বিদ্যুতের ঘাটতি ৩০০০ মেগাওয়াট, সারা দেশে লোডশেডিং

বিদ্যুতের ঘাটতি ৩০০০ মেগাওয়াট, সারা দেশে লোডশেডিং

ফাইল ছবি

ক্রমে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। তবে জ্বালানিসংকটে উৎপাদন বাড়াতে পারছে না বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এতে রাজধানীসহ সারা দেশে বাড়ছে লোডশেডিং। রাজধানীতে দিনে গড়ে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং হলেও গ্রামাঞ্চলে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

তীব্র গরমে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। 

বিদ্যুৎ বিতরণ কম্পানিগুলো বলছে, অত্যধিক গরমের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেড়ে গেলেও সে অনুযায়ী বরাদ্দ পাচ্ছে না তারা। ফলে বাধ্য হয়ে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। বিপিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার সংকটে জ্বালানি তেল, এলএনজি ও কয়লা আমদানি কমায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে চাইলেই উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না।

ফলে চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের বড় ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এ কারণে লোডশেডিং বেড়েছে।

জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার সারা দেশে সর্বোচ্চ লোডশেডিং হয়েছে এক হাজার ৭২৭ মেগাওয়াট। গতকাল বুধবার দিনের ১২টায় লোডশেডিং হয়েছে এক হাজার ৪০৮ মেগাওয়াট।

রাতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ায় লোডশেডিং আরো বেশি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পিজিসিবি দৈনিক বিদ্যুতের যে চাহিদা ও লোডশেডিং প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করে, বর্তমানে চাহিদা ও লোডশেডিং এর চেয়ে দেড় হাজার মেগাওয়াট বেশি। বর্তমান পরিস্থিতিতে জ্বালানিসংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে দৈনিক প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি থাকছে। মূলত উৎপাদনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চাহিদা তৈরি করে প্রকাশ করা হয় বলেও জানান তাঁরা।

সক্ষমতা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন

বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৪৭ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক।

গ্যাসসংকটে গ্যাসভিত্তিক সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো যাচ্ছে না। এই কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াট। গতকাল দিনের বেলায় উৎপাদন হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট।

ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা সাত হাজার মেগাওয়াটের বেশি। গতকাল দিনের বেলায় উৎপাদন হয়েছে দুই হাজার ২১৫ মেগাওয়াট। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তিন হাজার ৪৪০ মেগাওয়াট। গতকাল দিনের বেলায় উৎপাদন হয়েছে দুই হাজার ১৫৭ মেগাওয়াট।

কয়লাসংকটে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে। কেন্দ্রের দুই ইউনিটের একটি এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। মজুদ কয়লা দিয়ে দ্বিতীয় ইউনিট চলতে পারে আগামী ৩ থেকে ৪ জুন পর্যন্ত। দেশের বড় এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে আরো বাড়তে পারে লোডশেডিং।

বিতরণ কম্পানিগুলো যা বলছে : রাজধানীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে দুটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কম্পানি (ডেসকো)। গতকাল দিনের বেলায় এই দুই বিতরণ কম্পানির বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল প্রায় ৬০০ মেগাওয়াট।

লোডশেডিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিকাশ দেওয়ান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের বিতরণ এলাকায় আজ (গতকাল) দিনের বেলা বিদ্যুতের চাহিদা ছিল এক হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। কিন্তু আমরা সর্বোচ্চ সরবরাহ করতে পেরেছি এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৪৫০ মেগাওয়াট। দিনের বেলায় আমাদের লোডশেডিং করতে হয়েছে ৩৫০ থেকে ৪০০ মেগাওয়াট।’

ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. কাওসার আমীর আলী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তাপমাত্রা বাড়ায় বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। আজ (গতকাল) আমাদের বিতরণ এলাকায় দিনের বেলা সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল এক হাজার ২৭০ মেগাওয়াট। কিন্তু আমরা সর্বোচ্চ এক হাজার ৯৫ মেগাওয়াট সরবরাহ করতে পেরেছি। ফলে ১৭৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে।’

দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ কম্পানি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) বিতরণ এলাকায় সর্বাধিক লোডশেডিং হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করে আরইবির এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, চাহিদা বাড়লেও বিপিডিবির উৎপাদন সেভাবে বাড়ছে না। ফলে আজ (গতকাল) দিনের বেলায়ও এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে। সন্ধ্যার পর লোডশেডিং আরো বাড়বে বলে জানান তিনি।

রাজধানীর বাইরের চিত্র

ময়মনসিংহ : তীব্র গরমে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুর ও নান্দাইলে দিনে-রাতে ১০ থেকে ১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং করা হচ্ছে। এসব উপজেলার অনেক এলাকায় রাতের বেলায় দুই ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ থাকে না। এ অবস্থায় অতিষ্ঠ গ্রামের মানুষ। হাসপাতালগুলোয় বড় সমস্যা টিকা সংরক্ষণ করা নিয়ে।

নান্দাইল উপজেলার চণ্ডীপাশা ইউনিয়নের খামারওগাঁও গ্রামের স্কুল শিক্ষক মজুমদার প্রবাল জানান, দিনে এখন সব মিলিয়ে দুই ঘণ্টাও বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় ফ্রিজে রাখা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নষ্ট হচ্ছে। চালু করা যাচ্ছে না গভীর নলকূপ।

নান্দাইল পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) বিপ্লব চন্দ্র সরকার জানান, নান্দাইল উপজেলায় বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ৩১ মেগাওয়াট। পাওয়া যাচ্ছে ১০ থেকে ১১ মেগাওয়াট। একই অবস্থা গৌরীপুর ও ঈশ্বরগঞ্জে।

সিলেট : সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায় প্রতিদিন গড়ে ১০ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলে পরের এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। এতে গ্রাহকরা চরম দুর্ভোগে পড়েছে।

মাথিউরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমান উদ্দিন বলেন, এ রকম বিদ্যুত্সংকট গত ১৫ বছরে হয়নি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১০ ঘণ্টা লোডশেডিং। সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। দায়িত্বশীলরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন বলে আশা করছি।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে তিন দিন ধরে লোডশেডিং বেড়েই চলেছে। দিনরাত প্রায় ৯ ঘণ্টা থাকে না বিদ্যুৎ। এতে এলাকার প্রায় চার লাখ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। লোডশেডিংয়ে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।

বাগেরহাট : বাগেরহাটের শরণখোলার বিভিন্ন গ্রামে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। এতে এই এলাকার মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে।

পল্লী বিদ্যুতের শরণখোলা এজিএম আশিক জানান, শরণখোলায় রাতে বিদ্যুতের চাহিদা সাড়ে ১১ মেগাওয়াট এবং দিনে চাহিদা ৯ মেগাওয়াট। কিন্তু সেখানে দিন ও রাতে সরবরাহ করা হচ্ছে মাত্র চার থেকে সাড়ে চার মেগাওয়াট।

খাগড়াছড়ি : খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় অতিরিক্ত লোডশেডিং হচ্ছে বলে জানা গেছে। গত কয়েক দিন ধরে লোডশেডিং বেড়ে চলেছে। বর্তমানে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ১০ বার লোডশেডিং হচ্ছে।

সূত্র: কালেরকন্ঠ