কঠিন হতো।

আবুল ফজল মনসুর বিন নসর নিশাপুরি কাগজের ব্যবসায় করতেন। খোরাসানের প্রসিদ্ধ মনসুরি কাগজ তার দিকেই সম্পৃক্ত করা হয়। আবু সাঈদ মুহাম্মদ বিন আহমদ ইস্পাহানি হোটেল চালাতেন। (মুসলমানো কে হ্যর তবকা ও হ্যর পেশা মে ইলম ও উলামা কিতাবের নাম)

তাই উপার্জনের পথ সুসংহত থাকার দরুন তৎকালীন উলামায়ে কেরামের ইলমচর্চার পথ ছিল মসৃণ। আর বর্তমান উলামায়ে কেরামের হালত সম্পূর্ণ বিপরীত। মসজিদ-মাদরাসা, খানকাহ ইত্যাদিই হচ্ছে তাদের উপার্জনের প্রধান উৎস। মসজিদ-মাদরাসার বেতন যা খুবই নগণ্য। এই টাকায় না মেটে পরিবারের চাহিদা আর না নিজের। নিজেদের হীনম্মন্যতার দরুন তারা এগুলো থেকে বেরিয়ে এসে কিছু করতে পারছে না; বরং নিজেদের আবদ্ধ রেখেছে চারদেয়ালের মধ্যে। অথচ সময়ের দাবি হলো- মসজিদ-মাদরাসার পাশাপাশি নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলা বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। যাতে মসজিদ-মাদরাসাই না হয় আয়-রোজগারের মূল হাতিয়ার। আল্লাহ তায়ালা আমাদের দোজাহান সুখময় করুন। আমিন।

লেখক : শিফতা শহীদ যুলফা

 দাওরায়ে হাদিস উত্তীর্ণ, মিফতাহুল জান্নাত মহিলা মাদরাসা, গলগণ্ডা, ময়মনসিংহ