পাবনার কচুরিপানা থেকে নজরকাড়া হস্তশিল্পের পণ্য রপ্তানি

পাবনার কচুরিপানা থেকে নজরকাড়া হস্তশিল্পের পণ্য রপ্তানি

পাবনার কচুরিপানা থেকে নজরকাড়া হস্তশিল্পের পণ্য রপ্তানি

পাবনায় কচুরিপানা থেকে তৈরি হচ্ছে হস্তশিল্পের নজরকাড়া বিভিন্ন রকম পণ্য। সাশ্রয়ী দামে এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে দেশ-বিদেশে। বর্তমানে জেলা থেকে তৈরি কচুরিপানার পরিবেশবান্ধব পণ্য ইউরোপ, আমেরিকার অন্তত আটটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এতে বছরে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা আয় হচ্ছে। সেইসাথে কচুরিপানা ঘিরে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ১৫টি গ্রামের অন্তত ৩০০০ পরিবাররের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।

সাঁথিয়া উপজেলার ক্ষেতুপাড়া ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের জয়তুন খাতুন-রফিকুল ইসলাম দম্পতির উদ্যোগে গড়ে উঠেছে এমনই এক কুটিরশিল্প। এখানে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চলে কচুরিপানা ক্রয়-বিক্রয় ও পণ্য উৎপাদন। কচুরিপানা থেকে টব, ফুলদানি, বালতি, পাটি, ট্রে, ফলঝুড়ি, ডিম রাখার পাত্র, পাপোশ, মোড়া, টুপি, আয়নার ফ্রেম, ডাইনিং টেবিলের ম্যাটসহ ২০ ধরণের পণ্য তৈরি হচ্ছে। ৬০ থেকে ৭০ জন শ্রমিক একাধারে কাজ করছেন যার বেশিরভাগই নারী।

শ্রমিকরা বিভিন্ন আকারের ফুলের টব তৈরিতে ৪০ থেকে ১০০ টাকা মজুরি পান। একইভাবে ফলঝুড়িতে ১০০  থেকে ২৫০, পাপোশে ৩০, ফুলদানি ও ট্রেতে ৩৫ থেকে ৭০ ও আয়নার ফ্রেম বাবদ ৪০০ থেকে ৪২০ টাকা মজুরি পান। এসব পণ্য কেউ কারখানায় বসে তৈরি করেন; আবার কেউ বাড়িতে বসে কাজ করে সেগুলো কারখানায় জমা দেন। কচুরিপানা পরিবহণ ও শুকানোর কাজ থেকে শ্রমিকরা গড়ে দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করতে পারেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, সাঁথিয়া উপজেলার ঘুঘুদহ, গৌরীগ্রাম, দোপমাজগ্রাম, ধাতালপুর, ক্ষেতুপাড়া, মিয়াপুর, বহলবাড়িয়া, বানিয়াবছ, গাঙ্গোহাটি এবং বেড়া উপজেলার জগন্নাথপুর, হাটুরিয়া, নাকালিয়াসহ ১৫টি গ্রামের মানুষ প্রতিদিন কচুরিপানা বিক্রি করতে আসেন রফিকুল কুটিরশিল্পে। দিনে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ মণ কাঁচা এবং ৫-৭ মণ শুকনো কচুরিপানা ক্রয়-বিক্রয় হয়। প্রতি মণ কাঁচা কচুরিপানা ১০০ থেকে ১২০ টাকা এবং শুকনো বিক্রি হয় ১ হাজার ৮০০ টাকায়।

জয়তুন খাতুন-রফিকুল ইসলাম দম্পতি গ্রামের নারীদের মাধ্যমে কচুরিপানা দিয়ে পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি হস্তশিল্প রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠান ‘বিডি ক্রিয়েশনে’ এগুলো বিক্রি করেন। খুলনার একটি কারখানাতেও তিনি পণ্য ও কচুরিপানা সরবরাহ করেন। সেখানে কচুরিপানা থেকে কাগজ, কাগজের পুতুল, নোটবুক, ওয়ানটাইম গ্লাস-প্লেটসহ বাহারি পণ্য তৈরি হচ্ছে।

জয়তুন খাতুন জানান, বিয়ে হয়ে স্বামীর বাড়িতে আসার পর দেখেছি আমার শ্বশুর বেতের ব্যবসা করতেন। সেটা দেখে আমার স্বামীও ব্যবসা শুরু করেন। এরপর তিন বছর আগে মাথায় আসে বেতের জিনিসপত্র এত দাম দিয়ে যারা কেনে, তারা কিভাবে কি করে, কেন কেনে, সেটা দেখা দরকার। আমার স্বামীর সাথে ঢাকায় যাই বিডি ক্রিয়েশনে। সেখানে গিয়ে দেখতে ও জানতে পারি কচুরিপানা দিয়ে নানারকম পণ্য তৈরি করছে। তখন আমাদের মাথায় আসে আমরাও এটা করতে পারি। তখন বিডি ক্রিয়েশনকে বলি আমাদের শিখিয়ে দেন আমরাও এটা করবো। তারপর সেখান থেকে তিনজন মাস্টার আমাদের গ্রামে এসে হাতেকলমে শিখিয়ে দেন। এভাবেই শুরু করি। তারপর গ্রামের নারীদের এ কাজে আমরা সম্পৃক্ত করি। বর্তমানে ৩০-৪০ জন নারী কচুরিপানা দিয়ে হস্তশিল্পের পণ্য তৈরির কাজ করছে। বর্তমানে ১০ রকমের পণ্য তৈরি করে বিক্রি করছি। খরচ বাদে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হয়।

তিনি বলেন, আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা এটিকে আমরা অনেকদূর এগিয়ে নিতে চাই। আরও বড় পরিসরে করতে চাই। কিন্তু আর্থিক সংকটে এগুতে পারছি না। এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে লাভ বেশি হচ্ছে না। সরকার যদি অল্প সুদে আমাদের ঋণ দেয় তাহলে আমি এই কাজে গ্রামের অন্তত ২ হাজার নারীকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবো।

রফিকুল ইসলাম বলেন, বেতের ব্যবসা থেকে কচুরিপানা দিয়ে হস্তশিল্পের পণ্য তৈরির ধারণা নিয়ে মাথায় আসে। বিডি ক্রিয়েশন আমাদের সহযোগিতা করছে। কিন্তু অর্থাভাবে বড় পরিসরে করতে পারছি না। কারণ কোম্পানী থেকে অর্ডার নিয়ে এসে নিজেকে অর্থ লগ্নি করে কাজগুলো তুলতে হয়। সেক্ষেত্রে এনজিও থেকে যে ঋণ নেই সেটার অনেক সুদ বহন করতে হয়। লাভ খুব একটা থাকে না। তাই সরকার যদি আমাদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে এলাকার অনেক মানুষের কাজের ব্যবস্থা হবে।

এদিকে, কুচরিপানা বিক্রি ও পণ্য তৈরির কাজ করে অনেকেই সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন। স্কুল-কলেজ পড়–য়া অনেক ছাত্রীও এ কাজ করে নিজেদের হাতখরচ ও পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নিতে পারছেন। সাঁথিয়ার ধাতালপুর গ্রামের ইন্তাজ আলী, মিয়াপুর গ্রামের নাজমুল মিয়া ও বানিয়াবছ গ্রামের মজিবুর রহমান জানান, প্রতিদিন ৮০০  থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার কচুরিপানা বিক্রি করেন তারা।

হস্তশিল্প শ্রমিক সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রী খুশি খাতুন ও মিয়াপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া খাতুন বলেন, পড়াশোনার ফাঁকে যতটুকু সময় পাই, কচুরিপানার পণ্য তৈরির কাজ করি। এতে যে আয় হয় তা দিয়ে নিজেদের লেখাপাড়া ও হাতখরচ, পোশাকের খরচ চালিয়ে নিতে পারছি।

রসুলপুর গ্রামের মাজিয়া খাতুন, আকলিমা বেগম, গঙ্গারামপুর গ্রামের ডলি খাতুন, জানান, সংসারের কাজ শেষ করে আমরা এই কাজ করি। এতে সপ্তাহে ১২শ’ টাকা থেকে ১৫শ’ টাকা আয় করতে পারি। তাতে স্বামীর অভাবী  সংসারে বেশ কাজে লাগে। আগের থেকে বর্তমানে কিছুটা স্বচ্ছলতা এসেছে।

সাঁথিয়া উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন জানান, আমাদের পক্ষ থেকে ঋণদানের সুবিধা আছে। যদি জয়তুন খাতুন-রফিকুল দম্পতি আমাদের কাছে আবেদন করেন তাহলে আমরা তাদের শতকরা আড়াই ভাগ সার্ভিস চার্জে ঋণ দিতে পারবো। সেইসাথে এই কুটিরশিল্পকে ঘিরে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যাতে গ্রামের আরও বেশি নারীকে এই কাজে সম্পৃক্ত করা যায়।

বিডি ক্রিয়েশনের জৈষ্ঠ ব্যবস্থাপক (অপারেশন) মাহবুব আলম বলেন, ২০২০ সাল থেকে আমরা কচুরিপানা দিয়ে হস্তশিল্প পণ্য তৈরির কাজ শুরু করি। ওই বছরের শেষের দিকে সাঁথিয়া জয়তুন-রফিকুল দম্পতি আমাদের সাথে কাজ করছে। আমরা তাদের পাশে থাকতে পেরে গর্বিত।

বিডি ক্রিয়েশনের কর্ণধার আব্দুর রহমান আশিক জানান, শুকনো কচুরিপানা কিনে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে তারা বাহারি সব পণ্য তৈরি করেন। আটটি দেশে কচুরিপানার তৈরি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রতি বছর দেড় থেকে দুই কোটি টাকার এসব পরিবেশবান্ধব পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে।