ভারতের শীর্ষস্থানীয় নাচ শেখার কেন্দ্রে যৌন হয়রানির অভিযোগ

ভারতের শীর্ষস্থানীয় নাচ শেখার কেন্দ্রে যৌন হয়রানির অভিযোগ

চেন্নাইয়ে অবস্থিত 'কলাক্ষেত্র' ভারতের শীর্ষস্থানীয় একটি নাচ শেখার ইনস্টিটিউট

ভারতের একটি শীর্ষ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘কলাক্ষেত্র’ – যা বিশেষ করে ভরতনাট্যম নাচ শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত – সেখানকার একজন ফ্যাকাল্টি সদস্য এবং তিনজন বদলি শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠার পর তা নিয়ে শুরু হয়েছে হৈচৈ।

ঘটনার সূত্রপাত এখানকার একজন নাচের শিক্ষকের বিরুদ্ধে একজন সাবেক শিক্ষার্থীর আনা যৌন হয়রানির অভিযোগ থেকে – যা ওই শিক্ষক অস্বীকার করছেন।পুলিশ ওই শিক্ষককে গ্রেফতার করেছে।কিন্তু তার আগে কয়েকদিন ধরেই এই ইনস্টিটিউটের কয়েক শ শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করছিলেন।তাদের অভিযোগ- এই ক্যাম্পাসে বছরের পর বছর ধরে যৌন হয়রানি চলছিল কিন্তু প্রশাসন এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপই নেয়নি।

এখন এই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানটির ভেতরের কেলেংকারির খবর সংবাদমাধ্যমে আসার পর শুরু হয়েছে এর তদন্ত। তামিল নাডু প্রদেশের নারী বিষয়ক কমিশনও এসব অভিযোগ তদন্ত শুরু করেছে।কলাক্ষেত্রের কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, তাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার জন্যই এসব ছড়ানো হচ্ছে।

কী ঘটেছিল?

তামিল নাডু রাজ্যের রাজধানী চেন্নাইয়ে অবস্থিত কলাক্ষেত্রের ভরতনাট্যম নাচ শেখার প্রতিষ্ঠানটির নাম রুকমিণী দেবী কলেজ অব ফাইন আর্টস।

যে শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে তার নাম হরি পদমন। তিনি এ কলেজের একজন সহকারী অধ্যাপক এবং কৃতী নৃত্যশিল্পী।মি. পদমনের বিরুদ্ধে প্রথম যৌন হয়রানির অভিযোগটি তুলেছিলেন ভারতের বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী লীলা স্যামসন ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে – ফেসবুকে তার এক পোস্টে, জানান আইনজীবী বি এস অজিতা।

তিনি কারো নাম উল্লেখ না করে লেখেন যে কলেজের একজন শিক্ষক “শিক্ষার্ধীদের যৌন নিপীড়ন” করছেন, এবং অভিযোগ করেন যে “তিনি একজন ছাত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।“লীলা স্যামসন তার পোস্টে অভিভাবকদের সতর্ক করে দেন যেন তারা তাদের মেয়েদের ওই ইনস্টিটিউটে না পাঠান – যেখানে তার ভাষায় ‘যৌন শিকারিরা’ বিচরণ করছে।

ফেসবুকে নাম প্রকাশ করে দেন মন্তব্যকারীরা

লীলা স্যামসন তার ফেসবুক পোস্টে কারো নাম উল্লেখ করেননি, কিন্তু পোস্টের নিচে করা মন্তব্যগুলোতে হরি পদমন এবং সেই ছাত্রীটির নাম উল্লেখ করা হয়।তারা দুজনেই তাদের মধ্যে কোন অন্যায় সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেন।

এই ইনস্টিটিউটে যৌন হয়রানির ব্যাপারে একটি অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি (আইসিসি) রয়েছে। আইনজীবী বি এস অজিতা ২০১৮ সাল থেকে ওই কমিটির একজন সদস্য থাকার পর সম্প্রতি পদ ছেড়ে দেন। আইসিসি যখন হরি পদমন ও এই ছাত্রীটির ঘটনা তদন্ত করে তখন এর অংশ ছিলেন মিজ অজিতা।এই আইনজীবী বলেন, “ছাত্রীটি তার নাম যেভাবে এ বিতর্কে টেনে আনা হয়েছে তার নিন্দা করেন, এবং বলেন হরি পদমনের সাথে তার সম্পর্ক শিক্ষক ও ছাত্রের মতই। যেহেতু নারী শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তাই এই কেসটি ক্লোজ করা হয়।“

আরো অভিযোগ, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ

কিন্তু এ ঘটনার পর হরি পদমন এবং আরো তিনজন নৃত্যশিল্পী-শিক্ষকের বিরুদ্ধে আরো গুরুতর সব অভিযোগ আনতে থাকেন ইনস্টিটিউটের অন্য আরো শিক্ষার্থীরা।এসব অভিযোগকে কেন্দ্র করে ইনস্টিটিউটের ২০০-রও বেশি শিক্ষার্থী কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ করেন।

তারা বলেন এই ক্যাম্পাসে বছরের পর বছর ধরে যৌন হয়রানি ঘটছে কিন্তু প্রশাসন তাদের অভিযোগকে উপেক্ষা করেছে।এই নাচের স্কুলের কর্তৃপক্ষ হচ্ছে কলাক্ষেত্র ফাউন্ডেশন – যা ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এই ফাউন্ডেশন তাদের ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে কিছু ‘কায়েমি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী’ এ প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করে।

কিন্তু এই কেলেংকারির ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হলে ফাউন্ডেশনটি এই অভিযোগ তদন্তের জন্য একটি তিন সদস্যের প্যানেল গঠন করে – যার প্রধান করা হয় হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে।এ ছাড়া হরি পদমন এবং অন্য তিনজন শিল্পী-শিক্ষককে সাসপেন্ড করা হয়।বিবিসি এ ব্যাপারে ফাউন্ডেশনের মন্তব্য চাইলে তারা এক ইমেইলে জানায় “তদন্ত চলাকালীন সময়ে এ নিয়ে কোন মন্তব্য করা উচিত হবে না।“

কী বলছেন হরি পদমন?

হরি পদমনকে গত সপ্তাহে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।গ্রেফতারের আগে মি. পদমন কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে এক বৈঠকে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো অস্বীকার করেন।একটি টিভি চ্যানেলকে তিনি বলেছেন, তিনি ন্যায়বিচার পাবার জন্য সবরকম চেষ্টাই করবেন।নিউজ এইটিন নামে একটি টিভি চ্যানেলকে তিনি বলেন, “কলাক্ষেত্রে শত শত শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের জিজ্ঞেস করুন আমি কখনো তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি কি না বা খারাপ কথা বলেছি কি না।“

তিনি কখনো কাউকে যৌন নির্যাতন করেননি বলে জানিয়ে মি. পদমন বলেন “আমি আমার বিবেকের কাছে পরিষ্কার এবং আমি জানি যে তাদের হাতে কোন প্রমাণ নেই।“তিনি আরো বলেন তিনি তার নির্দোষিতা প্রমাণের জন্য সিসিটিভি ফুটেজের ওপর নির্ভর করছেন।

মি. পদমনের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন তার স্ত্রী-ও। তিনি তার পাল্টা অভিযোগ দায়ের করে বলেছেন – কলাক্ষেত্রের দু’জন শিক্ষকসহ অভিযোগকারীরা ঈর্ষা ও পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে তার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা বলছে।তিনি বলেন, হরি পদমন কিছু শিক্ষার্থীকে অসদাচরণের জন্য ‘তিরস্কার’ করেছিলেন বলে তার ওপর প্রতিশোধ নেয়া হচ্ছে এবং দুজন শিক্ষক এতে ‘উস্কানি দিয়েছেন।‘

'শারীরিক বৈশিষ্ট্যের জন্য লজ্জা দেয়া '

যৌন হয়রানির অভিযোগ নিযে বিবিসি কলাক্ষেত্রের বেশ কিছু শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সাবেক শিক্ষার্থী ও অন্যান্য কর্মচারীর সাথে কথা বলেছে।সেসব কথোপকথনে তরুণ নৃত্যশিল্পীরা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করা হয়।এরা সবাই তাদের নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কথা বলেছেন। কারণ তারা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন তারা বিখ্যাত এবং প্রতিষ্ঠিত নৃত্যশিল্পী।

অভিযোগকারীদের অনেকেই অভিযোগ করেন, কলাক্ষেত্রে স্বাধীনতার অভাব আছে, এবং সেখানে মুখ খারাপ করা হয়, ‘বডি শেমিং’ বা শারীরিক বৈশিষ্ট্যের জন্য লজ্জা দেয়া হয়, জাতপাতের জন্য বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়।কিছু শিক্ষার্ধী বলেছেন, তাদের ওজন কমাতে বলা হয়েছে।অন্য কয়েকজন বলেন, তাদেরকে অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা দেয়া হয়নি, এবং গায়ের রঙ অপেক্ষাকৃত কালো বলে বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে।

অশোভন স্পর্শ, অশালীন টেক্সট

তবে সবচেয়ে গুরুতর হচ্ছে যৌন হয়রানির অভিযোগ।এর শিকার হয়েছেন নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থী উভয়েই।তারা অভিযোগ করেছেন যে তাদের দেহে অশোভনভাবে স্পর্শ করা হয়েছে, তাদের কামুক টেক্সট মেসেজ পাঠানো হয়েছে।তারা আরো দাবি করেন, কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ গুরুত্বে সাথে নিতে অস্বীকার করেছে।একজন সাবেক ছাত্রী বিবিসিকে বলেন, তিনি হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং একজন শিক্ষকের যৌন আচরণ ঠেকানোর পরে পরীক্ষায় তার প্রাপ্ত নম্বর কমে যায়।

“তিনি সামাজিক মাধ্যমে আমাকে বন্ধু হবার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। আমি তা গ্রহণ না করলে তিনি আমাকে উত্যক্ত করতে থাকেন, জানতে চান কেন আমি তাকে বন্ধু করে নিচ্ছি না।““শেষ পর্যন্ত আমি যখন তার প্রস্তাব গ্রহণ করলাম, তখন তিনি আমাকে কামুক বার্তা পাঠাতে লাগলেন। এগুলো এতই খারাপ ছিল যে তা আমি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথেও শেয়ার করতে পারিনি। এর পর আমি তাকে বন্ধু তালিকা থেকে বাদ দেই। তখন তিনি আমার সাথে খারাপ আচরণ করতে থাকেন।“তিনি অভিযোগ করেন, এর পর থেকে পরীক্ষায় তার পাওয়া নম্বর অনেকটা কমে যায়।

একজন পুরুষ শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা

একজন পুরুষ ছাত্র বর্ণনা করেছেন কিভাবে তিনি অন্য আরেকজন শিক্ষকের হয়রানির শিকার হয়েছেন।“মাঝরাতে তিনি আমাকে ‘গুড নাইট’ বার্তা পাঠালেন। আমি যখন তার জবাব দিলাম, তখন তিনি প্রশ্ন করলেন, আমি একা কি না এবং তিনি আসতে পারেন কি না। আমি স্তম্ভিত হলাম। এর পর তিনি ভিডিও কল করতে চাইলেন – যাতে তিনি আমাকে ‘পুরোপুরি’দেখতে পারেন।“

“তিনি আমাকে কামুক বার্তা পাঠাতেন। আমি এটা নিতে পারছিলাম না, আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম।“এই ছাত্রটি বলেন, তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করার পর হয়রানি আরো বেড়ে যায়।তার কথায়, প্রশাসন কিছুই করেনি এবং এতে হয়রানিকারীর সাহস আরো বেড়ে যায়। তা ছাড়া এর ফলে অন্য ছাত্রদের অভিযোগ নিয়ে এগিয়ে আসা ব্যাহত হয়েছে।

ললিতকলার 'আইআইটি'

কলাক্ষেত্র এমন একটি প্রতিষ্ঠান যাকে ললিতকলার আইআইটি বলা হয়। ভারতের আইআইটি নামে প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটগুলোতে ভর্তি হওয়া অত্যন্ত কঠিন এবং এখানে প্রকৌশলের ডিগ্রি পাওয়ার পর সারা বিশ্বে তাদের চাহিদা থাকে।একই ভাবে কলাক্ষেত্র তাদের ছাত্রছাত্রীদের খ্যাতি এবং প্রতিষ্ঠা এনে দেয় – যার ফলে তারা ভালো অর্থ আয় করতে পারে এবং সারা পৃথিবীতে অনুষ্ঠান করতে পারে।

প্রতিষ্ঠানটির অনেক শিক্ষার্থীই বিবিসিকে বলেছেন যে নৃত্যকলার এই একাডেমিতে আসতে পারা ছিল তাদের জীবনের স্বপ্ন।তবে এখন তারা বলছেন যে কিছু শিক্ষকের নিপীড়নের ফলে তাদের মনে নিজেদের মূল্য সম্পর্কে সংশয় তৈরি হয়েছে।এর বিপরীতে আবার কলাক্ষেত্র প্রতিষ্ঠান এবং তার শিক্ষকদের পক্ষ নিয়েও বক্তব্য দিয়েছেন এর সাবেক ছাত্রছাত্রীদের কিছু গোষ্ঠী।কেউ কেউ এমন ইঙ্গিতও করেন যে মি. পদনমের বিরুদ্ধে যেসব বেনামী অভিযোগ করা হচ্ছে তা “ মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।“

অভিযোগের ব্যাপারে কিছুই করা যায়নি

আইসিসি এমন আরো কিছু অভিযোগ বিবেচনা করেছে।এর মধ্যে একটিতে একজন সাবেক ছাত্রী অভিযোগ করেন যে মি. পদমন “তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করেছেন এবং তাকে একটি নাচের অনুষ্ঠান থেকে বাদ দিয়েছেন।

আরেকটি অভিযোগ করেছেন তিনজন পুরুষ শিক্ষার্থী। তারা অন্য কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন।মিজ অজিতা বলছেন, তারা এসব অভিযোগের বিষয়ে কিছু করতে পারেননি – কারণ ভারতের যৌন হয়রানি সংক্রান্ত আইনের কারণে আইসিসি শুধুমাত্র মেয়েদের আনা কেসগুলোই তারা হাতে নিতে পারেন। তা ছাড়া তারা শুধু সেসব কেসই অনুসন্ধান করতে পারেন যেগুলোতে যৌন হয়রানির সুস্পষ্ট অভিযোগ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, “আমরা অভিযোগগুলো কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি এবং জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবার সুপারিশ করেছি। কিন্তু প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নেয়নি।“একজন শিক্ষার্থী বলেছেন, তাদেরকে 'সবকিছু সহ্য করতে' শেখানো হয়েছে।অনেকে তা মেনে নেন, কারণ এটা শিল্পীদের একটি আবদ্ধ জগৎ এবং তরুণ শিক্ষার্থীরা মনে করেন এ নিয়ে মুখ খুললে তাদের কেরিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।তিনি বলেন, বর্তমানে পরীক্ষার জন্য তাদের বিক্ষোভ কর্মসূচি বন্ধ আছে । তা ছাড়া ইনস্টিটিউটের প্রশাসনও আশ্বাস দিয়েছেন যে তাদের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে এবং নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সূত্র :বিবিসি