গ্যাস সংকট কাটছে আজ, বিদ্যুতে সংকট থাকবে আরো দু'দিন

গ্যাস সংকট কাটছে আজ, বিদ্যুতে সংকট থাকবে আরো দু'দিন

গ্যাস সংকট কাটছে আজ, বিদ্যুতে সংকট থাকবে আরো দু'দিন

চট্টগ্রামে গত ক'দিন ধরে যে গ্যাস সংকট চলছিল তা আজ (সোমবার) সন্ধ্যা নাগাদ ঠিক হয়ে যাওয়ার খবর জানা গেলেও লোডশেডিং যে আরো বেড়েছিল তা ঠিক হতে আরো দিন দুয়েক সময় লাগবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের বিপণন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, চট্টগ্রামে শিল্প কারখানা বাদে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে।এরইমধ্যে এই গ্যাস নেটওয়ার্কে ঢুকেছে এবং সন্ধ্যা নাগাদ এটি গ্রাহকরা পাবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

চট্টগ্রামে গত চার দিন ধরে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ছিল বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন। আর এর আগে শুক্রবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে শুক্রবার রাত ১১টা থেকে দুটি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়।আমিনুর রহমান বলেন, “এখন লাইনে গ্যাস থাকলেও চাপ অত্যন্ত কম। তবে সন্ধ্যা নাগাদ এটি পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে।”

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, মহেশখালীতে যে দুটি এলএনজি টার্মিনাল ছিল, ঘুর্ণিঝড় মোখার কারণে সেগুলোর সরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কারগরি কারণে এবং সমুদ্র খুব বেশি উত্তাল না থাকায় একটি টার্মিনাল সরতে পারেনি। ফলে সেটি থেকেই এখন উৎপাদন শুরু হয়েছে।

এদিকে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বিবিসি বাংলাকে বলেন, লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নয়ন হতে আরো দু’দিন সময় লাগবে।প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, সোমবার দিনের সর্বোচ্চ চাহিদা ১৪৫০০ মেগাওয়াট। আর এর বিপরীতে গতকালের প্রকৃত উৎপাদন ১১০২৫ মেগাওয়াট। এখানে তিন হাজার ৪৭৫ মেগাওয়াটের মতো ঘাটতি রয়েছে।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার মূল সমস্যাই ছিল গ্যাস সরবরাহ না থাকা। কক্সবাজারে যে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে সেগুলোর উৎপাদন বন্ধ থাকার কারণেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়া যায়নি।

যার জন্য উৎপাদন ঘাটতি ছিল এবং এ কারণেই লোডশেডিংয়ের পরিমাণ এতো বেশি বেড়েছিল।দেশে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছিল। গত ক'দিনে এই সংকট আরো বেশি বেড়েছিল। রাজধানী ঢাকার তুলনায় গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং বেশি বলেও খবর পাওয়া যায়।

মি. হোসাইন জানান, আজ থেকে এই টার্মিনাল দুটির মধ্যে একটির উৎপাদন শুরু হবে এবং গ্যাসের সরবরাহ আংশিক পাওয়া যাবে। ফলে এখন যে তিন হাজার মেগাওয়াটের মতো ঘাটতি রয়েছে তা কমে দেড় হাজার ওয়াটের মধ্যে নেমে আসবে।এর ফলে লোডশেডিংও অর্ধেকে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।তবে বাকি যে টার্মিনালটি রয়েছে সেটির উৎপাদন শুরু হতে আরো ১০-১২ দিন লাগবে। এই সময়ের মধ্যে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদনও শুরু হয়ে যাবে বলে জানান মি. হোসাইন।

তিনি বলেন, রামপালের কয়লা এসে গেছে। সাইক্লোনের জন্য কয়লা অর্ধেকের মতো আনলোড হয়েছিল। বাকিটা আনলোড হলে রামপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।

“গ্যাসের যেটুক ঘাটতি সেটা রামপালের উৎপাদন দিয়ে কাভার হয়ে যাবে। আমরা আশা করছি যে কাল বাদে পরশু দিন পরিস্থিতি অনেকটাই ইমপ্রুভ হয়ে যাবে।”গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। যার কারণে বিদ্যুতেরও ঘাটতি দেখা দিয়েছিল।

ভোগান্তিতে জনগণ

একদিকে লোডশেডিং, আর অন্যদিকে গ্যাসের সংকট - এই দুই ধরণের জ্বালানির সংকটের কারণে রাজধানী ঢাকাসহ পুরো দেশেই নাজেহাল হয়ে পড়েছিলো জনজীবন।

চট্টগ্রামের বালুচড়া ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাসিন্দা মুজাফ্ফর আহমেদ জানান, টানা চার দিন ধরে তার এলাকায় গ্যাস সরবরাহ একেবারেই বন্ধ রয়েছে।তার বাড়িতে প্রায় ৫০ জনের মতো ভাড়াটিয়া আছে উল্লেখ করে মি. আহমেদ বলেন, চার দিন ধরে চুলা জ্বালানোর মতো অবস্থা নেই। বন্ধ রয়েছে রান্না-বান্না।

উপায় না দেখে বাজার থেকে কাঠ কিনে নিয়ে নিজের আর ভাড়াটিয়াদের রান্নার ব্যবস্থা করেছেন তিনি।“এখন কী করবো? লাকড়ি দিয়া চলছে। এই লাকড়িও তো পাওয়া যাচ্ছে না বাজারে। বহুত মুসিবতে আছি।”শুধু গ্যাসের এই অবস্থা নয়, বরং বিদ্যুত নিয়েও ভোগান্তিতে রয়েছেন তারা। মি. আহমেদ বলেন, “কারেন্ট এখন একবার যাচ্ছে, আবার আসছে, আধা ঘণ্টা থাকলে দুই ঘণ্টা থাকে না।”

গ্যাসের এই সংকট চট্টগ্রাম ছাড়াও ঢাকাতেও দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সিএনজি পাম্পগুলোতে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন গ্যাসচালিত যানবাহনের চালকরা।তারা বলছেন, কিছু কিছু গ্যাস পাম্পে বিদ্যুৎ না থাকার কারণে গ্যাস দেয়া বন্ধ রয়েছে। আবার কিছু কিছু পাম্পে অল্প পরিমাণ গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে।

গত সপ্তাহ খানেক ধরে এমন অবস্থা চলছে বলে জানাচ্ছেন তারা। খিলগাঁও এলাকার সিএনজি চালক ফারুক মিয়া বলেন, একবার গ্যাস নিতে হলে অনেক সময় ১০-১২ টা পর্যন্ত পাম্পে ঘুরতে হয়।“১০টা পাম্প, ১২টাা পাম্প ঘুুইরা এমন একটা সংকটে পড়ি যে আর টাইম নাই, ০৬টা বাজলে দিবো পাম্প বন্ধ কইরা,” বলেন ফারুক মিয়া।

একই কথা বলছিলেন আরেক সিএনজি চালক মোহাম্ম নিরব। তিনি বলেন, “গ্যাস তো পাওয়া যাচ্ছেই না, তিনঘণ্টা-চারঘণ্টা পর গ্যাস পাওয়া যায়।”“এতোক্ষণ বইয়া থাইকা ৭০ টাকা ৮০ টাকার গ্যাস ১২০ টাকা, হাইয়েস্ট দেড়শ টাকায় পাওয়া যায়।”মি. নিরব জানান, ১২০ টাকার গ্যাস দিয়ে তিন ঘণ্টার মতো সিএনজি চালানো যায়। ফলে দিনে অন্তত দু'বার গ্যাসের জন্য পাম্পে পাম্পে ঘুরতে হয় তাদের।

সংকট কাঙ্ক্ষিত ছিল?

শুক্রবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে শুক্রবার রাত ১১টা থেকে দুটি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়।একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকলে ৪০ কোটি ঘনফুটের মতো গ্যাস সরবরাহ কম হয়।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে মহেশখালীতে যে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ছিল তার মধ্যে একটির কার্যক্রম সোমবার থেকে শুরু হয়েছে। সেখান থেকে গ্যাস সরবরাহ এখন থেকে পাওয়া যাবে।তবে, অন্য যে টার্মিনালটি সরে গিয়েছিল সেটি আবার চালু হতে ১০-১২ দিন লাগবে।গ্যাস টার্মিনালটি সমুদ্রের নিচে থাকা পাইপলাইন থেকে সংযোগ খুলে ফেলে দূরে সরে গিয়েছিল। এখন এই সংযোগ পুনঃস্থাপিত করতে এই সময় লাগবে বলে প্রতিমন্ত্রী ব্যাখ্যা করেন।

তবে পাইপলাইন সংযোগ এতো সময় কেন লাগছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, “কারণ, এটা সমুদ্রের নিচে, ডুবুরী আনতে হবে, সেই ডুবুরী যাবে, সমুদ্র যদি লেভেল না হয়, ঢেউ থাকে, ঘোলা থাকে, তারা নিচে নামবে না, অনেক বিষয় আছে।”বাংলাদেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৪০০ কোটি ঘনফুটের মতো। সেখানে সরবরাহ সক্ষমতা রয়েছে ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো।এলএনজি সক্ষমতা স্বাভাবিক সময়ে সাড়ে ৬৫-৭০ কোটি ঘনফুটের মতো।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মি. হামিদ বলেন, দেশে গ্যাসের সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণ হচ্ছে চাহিদা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে।চাহিদা বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়া, শিল্পক্ষেত্রে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে গেছে। অন্যদিকে গ্যাসের উৎপাদন কমে গেছে।“আগে আমরা পেতাম ২৭০০ এমএনসিএফ গ্যাস, এখন এটা ২২০০ হয়ে গেছে, তার মানে কমে গেছে, ডিকলাইন করেছে,” বলেন প্রতিমন্ত্রী।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের যে অবকাঠামো রয়েছে সে অনুযায়ী, ৮০০ এনএনসিএফ এর বেশি তরল গ্যাস আমদানি করা সম্ভব হয় না। ফলে আরো দুটো টার্মিনাল বা অবকাঠামো স্থাপন করতে হবে যার জন্য অন্তত দুই বছর সময় লাগবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।এদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোখার কারণে গ্যাস ও বিদ্যুতের ক্ষেত্রে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা আসলে অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। বরং এই তথ্য আগে থেকেই জানা ছিল।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, এলএনজি টার্মিনাল যখন স্থাপনের জন্য নকশা করা হয় তখনই বলা হয়েছিল যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এগুলো বছরে ২০-২৫ দিন বা এক মাসের মতো বন্ধ থাকবে।কারণ বঙ্গোপসাগরে সারাক্ষনই নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ তৈরি হতে থাকে। ফলে এমন পরিস্থিতি অনাকাঙ্ক্ষিত নয়।এক্ষেত্রে সমাধান হিসেবে তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে সমাধান একটাই, সেটা হলো আমাদের গ্যাস স্টোরেজ থাকতে হবে।”

গ্যাস সরবরাহ যদি ব্যাহত হয় তাহলে মজুদ থেকে যাতে তা সরবরাহ অব্যাহত রাখা যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। একইসাথে সাগরে গ্যাস পরিশোধন টার্মিনালের পাশাপাশি স্থল ভিত্তিক টার্মিনাল স্থাপন করা। এর ফলে একদিকে যেমন দুর্যোগের সময় গ্যাসের সরবরাহ অব্যাহত থাকবে তেমনি এটি অবকাঠামোগত সক্ষমতাও বাড়াবে বলে মনে করেন তিনি।

সূত্র : বিবিসি