আমদানি নিরুৎসাহিত হওয়ায় কমছে শুল্ক, বাজেটে ঘাটতির শঙ্কা

আমদানি নিরুৎসাহিত হওয়ায় কমছে শুল্ক, বাজেটে ঘাটতির শঙ্কা

আমদানি নিরুৎসাহিত হওয়ায় কমছে শুল্ক, বাজেটে ঘাটতির শঙ্কা

বাংলাদেশে ডলার সংকটে আমদানির উপর নানা কড়াকড়ির কারণে চলতি বছরে আমদানি খাতে সরকারের রাজস্ব আহরণ বেশ কমে গেছে। বছরের প্রথম আট মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় শুল্ক আদায়ে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

আমদানি শুল্ক আদায় কমছে

অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, বাকি চারমাসেও এই ধারা বজায় থাকবে এবং বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। বরং বছর শেষে এই খাতে বড় ঘাটতি তৈরি হবে, যার প্রভাব পড়তে পারে বাজেটের অন্যান্য খাতে।জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যে জানা যাচ্ছে, জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমদানি খাতে ভালো রাজস্ব অর্জিত হয়েছে।কিন্তু ডিসেম্বর মাস থেকে সেই ধারা কমতে শুরু করে। বিশেষ করে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে আমদানি শুল্ক, আমদানি খাতের ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক-সব কটিতেই ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা যেতে শুরু করে।

আমদানি খাতে এই বছরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। তবে জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫৯ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা।ফলে অর্থবছরের আট মাসে আমদানি খাতে রাজস্ব ঘাটতি তৈরি হয়েছে প্রায় তেইশ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের সঙ্গে তুলনা করলে আমদানি খাতে রাজস্ব আদায়ের হার কমে গেছে ১৬.০৯ শতাংশ।

কেন রাজস্ব কমছে?

আমদানি শুল্ক কমে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণকে দায়ী করছেন বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা।এর মধ্যে ডলার সংকটের কারণে আমদানি নীতিতে কড়াকড়ি, ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়া, ঋণপত্র খুলতে না পারা, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি এবং বিলাসী দ্রব্যের আমদানি কমে যাওয়ার কারণে আমদানি কমে গেছে। এই কারণে আমদানি খাত থেকে শুল্ক-কর আদায়ের পরিমাণও কমেছে।বাংলাদেশের খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশিরভাগ পণ্যই আমদানি করতে হয়। কিন্তু আমদানি খাতে শুল্ক বেশি আসে গাড়ি ও বিলাসবহুল নানা পণ্য থেকে। কিন্তু এই অর্থবছরে এ জাতীয় পণ্য আমদানি অর্ধেকে নেমে এসেছে।

গত বছরের মে নাগাদ বাংলাদেশে ডলার সংকট শুরু হওয়ার পর এলসির মার্জিন বৃদ্ধি, বিলাসবহুল পণ্যে শুল্ক বাড়িয়ে দেয়াসহ কড়াকড়ি এবং নজরদারি বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক।অর্থবছরের আটমাসে ঋণপত্র খোলার হার কমে গেছে এক-চতুর্থাংশ। বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতি, ভোগ্যপণ্য, ইন্টারমিডিয়েট পণ্য এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমে গেছে।

অর্থনীতি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, এ বছর আমদানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক রয়েছে এবং অর্থবছর শেষে এটা নেতিবাচকই থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

‘’তার একটি বড় কারণ, গত অর্থবছরে বেশ অস্বাভাবিক আকারের একটা আমদানি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। সেটা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং বাণিজ্য ঘাটতির ওপর বড় একটা চাপ তৈরি করেছিল। ফলে সরকার শুরু থেকেই আমদানিকে নিরুৎসাহিত করার একটা চেষ্টা করেছে। সেজন্য এলসি খোলার ক্ষেত্রে নানারকম কড়াকড়ি এসেছে, সেটেলমেন্টও কমেছে। ফলে আমদানি ঋণাত্মক হয়ে যাওয়ায় এই খাত থেকে শুল্ক আদায়ও কমে গেছে,‘’তিনি বলছেন।

বাংলাদেশে ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৩ হাজার ৪১০ কোটি ডলারের। এর আগের বছর একই সময়ে এই পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪০১ কোটি টাকা।বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানির এলসি কমে গেছে ৬৫ শতাংশ। সেই সঙ্গে কাঁচামাল আমদানিও কমেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’আমাদের আসলে আমদানি কমে গেছে। এলসি খোলার হার কমে গেছে, মেট্রিকটনের হিসাবে আমদানি কমেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে আমদানি পর্যায়ে কাস্টমস ডিউটির টোটালটা কমে গেছে।‘’

বাজেটে কী প্রভাব পড়বে?

অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, এর প্রভাব শুধু আমদানি শুল্কেই নয়, বাজেটের অন্যান্য খাতেও প্রভাব পড়বে।বিশেষ করে নতুন শিল্পকারখানায় বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমে যাবে, ব্যবসা-বাণিজ্যে ধীর গতি তৈরি হবে। ফলে ভ্যাট এবং আয়করের ওপরেও তার প্রভাব পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।আমদানি খাতের রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার কারণে সেটা পুরো বাজেটের ওপরেই একটা প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন অধ্যাপক সেলিম রায়হান।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলছেন, বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থা এখনো অনেকাংশে প্রত্যক্ষ করের তুলনায় পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। কারণ গত কয়েক বছর ধরে আয়করের পরিধি তেমন বাড়েনি।‘’সামগ্রিকভাবে মনে করি, এই অর্থবছরে বড় একটা চাপ থাকবে, রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা, সেটা আসলে পূরণ করা যাবে না। সেটা সরকারকে নানাভাবে সমন্বয় করতে হবে, হয়তো বাজেটে বিভিন্ন খাতে খরচ কাটছাঁট করে, ‘’তিনি বলছেন।

বাংলাদেশের রাজস্ব ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কর থেকে সরকার আয় করে থাকে। আয়কর প্রত্যক্ষ কর হলেও আমদানি শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট, আবগারি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, রপ্তানি শুল্ক ইত্যাদি পরোক্ষ কর। মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার দুই-তৃতীয়াংশ এরকম পরোক্ষ কর থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।

তবে আমদানি খাতের রাজস্ব কমে যাওয়ায় বাজেটের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে, সেই ইস্যুতে কথা বলতে চাননি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা।তারা আশা করছেন, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার যে সংকট রয়েছে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই সেটা কেটে গিয়ে আবার আমদানি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, তখন আবার শুল্ক-করও বাড়বে।কিন্তু সেটা এই অর্থবছরের মধ্যেই সেটা হবে কিনা বা কবে নাগাদ হবে, সে বিষয়ে এনবিআরের কর্মকর্তারাও পুরোপুরি নিশ্চিত নন।তবে ঘাটতি সামাল দিতে নজরদারি আরও বাড়ানো, বকেয়া শুল্ক আদায় আরও বাড়ানোর ওপর জোর দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর।

সূত্র : বিবিসি