লিওনেল মেসি বার্সেলোনায় ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম মনে হচ্ছে কেন?

লিওনেল মেসি বার্সেলোনায় ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম মনে হচ্ছে কেন?

লিওনেল মেসি বার্সেলোনায় ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম মনে হচ্ছে কেন?

লিওনেল মেসির প্যারিস অধ্যায় শেষ, এটা নিশ্চিত। সামনের মাস থেকেই মেসি মুক্ত একজন ফুটবলার হতে যাচ্ছেন। ফরাসী ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেই বা পিএসজির সঙ্গে মেসির চুক্তির মেয়াদ শেষ এবং সম্প্রতি মেসির ওপর আনা শাস্তির পর মেসি আর পিএসজিতে থাকছেন না।

পিএসজি এবং মেসির পথ এখন আলাদা। মেসি মনে করেন না যে পিএসজি ইউরোপের শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করার মতো দল গড়তে পারবে। অন্যদিকে পিএসজির ভাবনা হচ্ছে এখন তরুণ প্রতিভা তুলে এনে কাজ করা।২০২১ সালে লিওনেল মেসি পিএসজির সাথে দুই বছরের চুক্তি করেছিলেন। সেখানে এক বছর বাড়ানোর সুযোগ থাকলেও সেটা এখন কোন কাজে লাগবে না।সম্প্রতি 'ভিজিট সৌদি আরব' ক্যাম্পেইনে যোগ দিয়ে ক্লাব কর্তৃপক্ষের শাস্তির মুখে পড়েছেন তিনি। গত মাসে মেসিকে সৌদি আরবের ক্লাব আল হিলাল রেকর্ড বেতনে দলে নেয়ার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে।

লিওনেল মেসি যে শহরে ছুটি কাটান সেই যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামির ক্লাব ইন্টার মায়ামি তাকে দলে নিতে চাইছে। মেসিও বছর দু-এক আগে আমেরিকায় ফুটবল খেলার ইচ্ছার কথা বলেছিলেন।আর বার্সেলোনার সমর্থকরা মনেপ্রাণে চাইছেন তাদের সর্বকালের সেরা ফুটবলার ‘ঘরে’ ফিরুক।

যে শহরে কিশোর লিওনেল মেসি, ‘গ্রেটেস্ট অফ অলটাইম’ হয়ে উঠেছেন, সেই বার্সেলোনায় মেসির ফেরা এখন খুব কঠিন হবে - বলছেন স্প্যানিশ ফুটবল লেখক গিলেম বালাগ।মেসির বার্সেলোনায় যাওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশ কমছে।লিওনেল মেসি বার্সেলোনার হয়ে ৭৭৮ ম্যাচে ৬৭২ টি গোল করেছেন, যা ক্লাবটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

এই ক্লাবে মেসির ফেরার সম্ভাবনা কার্যত কতটা?

গিলেম বালাগ লিখেছেন, “মেসির চুক্তি শেষ গ্রীষ্মে এবং এখন মে মাস চলছে। ফ্রান্স থেকে তার সাথে চুক্তি নবায়ন হচ্ছে না, আবার বার্সেলোনা থেকে আনুষ্ঠানিক কোনও প্রস্তাব মেসি পাননি।”

বার্সেলোনা যদি শেষ পর্যন্ত লিওনেল মেসিকে প্রস্তাব দেয়ও তবু তারা মেসিকে যে বেতন দিতে সক্ষম সেটা অনেক কম। এখানে একটাই সুযোগ রয়েছে যদি মেসি তার সকল সুযোগ সুবিধা বিসর্জন দিয়ে তার শৈশবের ক্লাবে ফিরতে চান।বার্সেলোনার অর্থনৈতিক অবস্থা সুবিধার নয়। এই মুহূর্তে ক্লাবটি ৬০০ মিলিয়ন ইউরো বেতন দেয় ফুটবলারদের। মেসিকে যদি প্রস্তাবও দিতে চায় ক্লাবটি সেক্ষেত্রে এই মোট বেতনের পরিমাণ কমপক্ষে ২০০ মিলিয়ন কমাতে হবে। অর্থাৎ নিজেদের অর্থনৈতিক কাঠামো ঢেলে সাজাতে হবে ক্লাবটিকে।

গিলেম বালাগ লিখেছেন, “মেসির কথা ভুলে যান বার্সেলোনার হয়ে এখন যারা খেলছেন যেমন গাভি, আরাউ, মার্কোস অ্যালোনজো, সার্জি রবার্টো, এনাদের নতুন চুক্তিপত্রে সই করানোর মতো অবস্থানেও নেই এখন বার্সেলোনা।”ক্লাবটির এখন লা লিগার কাছে নতুন করে একটি বাস্তাবসম্মত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা পেশ করতে হবে। যেখানে বেতন কমানো, ফুটবলার বিক্রি এবং কোনও ট্রান্সফার ফি ছাড়া ফুটবলারদের নেয়ার প্রস্তাবও থাকতে হবে, এমনকি কোনও কোনও ফুটবলারের সঙ্গে চুক্তি বাতিলও করতে হতে পারে।একমাত্র তখনই বার্সেলোনা লিওনেল মেসির কথা ভাবতে পারবে।

তার ওপর এখন বার্সেলোনার স্টেডিয়াম ন্যু কাম্পে চলছে মেরামতের কাজ। ক্লাবটি অন্তত ২০২৪ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত অলিম্পিক স্টেডিয়ামে খেলবে। এখানে টিকিট বিক্রি বাবদ প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি ইউরো ক্ষতি গুণতে হবে।

নতুন করে স্টেডিয়াম তৈরির জন্য বার্সেলোনা ১.৪ বিলিয়ন ইউরো ধার নিয়েছে, ক্লাবটি আগে থেকেই ১.৩ বিলিয়ন ইউরো দেনায় ছিল।বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস এখন ক্লাবটির বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা বার্সেলোনার দেনা পরিশোধের দায়িত্ব নিয়েছে এবং আরও অর্থের জোগান দিচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানটি চায় যাতে লিওনেল মেসি বার্সেলোনায় ফেরেন, যাতে করে এই তারকা ফুটবলারের নামে আরও বেশি পৃষ্ঠপোষক ও বিনিয়োগকারীদের টানতে পারবে ক্লাবটি।

মেসি বার্সেলোনায় ফিরলে দ্রুতই ধার পরিশোধ করতে পারবে বার্সেলোনা এবং বার্সেলোনা গণমাধ্যমে নানা বক্তব্যে সমর্থকদের মধ্যে এই ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছে যে ক্লাবটি এখন মেসিকে বুঝিয়ে আবারও এই ক্লাবের হয়ে খেলাতে পারবে।

বার্সেলোনাকে কী করতে হবে?

গিলেম বালাগ লিখেছেন, “প্রথমেই বার্সেলোনার প্রেসিডেন্ট লাপোর্তাসহ যারা মেসির বার্সেলোনা ছাড়ার পেছনে ছিল তাদের ক্ষমা চাইতে হবে। লাপোর্তার জন্য এটা হবে কেবলই সৌজন্য। যদিও মেসি সেই ক্ষমা গ্রহণ করেন কি না এবং আবারও বার্সেলোনার শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর ভরসা করেন কি না সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।”লিওনেল মেসির বার্সেলোনা ছাড়ার সময়টা ছিল কঠিন। ন্যু কাম্পে শেষ সংবাদ সম্মেলনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন আর্জেন্টিনার এই তারকা। বার্সেলোনা ছাড়ার সময় মেসি ‘প্রতারিত’ বোধ করছিলেন।

টানা ২০ বছরের বেশি সময়, ৭৭৮টি ম্যাচ, ৬৭২ গোল, ৩৫টি শিরোপা - যার মধ্যে আছে ১০টি লা লিগা, ৪টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ট্রফি এবং এর বাইরে অসংখ্য ব্যক্তিগত রেকর্ড ও সম্মাননা জয়ের পর বার্সেলোনা ছেড়ে চলে যান লিওনেল মেসি।গিলেম বালাগ লিখেছেন, “মেসিকে দলে রাখার সব ব্যবস্থাই ছিল বার্সেলোনার, তবুও তাকে বিদায় করতে উঠেপড়ে লেগেছিল বোর্ড। মেসি তখন ছুটি বাতিল করে বার্সেলোনায় ফিরেছিলেন নতুন চুক্তিতে সই করার জন্য”।

এখনও পর্যন্ত লাপোর্তার সাথে মেসির বাবা জোর্জের কথা চলছে, এখনও লিওনেল মেসির সাথে সরাসরি কোনও যোগাযোগ হয়নি ক্লাব কর্তৃপক্ষের।স্প্যানিশ ফুটবল লেখক গিলেম বালাগ মনে করেন, চুক্তির সব কিছু চূড়ান্তভাবে খতিয়ে দেখতে চাইবেন এবার মেসি, এমনকি দীর্ঘমেয়াদি এক পরিকল্পনাও চাইতে পারেন।

বার্সেলোনাও চাইবে মেসি যদি ফিরে আসেনই সেক্ষেত্রে অন্তত ন্যু কাম্পে ফেরা পর্যন্ত থাকেন এবং সামনে ক্লাবের ১২৫তম বর্ষপূর্তি রয়েছে তখনও লিওনেল মেসিকে কেন্দ্র করে উদযাপন করার পরিকল্পনা করবে ক্লাবটি। সেক্ষেত্রে অন্তত দুই বছরের চুক্তিতে যেতে পারে ক্লাব ও লিওনেল মেসি।

স্পেনের গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, লিওনেল মেসিকে বার্সেলোনা প্রতি মৌসুমে ২৫ মিলিয়ন ইউরো বেতন প্রস্তাব দেবে যা এর আগের বারের চার ভাগের একভাগ, তবে এই বেতন দিলেই একমাত্র স্প্যানিশ লিগের নিয়মের মধ্যে থেকে মেসিকে দলে নিতে পারবে বার্সেলোনা।এমন কথাও এখন শোনা যাচ্ছে বার্সেলোনার একাডেমি লা মেসিয়ার ফুটবলাররা আগে যে ভবনে থাকতেন সেটাকে লিওনেল মেসির নামে জাদুঘরে রূপান্তর করা হবে এবং এই জাদুঘর থেকে আয় করা অর্থ মেসিকে ফিরিয়ে আনার পেছনে খরচ করবে।

বার্সেলোনা মেসির জন্য মরিয়া কেন?

স্পেনের কিছু গণমাধ্যমে এমন খবরও এসেছে যে বার্সেলোনা মেসির পেছনে এমন হন্যে হয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে ক্লাবটির বিরুদ্ধে রেফারি কমিটির সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসে মারিয়া এনরিকজ নেগ্রেইরার সাথে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে।এটাকে এখন নানাভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে ক্লাব কর্তৃপক্ষ এবং গিলেম বালাগ মনে করেন, মেসিকে ফিরিয়ে আনতে পারলে ক্লাবটি তার হারানো সম্মান কিছুটা হলেও ফেরত পাবে।লা লিগার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের তেবাজ অবশ্য এখন একটা জটিল পরিস্থিতিতে আছেন।

গিলেম বালাগ মনে করেন, “স্পেনের প্রতিটি ক্লাব এখন লা লিগার দিকে তাকিয়ে আছে, তারা কীভাবে বার্সেলোনার পরিস্থিতিটি সামলায় সেটা দেখার জন্য”।মি. তেবাজ সম্প্রতি বলেছেন, “আমি আশা করবো বার্সেলোনা মেসিকে নিয়ে আসার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন তা যাতে নেয়। কিন্তু আমরা আমাদের কোনও নিয়মে পরিবর্তন আনবো না”।

তিনি আরও বলেন, “আমি আশাবাদী কারণ আমি লিওনেল মেসির ভক্ত এবং আমি এবং আরও অনেকেই চাই মেসি যাতে আমাদের লিগে খেলে। তবে এজন্য কোনও নিয়মে পরিবর্তন আনবো না এটা জটিল কিন্তু আমার ধারণা ক্লাবটির সামর্থ্য রয়েছে”।বার্সেলোনা ও লা লিগার সম্পর্কও বেশ জটিল, লাপোর্তা যিনি বার্সেলোনার প্রেসিডেন্ট তিনি ইউরোপীয়ান সুপার লিগ ধারণার কট্টর সমর্থক অন্যদিকে তেবাজ এর ঘোর বিরোধী তাই দুই পক্ষের কূটনৈতিক সম্পর্কও খুব একটা সহজ নয় বলেই মনে করেন গিলেম বালাগ।

মেসি কী ভাবছেন?

গিলেম বালাগ লিওনেল মেসির ঘনিষ্টদের একজন এবং তিনি লিওনেল মেসিকে নিয়ে বইও লিখেছেন। বালাগ মনে করেন, “মেসি ফিরতে চান, কারণ ১৮টি বছর বার্সেলোনা ছিল মেসির ঘর। ঘরকুণো এক বালক থেকে পাঁকা স্বামী, বাবা ও ফুটবল কিংবদন্তী হয়েছেন মেসি এখানেই”।

বার্সেলোনার বর্তমান কোচ জাভি লিওনেল মেসির ফুটবল ক্যারিয়ারের অন্যতম সঙ্গী ছিলেন, জাভির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় মেসি ভালোভাবেই আছেন, তিনি অর্থনৈতিক দিক নিয়ে ভাবছেন না।জাভি মনে করেন, মেসি আসবেন এটা ৯০ শতাংশ নিশ্চিত, আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে খেলবেন তিনি ৪-৩-৩ ফরমেশনে অথবা ৪-৪-২ তে তিনি ওপরের দিকে খেলবেন।

তবে গিলেম বালাগ মনে করেন, “মেসিকে ২০২১ সালে যেভাবে বিদায় দেয়া হয়েছিল ক্লাব থেকে সেটা তিনি ক্ষমা করে দিলেও দিতে পারেন কিন্তু এটা তার মনে থাকবেই।”দুই বছর আগে যারা মেসিকে ক্লাব থেকে বিদায় করিয়েছিলেন তাদের পুরোপুরি বিশ্বাস করাটা কঠিনই হবে এই ফুটবলারের জন্য।আর মেসির সামনে সৌদি আরবের ক্লাব থেকে চার হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব তো আছেই, সাথে আছে আমেরিকান ক্লাবের গুঞ্জণ।

সূত্র : বিবিসি