আবহাওয়া পরিস্থিতি ভয়াবহ, প্রচণ্ড গরমে স্কুল বন্ধ

আবহাওয়া পরিস্থিতি ভয়াবহ, প্রচণ্ড গরমে স্কুল বন্ধ

প্রতীকী ছবি।

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা এক নারী গতকাল রোববার (০৪ জুন) সন্তানকে নিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পর এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, তিনি আগামী কয়েক দিন তাঁর সন্তানকে আর স্কুলে পাঠাবেন না। পড়াশোনার ক্ষতি যদি হয়, হোক।

এই নারীর সন্তান মিরপুরের একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। দেখা গেছে, শিশুটি ঘেমে অস্থির। মুখমণ্ডলে ঘামাচি উঠে ভরে গেছে। সর্দিতেও আক্রান্ত।

সকালের এই ঘটনার পর বিকেলে জানা যায়, দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস ৫ থেকে ৮ জুন পর্যন্ত বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

ফলে বেসরকারি স্কুলের শিশুশিক্ষার্থীদের এই গরমেও ক্লাসে যেতে হবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। অভিভাবকেরা বিভ্রান্তিতে যেমন রয়েছেন, তেমনি সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগেও রয়েছেন। সিদ্ধান্ত হয়নি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও।

এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশের কয়েকটি জেলার ওপর দিয়ে তীব্র এবং বেশির ভাগ অঞ্চলে মাঝারি ও মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড গরম আরও পাঁচ থেকে ছয় দিন অব্যাহত থাকতে পারে।

প্রচণ্ড গরমে বাইরে কাজ করা শ্রমজীবী মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। স্বাভাবিক সময়ের সমপরিমাণ কাজ করতে না পারায় তাঁদের আয় কমেছে। শিশু ও প্রবীণেরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। মানুষের ভোগান্তি বহুগুণ বাড়িয়েছে বারবার লোডশেডিং। একজন শিক্ষক ও একজন চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিনের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা দরকার। কারণ, শ্রেণিকক্ষে বিদ্যুৎ না থাকলে গরমে শিশুশিক্ষার্থীদের অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

তাপপ্রবাহের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা বা বন্ধ ঘোষণার বিষয়ে আন্তমন্ত্রণালয়ের বৈঠকের মাধ্যমে সমন্বিতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এম তারিক আহসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তগুলো একই রকমের হওয়া উচিত। কিন্তু শিক্ষার বিভিন্ন ধারার মধ্যে আন্তসমন্বয়ের জন্য যে ধরনের নীতিমালা বা আইনি কাঠামো দরকার, তা নেই।

গরম থাকবে

দেশে সাধারণত এপ্রিল ও মে মাসে সবচেয়ে বেশি গরম পড়ে। চলতি বছরের এই দুই মাসে স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টি হয়েছে। এর আগে এ বছরের মে মাসের শুরুতে প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। তখন বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় মোখা সৃষ্টি হয়। ঝড়টি গত ১৪ মে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও মিয়ানমারের রাখাইন উপকূলে আঘাত হানে। এরপর দেশে গরম কমতে থাকে।

এই দফায় প্রচণ্ড গরম শুরু হয় মে মাসের শেষ দিকে। গতকাল সন্ধ্যা ছয়টায় আবহাওয়া অধিদপ্তর পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার জন্য আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলেছে, আবহাওয়ার অবস্থা পরিমাপের ৪৪টি স্টেশনের মধ্যে ৩৭টিতেই মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ পাওয়া গেছে।

পূর্বাভাসে বলা হয়, নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও রংপুর বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, রাঙামাটি, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী ও বান্দরবান জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তা অব্যাহত থাকতে পারে।

সরকারিভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা বিভ্রান্তি ও উদ্বেগে।

তাপমাত্রা যদি ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়, তাহলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলে। ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বলা হয়। তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয় যখন তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। আর অতি তীব্র হয় ৪২ ডিগ্রি বা তার বেশি হলে।

বিগত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় দিনাজপুরে, ৪১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আগামী পাঁচ থেকে ছয় দিন এমন মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ থাকতে পারে। বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকার জন্য গরমের অনুভূতিও বেশি হতে পারে।

আজ সোমবার প্রচণ্ড গরমের পূর্বাভাস দিলেও আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।

‘গরম কি শুধু সরকারি স্কুলের শিশুদের’

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল বলা হয়, দেশব্যাপী তাপপ্রবাহের কারণে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করে বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, আনুষ্ঠানিকভাবে চার দিনের ছুটি ঘোষণা করলেও বাস্তবে স্কুল বন্ধ থাকবে ছয় দিন। কারণ ৯ ও ১০ জুন (শুক্র ও শনিবার) সাপ্তাহিক ছুটির দিন।

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য বলছে, দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রাথমিক স্তরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯১ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এগুলোতে মোট শিক্ষার্থী ২ কোটি ১ লাখের বেশি। এর মধ্যে সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। সরকারি এসব স্কুলে পড়াশোনা করে প্রায় ১ কোটি ৩৪ লাখ শিক্ষার্থী।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষাসচিব ফরিদ আহাম্মদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বিদ্যালয়ের জন্য আমরা সিদ্ধান্ত দিয়েছি। বাকি বিদ্যালয় যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা সিদ্ধান্ত নেবে।’

কিছু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রাথমিক স্তর আছে। সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। কিন্ডারগার্টেনসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করে না।

দেশে মাধ্যমিক স্তরে পড়ানো হয় ২০ হাজার ৯৬০ বিদ্যালয়ে। এগুলোতে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ১ লাখের বেশি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের অধীন বিদ্যালয়গুলো বন্ধের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ৭ জুন থেকে মূল্যায়ন ও অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। তবে তাঁরা খোলা আকাশের নিচে প্রাত্যহিক সমাবেশ (অ্যাসেম্বলি) ও শরীরচর্চা যাতে এই সময়ে বন্ধ রাখা হয়, সে বিষয়ে সোমবার (আজ) নির্দেশনা দেবেন।

অভিযোগ আছে, শিক্ষার বিভিন্ন কাজ নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাঝেমধ্যেই সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। এটিও তার একটি। দুই মন্ত্রণালয় সমন্বয় করে ছুটির এই সিদ্ধান্ত নিলে সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হতো না।

স্কুল বন্ধের খবরের বিষয়ে জানতে গতকাল রাতে এই প্রতিবেদককে ফোন করেন এক অভিভাবক। তাঁর সন্তান বেসরকারি স্কুলে পড়ে। শুধু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধের বিষয়টি জানালে তিনি প্রশ্ন করেন, গরম কি শুধু সরকারি স্কুলের শিশুদের লাগে? তাঁর মতে, গরমে শিশুদের কষ্ট হয়, সেটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধের মাধ্যমে সরকার মেনে নিয়েছে। কিন্তু সরকারি সিদ্ধান্ত সব শিশুর কথা ভেবেই হওয়া উচিত।

অবশ্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাইরে গতকাল কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেদের উদ্যোগে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্লাস বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে।

‘প্রয়োজন ছাড়া বাইরে নয়’

বিশিষ্ট চিকিৎসক ও বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের জ্বর, সর্দি ও পাতলা পায়খানার মতো রোগ দেখা যাচ্ছে। প্রচণ্ড গরমে প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়াই ভালো। যেতে হলে ছাতা ব্যবহার করতে হবে। আর বারবার পানি পান করতে হবে। সেটা সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। শিশুদের স্কুলের বিষয়ে তিনি বলেন, গরমে বাচ্চারা অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। কারও কারও মধ্যে ‘হিট স্ট্রোক’-এর উপসর্গ দেখা দিতে পারে। সব স্কুল কিছুদিন বন্ধ রাখলেই ভালো হতো।